একটা সময় ছিল যখন ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙ্গালীর বড় মন ছিল । এক সময়ে মানুষ বলেছিল, বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ। তখন মানুষ লক্ষ্মীর যে – পরিচয় পেয়েছিল সে তো কেবল ঐশ্বর্যে নয়, তাঁর সৌন্দর্যে। তার কারণ, বাণিজ্যের সঙ্গে তখন মনুষ্যত্বের বিচ্ছেদ ঘটে নি। তাঁতের সঙ্গে তাঁতির, কামারের হাতুড়ির সঙ্গে কামারের হাতের, কারিগরের সঙ্গে তার কারুকার্যের মনের মিল ছিল। এইজন্যে বাণিজ্যের ভিতর দিয়ে মানুষের হৃদয় আপনাকে ঐশ্বর্যে বিচিত্র করে সুন্দর করে ব্যক্ত করত। সেই সময় ব্যবসায় লাভ করার জন্য বাণিজ্যে লক্ষ্মীকে আনার জন্য যেরকম লক্ষ্মী, গণেশ ,নারায়ণের এবং কুবেরের পূজা করা হত…. তার সঙ্গে বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় গন্ধেশ্বরী
দেবীর পূজা করা হত। সিংহবাহিনী দেবী গন্ধেশ্বরী হলেন সাক্ষাৎ ভগবতী দুর্গা।
মা গন্ধেশ্বরী মা দুর্গারই একটি অংশ প্রকাশ । তিনি চতুর্ভুজা । দেবী গন্ধেশ্বরীর ধ্যান মন্ত্রে বলা হয়- “দুর্গা দুর্গতিহারিণী ভবতু নঃ” – অর্থাৎ – হে দেবী, আপনি আমাদের নিকট দুর্গতিহারিণী দুর্গাস্বরূপা হোন । দুর্গতিহারিণী দুর্গা রূপে আমাদের দুঃখ বিনাশ করুন । দেবী গন্ধেশ্বরীর ধ্যান মন্ত্র অনুযায়ী তিনি সিংহারূঢ়া , ললাটে চন্দ্রকলাযুক্তা , মরকত মণি তুল্য প্রভাময়ী, চারি হস্তে শঙ্খ, চক্র, ধনুর্বাণ ধারিনী, ত্রিনয়না, কেয়ূর- হার- বলয় – শব্দায়মান চন্দ্রহার ও নূপুর পরিহিতা । তিনি উজ্জ্বল কর্ণ কুণ্ডল ধারিনী । এই দেবী আমাদের দুর্গতি নাশ করেন ।
মা গন্ধেশ্বরী মূলতঃ বৈশ্য বণিক শ্রেনীর দ্বারা আরাধিতা । গন্ধবণিক গণ এই দেবীর পূজা প্রচলন করেন । বৈশাখী পূর্ণিমাতে বাণিজ্যে শ্রীবৃদ্ধির জন্য বৈশ্য বণিক সম্প্রদায় এই দেবীর আরাধনা করেন ।
প্রাচীনকালে বণিক গন ময়ূরপঙ্খি ভাসিয়ে চলতেন বাণিজ্যে। পথে যেমন ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা ইত্যাদি আশাঙ্কা ছিলো- তেমনি ডাকাত, বন্য জীব জন্তুর ভয় ছিলো। সমস্ত ভয় সমস্ত দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন মা দুর্গতিনাশিণী, ভয়হারিনী অভয়া মা দুর্গা । তাই বণিক শ্রেনী এই দেবীর আরাধনা করেন ।
গন্ধাসুর নামক এক দস্যুর হাতে বণিকেরা প্রায়শঃই ধন সম্পত্তি হারাতেন । পরবর্তীতে বণিক শ্রেনীগন মা গন্ধেশ্বরীর পূজা করেন। মা গন্ধেশ্বরী এই ডাকাতকে বধ করলে বণিকেরা নির্ভয়ে যাত্রা করতে পারতেন। গন্ধেশ্বরী পূজার পেছনে এমন একটি লৌকিক কাহানী আছে । দেবী নানান অলঙ্কার ধারন করেন- যা এই বাণিজ্য মারফৎ উৎকর্ষ বা শ্রীবৃদ্ধির প্রতীক । দেবী মরকত বর্না । তপ্তকাঞ্চন ও মরকতের বর্ণ এক। অর্থাৎ বাণিজ্য দ্বারা বণিক শ্রেনীর উন্নতি তথা সম্পত্তি প্রাপ্তির প্রতীক ।
বিশেষত এই সিংহবাহিনী দেবী গন্ধেশ্বরী পূজা শিবপুর অঞ্চলের একটি অন্যতম ও উল্লেখযোগ্য পূজা। বৈশ্য সম্প্রদায়ের গৃহে অনেকেই এনাকে কুলদেবী রূপে পূজা করতেন , এখনো কিছু স্থানে হয়।
একটা সময় প্রত্যেক বাড়িতে থাকত জাবদা একটা পাঁজি বা পঞ্জিকা। মা ঠাকুমারা সেই জাবদা পঞ্জিকা খুলে একাদশী, পুনির্মা , পুজো পার্বন ইত্যাদি দেখতেন, আর ঠাকুর মশায় এসে তিথি নক্ষত্র ইত্যাদি নির্নয় করতেন। তো সেই বৃহৎ কাঠের ব্লকে ছাপা পঞ্জিকায় ,পরে মেশিনে ছাপা পঞ্জিকায় নানা রকমের চমৎকার বিজ্ঞাপন থাকতো । আর কি থাকত ? আর থাকত উডকাঠের কয়েকটি দেবদেবীর মূর্তি । যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দেবী গন্ধেশ্বরী এবং দেবী জগদ্ধাত্রীর ছবি। উভয় দেবীই সিংহবাহিনী এবং চতুর্ভূজা ।
যাঁরা জানেন না বা ছোটরা দুই মূর্তিতে গুলিয়ে ফেলতেন বা এখনো ফেলেন বুঝি। দেবী গন্ধেশ্বরীর সিংহের ডান পায়ের উঁচু করা থাবা থাকে একটা গোল বলের উপর আর দেবী জগদ্ধাত্রীর সিংহের থাবা থাকে একটি কর্তিত হস্তী মুন্ডের উপর।তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র, ধনুক ও বাণ; গলায় নাগযজ্ঞোপবীত। বাহন সিংহ করীন্দ্রাসুর অর্থাৎ হস্তীরূপী অসুরের পৃষ্ঠে দণ্ডায়মান। দেবীর গাত্রবর্ণ উদিয়মান সূর্যের ন্যায়।
বণিক বা বেনেরা বাঙালি ট্রেডিং ক্লাস, বৈশ্য বর্ণ, বাংলায় বণিক চার ধরণের সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, কংসবণিক আর শঙখবণিক, গন্ধবণিকরা ছিল এদের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চশ্রেণীর কারণ তারা স্পাইস ট্রেড আর আতরের ব্যবসায় করত, চাঁদ সদাগরকে গন্ধবণিকদের আদিপুরুষ বলা হয়, তবে ব্রিটিশ আমলে সুবর্ণবণিক রা যতটা লাইমলাইট পায় সেটা গন্ধবেনেরা পায় নি।
সুবর্ণবণিকদের উপর বই পাবে গন্ধবণিকদের উপর আমি খুঁজে পাইনি, আর হ্যাঁ এই বেনেরা আগে একটা বড় অংশই ছিল বৌদ্ধ, মধ্যযুগে তারা হিন্দু সমাজে যুক্ত হয়, আর তার সাথে তাদের আরাধ্য দেবতারাও, গন্ধবণিক দের কুলদেবী গন্ধেশ্বরী, বাঁকুড়ায় গন্ধেশ্বরী নদীর ধারে আদি বাস ছিল গন্ধবণিক দের,
আমার জানা মতে এটি আসলে সুগন্ধ বনিক। এরা নবশাখ শুদ্রশ্রেণির মধ্যে পড়ে।এরা দাবী করে যে মনসামঙ্গল কাব্যের চরিত্র চাঁদ সদাগর এদের পূর্বপুরুষ। এদের প্রাচীন জাত ব্যবসা হলো বেনে মশলার কারবার।
আমাদের এলাকায় রম পদবির এই মানুষেরা বাস করেন। এছাড়াও হালদার, কুণ্ডু ও নাগ ইত্যাদি এই শ্রেণির পদবি।
অনন্তকোটি-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিকারিণী ব্ৰহ্মশক্তি দেবী মানবীকে নীলাম্বরে সুখাসীনা দেখলেন এবং তাঁরই শ্ৰীমুখ হতে তাঁর মহিমাবাণী শ্রবণ করলেন –
“অহং রাষ্ট্ৰী সংগমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাং
* * *
ময়া সোহান্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্ ৷
অমন্তবো মাং ত উপক্ষীয়ন্তি শ্রুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি ৷৷
* * *
যং যং কাময়ে তং তমুগ্ৰং কৃণোমি
তং ব্ৰহ্মাণং তমৃষিম্ তং সুমেধাম্ ৷” – [ঋক্, দেবীসুক্ত]
“আমিই সমগ্র জগতের রাজ্ঞী, আমার উপাসকেরাই বিভূতিসম্পন্ন হয়; আমিই ব্ৰহ্মা এবং ব্ৰহ্মজ্ঞানসম্পন্না, সকল যজ্ঞে আমারই প্রথম পূজাধিকার; দর্শন, শ্রবণ, অন্নগ্ৰহণ ও শ্বাসপ্রশ্বাসাদি প্ৰাণিজগতের সমগ্ৰ ব্যাপার আমার শক্তিতেই সম্পাদিত হয়; সংসারে যে কোন ব্যক্তি শুদ্ধভাবে আমার উপাসনা না করিয়া আমার অবজ্ঞা করে, সে দিন দিন ক্ষীণ ও কালে বিনষ্ট হয়; হে সখে, অবহিত হইয়া যাহা বলিতেছি শ্রবণ কর – শ্রদ্ধার দ্বারা যে ব্ৰহ্মবস্তুর সন্দর্শন লাভ হয়, আমিই তাহা; আমার কৃপাতেই লোকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে; আমার কৃপাকটাক্ষেই পুরুষ – স্রষ্টা, ঋষি এবং সুক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন হয় ।”
ভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকুলে নারীর পূজার প্রথম প্রচার । উপনিষদ-প্ৰাণ ঋষি দেবীমহিমা প্ৰাণে প্ৰাণে প্ৰত্যক্ষ অনুভব করে গাইলেন –
“অজামেকাং লোহিত শুক্লকৃষ্ণাং
বহ্বীঃ প্ৰজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ ৷
অজো হ্যেকো জুষমাণোহনুশেতে
জহাত্যেনাং ভুক্তভোগামজোহন্যঃ ॥”- [শ্বেতাশ্বতর]
“শুক্লকৃষ্ণরক্তবর্ণা সত্ত্বরজাস্তমোগুণময়ী, অনন্যসম্ভবা এক অপূৰ্বা নারী অনন্যসম্ভব এক পুরুষের সহিত সংযুক্ত থেকে আপনার অনুরূপ বহু প্রকারের প্রজাসকল সৃজন করছেন” – ইত্যাদি ।
আত্মস্বরূপে বর্তমান দেবীমহিমা প্ৰত্যক্ষ করিয়াই তিনি শিক্ষা দিলেন – “ন বা অরে জায়ায়ৈ কামায় জায়া প্ৰিয়া ভবত্যাত্মনস্তু কামায় জায়া প্ৰিয়া ভবতি ।” – [বৃহদারণ্যক, ৬ষ্ঠ অধ্যায়, ৫ম ব্ৰাহ্মণ, ৬]
“জায়ার ভিতরে আত্মস্বরূপিণী দেবী বর্তমানা বলেই জায়াকে এত প্রিয় বলে বোধ হয় ।”
ঋষিদিগের পদানুসরণে কৃতাৰ্থ হয়ে মনু আবার গাইলেন –
“দ্বিধাকৃত্বাত্মনো দেহমর্দ্ধেন পুরুষোহভবৎ ৷
অৰ্দ্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্ৰভুঃ ॥” – [মনুসংহিতা ১-৩২]
সৃষ্টিপূর্বে ঈশ্বর আপনাকে দুইভাগে বিভক্ত করিয়া এক অংশে পুরুষ এবং অপরাংশে নারীমূর্তি পরিগ্রহ করলেন । অতঃপর বিরাট ব্রম্ভাণ্ড সেই নারীর দেহ ।”
“যত্ৰ নাৰ্য্যস্তু পূজ্যন্তে নন্দন্তে তত্র দেবতাঃ ৷
যত্ৰৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সৰ্বাস্তত্ৰাফলাঃ ক্রিয়াঃ ৷৷”
“যে গৃহে নারীগণ পূজিত হন, সেই গৃহে দেবতাসকলও সানন্দে আগমন করেন; আর যে গৃহে নারীগণ বহুমান লাভ না করেন, সে গৃহে দেবতাদিগের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদি কোন ক্রিয়াই সুফল প্রসব করে না ।”
এইরূপে ভারতের ঋষিকুলই জগতে নারীমহিমা প্ৰথম অনুভব ও প্রচার করলেন । জগৎ নির্বাক ও উদ্গ্রীব হয়ে তাঁদের সেই পুতবাণী শ্রবণ করল – মোহিতচিত্তে নারীপ্রতীকে মাতৃপূজার, দেবীপূজার, তাঁদের সেই আয়োজন দেখতে থাকল এবং মুগ্ধ হয়ে তাঁদের যথাসম্ভব পদানুসরণ করতে কৃতসঙ্কল্প হল ।
হে দেবী মানবি ! এইরূপে ভারতই তোমার দেবীমূর্তির নিষ্কাম পূজা জগতে প্ৰথম করে ধন্য হল – সকলের শীর্ষস্থান অধিকার করল ! ভারত সেই দিন হতেই তোমায় কুলদেবীরূপে গৃহে গৃহে পুজা ও সম্মান করতে থাকল ।
তিনি জয়দুর্গা, জগদ্ধাত্রী, গন্ধেশ্বরী, বনদুর্গা, চণ্ডী, নারায়ণী প্রভৃতি নামে ও রূপে পূজিতা। তিনিই অভয়ামঙ্গল বনদেবী যা ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের অরণ্যানী স্তবের সাথে সম্পৃক্ত। চন্ডীমঙ্গলের কালকেতু-আখ্যানে তিনি দ্বিভূজা, তাঁর প্রতীক মঙ্গলঘট, পূজার উপচার মাঙ্গল্য ধানদূর্বা।তিনি পশুমাতারূপে পূজিতা।
ওঁ জয় ত্বং দেবি চামুণ্ডে জয় ভূতাপহারিণি।
জয় সর্বগতে দেবি কালরাত্রি নমোঽস্তু তে।।
হে দেবী চামূণ্ডা, তোমার জয় হোক। হে দেবী, তুমি জীবের দুঃখনাশকারিণী; তুমি সর্বভূতে অবস্থিতা; আবার তুমিই প্রলয়ের অন্ধকার স্বরূপিণী কালরাত্রি। তোমায় নমস্কার করি।
জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তু তে।।
হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দুর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি।
বিষ্ণুঃ শরীরগ্রহণম অহম ঈশান এব।
কারিতাস্তে যতোহ্তস্ত্বাং কঃ স্তোতুং শক্তিমান ভবেৎ।।
সা ত্বমিত্থং প্রভাবৈঃ স্বৈরুদারৈর্দেবী সংস্তুতা।
মোহঐতৌ দুরাধর্ষাবসুরৌ মধুকৈটভৌ।।
প্রবোধং চ জগৎস্বামী নিয়তাং অচ্যুতো লঘু।
বোধশ্চ ক্রিয়তামস্য হন্তুং এতৌ মহাসুরৌ।।
বিষ্ণুর শরীর গ্রহণ করে
তুমি-ই সব করো, তোমার স্তুতি করে কতজন শক্তিমান হয় ।।
তোমার প্রভাবে দেবী ,থামাও তুমি এই প্রায় অপরাজেয় অসুরদের।
মোহাচ্ছন্ন করে দাও দুই দুর্ধর্ষ অসুর মধু আর কৈটভকে ।।
জগৎস্বামী (বিষ্ণুকে) তুমি তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙ্গিয়ে জাগিয়ে তোল ।
আনো তাঁকে সেই বোধে যাতে তিনি ধ্বংস করেন এই দুই মহা অসুরকে ।।