সিংহবাহিনী দুর্গা- লক্ষ্মী সরস্বতী না থাকলেও কার্তিক গণেশ আছে!
গোপভূমের দ্বারিয়াপুরের বনেদি চক্রবর্তী পরিবার। পরিবারের আদিপুরুষ জগন্নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। অতি শৈশবে মাতৃহারা হলে কয়েকমাস পরেই পিতা বিষ্ণুপদ বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহের আয়োজন করতেই জগন্নাথের মাতামহ দেবপ্রসন্ন চট্টরাজ, নাতিকে পিত্রালয় পাত্রসায়র থেকে নিয়ে আসেন নিজের বাড়ী দ্বারিয়াপুরে। এখানেই মাতামহ এবং নিঃসন্তান মামা-মামীমার অভিভাবকত্বে বড় হতে থাকেন জগন্নাথ। মতামহ ও মাতুল উভয়েই তত্কালীন তর্কবাগীশপুর (অধুনা তকিপুর) টোলের পণ্ডিত ছিলেন। সেই সূত্রে জগন্নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও পণ্ডিতির পাঠ নিতে শুরু করেন।
বেশ বছর খানেক পরে দ্বারিয়াপুর গ্রামে গ্রীষ্মকালীন জলসংকটের কারণে মাতুলের ইচ্ছায় একটি দীঘি কাটানোর উদ্যোগ নে’ন জগন্নাথ। সেই দীঘি কাটাতে গিয়েই অযাচিতভাবে দেবী দশভুজা সিংহবাহিনীর বিগ্রহ পান। বয়োজ্যেষ্ঠদের পরামর্শে ঐ বিগ্রহ বাসভবনেই প্রতিষ্ঠা করে নিত্যসেবা শুরু করেন জগন্নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বছরখানেক পরে তাঁর মামা দেহরক্ষার আগে বত্সরান্তে শারদোত্সব আয়োজনের আদেশ দিয়ে যান। এ’ঘটনা আনুমানিক ৪৫০ বছর আগেকার। সিংহবাহিনীর বিগ্রহপ্রাপ্তির নীরব সাক্ষী সেই দীঘি আজ আর দীঘি নেই, ডোবা হয়ে গেছে(জগার ডোবা)।
জগন্নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধস্তন চতুর্থ প্রজন্ম নবকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তত্কালীন বর্ধমানরাজের থেকে ‘রাজচক্রবর্তী’ উপাধিতে ভূষিত হ’ন। যদিও এই উপাধির পিছনে সঠিক কারণ কী ছিলো, তা জানা যায়নি। নবকুমারের পুত্র জগদীশ চক্রবর্তী জামগ্রাম জমিদারবাড়ীর নায়েব ছিলেন। এই সময় থেকেই কুলদেবী সিংহবাহিনীর নিত্যনৈমিত্তিক সেবায় কিছু নিয়ম আরোপিত হয় এবং শারদোত্সবে সিংহবাহিনীর সাথে সাথে মৃন্ময়ী সপরিবার দুর্গাপ্রতিমা আরাধনা শুরু হয়।
বর্তমান প্রজন্মের যেসকল প্রতিনিধি রয়েছেন, তাঁরা কমবেশি প্রত্যেকেই স্বর্গীয় জগদীশ চক্রবর্তীর প্রবর্তিত নিয়ম যথাসাধ্য পালন করে চলেছেন। প্রত্যহ চারদফায় দেবীর নিত্যসেবা হয়। এখন দেবীর নিত্যপূজা বা শারদীয়া দুর্গোত্সব সবই পালাভিত্তিক ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। চক্রবর্তী পরিবারের সংবত্সরকালে সিংহবাহিনী সেবায় একটিই মাত্র বিশেষত্ব লক্ষ্যনীয়। শারদীয়া শুক্লাষষ্ঠীর সন্ধ্যায় দেবী নিজের ঘর থেকে দুর্গাবাড়ীতে এসে বসেন। এরপর বিজয়াদশমী অব্দি দেবী এখানেই থাকেন। ষষ্ঠীর সন্ধ্যা থেকে বিজয়াদশমীর সকাল অব্দি দেবীর যথাবিহিত স্নান, পূজা, ভোগ, আরতি হলেও শয়ন হয়না। একটানা তিনরাত্রি-তিনদিন দেবী দণ্ডায়মান অবস্থায় পূজা গ্রহণ করেন।
বিজয়াদশমীর সকালে ঘট-নবপত্রিকা বিসর্জন হয়ে গেলে তাঁকে নিজের ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিগ্রহের পায়ে ‘কর্পূর সহযোগে সর্ষের তেল’ গময় করে মালিশ করে শয়ন দেওয়া হয়। এই নিয়ম কোজাগরী লক্ষ্মীপূজার আগেরদিন অব্দি চলে। এ’কদিন দেবী শুধু স্নানের জন্যই সিংহাসন থেকে নামেন, স্নান সেড়ে কাপড় পড়ে আবার শয্যায় যান। পারিবারিক বিশ্বাস একটানা তিনদিন-তিনরাত দাঁড়িয়ে থাকায় মায়ের পায়ে ব্যথা। তাই কোজাগরী পূজা অব্দি দেবী সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী অবস্থায় বিশ্রাম নে’ন।
এবারে সিংহবাহিনী বিগ্রহের প্রসঙ্গে আসা যাক। এই বিগ্রহটি অষ্টধাতু নির্মিত। দেবী দশভুজা মহিষমর্দিনী। চালচিত্র সমেত বিগ্রহের উচ্চতা সাড়ে নয় ইঞ্চি। দেবীর পার্শ্বদেবতা রূপে গণেশ এবং কার্তিক রয়েছেন। কিন্তু লক্ষ্মী সরস্বতী অনুপস্থিত। এইপ্রকার অদ্ভুত প্রতিমা আমাদের বঙ্গদেশে প্রায় বিরল। যদিও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে পালযুগীয় কিছু বিগ্রহে মহাদেবীর দুপাশে গণেশ কার্তিকের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও, সেসব মূর্তিতে দেবী ললিতা রূপে বিরাজিতা, তিনি চতুর্ভুজা, সন্তানবত্সলা এবং মাতৃভাবে প্রতিষ্ঠিতা। সেসব বিগ্রহে তাঁর হাতে কোনো আয়ুধ নেই। কিন্তু এই বিগ্রহে, রীতিমতো যোদ্ধা বেশে দেবী মহিষাসুরকে মর্দন করেছেন। পাল/সেনযুগীয় বিগ্রহের সাথে এই বিগ্রহের একটিই সাদৃশ্য যে, কোনোক্ষেত্রেই দেবীর সাথে লক্ষ্মী ও সরস্বতী নেই।
এখানেই বিশেষজ্ঞদের কাছে জিজ্ঞাস্য, তবে দুর্গাদেবীর ‘সপরিবার বিগ্রহে’ লক্ষ্মী সরস্বতীর আনয়ন বা আরাধন ঠিক কোন সময় থেকে শুরু হয়! চক্রবর্তী পরিবারের সিংহবাহিনী বিগ্রহের একটি গঠনগত বিশেষত্ব গণেশ, কার্তিক এবং মহিষমর্দিনী এনাদের তিনজনই মূল ধাতব বেদীতে খিলানকব্জার সাহায্যে আটকানো অর্থাত্, এনাদের আলাদা করে খোলা যায়।
লিখেছেন-অর্ণব ঘটক।