দায়িত্বজ্ঞানহীন-বিদেশীশক্তি কখনও অনুকূল অবস্থায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে দেশবাসীর হাতে প্রত্যার্পণ করে যায় না; ঠ্যালার পড়েই যায়। দেশবাসীর সমবেত চেষ্টায় তা সকলের উপযোগী করে গড়ে নিতে হয়। ‘গড়ে নেবার বেলায়’, শরণার্থীদের নরক যন্ত্রণার মাঝে যারা ধ্বংসাত্মক উগ্র রাজনীতির আয়োজন দেখেন, ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের রাজনৈতিক ঢাল করে তোলেন, তারা আর যাইহোক দেশ গড়তে চান না, কেবল ‘ইজম’ গড়তে আসেন; মানুষকে ভর্তুকিজীবী বানাতে বসেন। তারা রাষ্ট্রের বন্ধু-রাজনীতিবিদ কিনা দু’বার ভাবতে হবে। ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ বলে আমরা দেশ গঠনের কর্তব্যে অবহেলা দেখাতে পারি না। যদি সত্য-সম্পর্কে দেশ গঠনে সামিল না হয়ে স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে বুভুক্ষু মানুষের ফাইল চিত্র পার্টির সংবাদপত্রে তুলে ধরি এবং ‘বিশ্বনাগরিক’ হয়ে সন্ত্রাসী-অনুপ্রবেশকারীর পরিত্রাতার হয়ে কথা বলতে থাকি, তবে ‘দেশ নামক ফুটো কলসি’-টি উন্নয়নের জলে পূর্ণ হবে না কখনও৷ “আগে দিয়ে বেড়া/তবে ধরো গাছের গোড়া” — এটিই দেশ-মালঞ্চের মূলমন্ত্র। দেশের মাটি থেকে আগাছা যেমন সরাতে হবে, দেশ ও জাতির প্রকৃত কল্যাণে সামিলও হতে হবে। দেশবাসীর উপলব্ধিতে সেটাই Felt এবং unfelt need.
স্বাধীনতা-হীনতায় আমরা কেউ-ই স্বচ্ছন্দ বোধ করি না, ভালোও থাকি না। কবি রঙ্গলাল বন্দোপাধ্যায় লিখছেন, “স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,/কে বাঁচিতে চায় ?/দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,/কে পরিবে পায়।।” বিদেশী শাসনে থাকে শোষণ, দ্বিচারিতা, বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা। তা পাঠান-মোঘলের শাসনই হোক, অথবা ব্রিটিশ-ইংরেজ। স্বাধীনতা-হীনতাকে নরকের সমতুল্য বলেছেন রঙ্গলাল। শ্রীরামকৃষ্ণ একবার নরেন্দ্রনাথকে বলেছিলেন, “মনে রাখিস ইংরেজরাই এদেশের সর্বনাশ করছে।” স্বামীজির কণ্ঠেও শোনা যায়, “তারা আমাদের গলায় পা দিয়ে থেঁতলেছে, নিজেদের সুখের প্রয়োজনে আমাদের শেষ রক্তবিন্দু চুষে খেয়েছে, লুঠে নিয়ে গেছে আমাদের লক্ষ লক্ষ টাকা।”
বাইরের একটা শক্তি যে আমাদের ওপর চেপে বসেছিল, তার কারণ দেশের মধ্যেই ছিল একটা অবিরল অনৈক্য। ‘ভারতীয় জাতি’ বলে তখন কিছু দানা বাঁধে নি। হতাশ ছিলেন রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে লিখতে হয় ‘A nation is making’; যার মোদ্দা কথা হল জাতি তৈরি নয়, জাতি তৈরি হচ্ছে। এমন জাতি কিভাবে স্বরাজ অর্জন করবে? স্বামীজি বলছেন, স্বাধীনতা, সে তো কালই আসতে পারে, কিন্তু দেশবাসী কি তার জন্য প্রস্তুত? প্রায় একই কথা রবীন্দ্রনাথও বলছেন, “স্বদেশকে ভেতর থেকে তৈরি করে তোলবার সাধনা চাই।” ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকে ধনঞ্জয় বৈরাগীকে দিয়ে বলাচ্ছেন, “ভেতর পাকানোর ব্যবস্থাই হয় নি, শুধুই বাইরে থেকে প্রলেপ চাপানো।” নেতাজী বলেছিলেন, রাজনৈতিক স্বরাজ নয়, চাই স্বদেশী স্বরাজ, তা না হলে ভারতবর্ষ ইউরোপীয় চিন্তার লীলাভূমিতে পরিণত হবে।
এখন জাতি গঠন কিভাবে হবে? পথ বাতলেছেন স্বামীজি, “তোমাদের মধ্যে মানুষ কোথায়? আগে মানুষ তৈরি কর। তারপর স্বাধীনতার কথা ভাব।” তার মানে সেবক তৈরি না করে স্বাধীনতার কথা ভাবা উচিত নয়। বলেছেন, “আগামী পঞ্চাশ বৎসর আমাদের গরীয়সী ভারতমাতাই আমাদের আরাধ্য দেবতা হউন, অন্যান্য অকেজো দেবতা এই কয়েক বৎসর ঘুমাইলে কোন ক্ষতি নাই।” আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই সমস্ত মনীষীরা ভেতর থেকে ভারতবাসীকে শক্তি যোগাচ্ছেন। ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ রচনায় বিবেকানন্দ ইংরেজদের বিরুদ্ধে লিখছেন, “তুমি যদি বলবান নিজেকে ভাবো, ওটা কল্পনা, ভারতেরও বল আছে… এইটি প্রথম বোঝ।” একই বক্তব্যে রবি ঠাকুর গান বাঁধলেন: “বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান/তুমি কি এমনি শক্তিমান?” লিখলেন, “শাসনে যতই ঘেরো/আছে বল দুর্বলেরো/হও না যতই বড়/আছেন ভগবান।/আমাদের শক্তি মেরে তোরা ও বাঁচবি নেরে/বোঝা তোর ভারী হলে ডুববে তরি খান।”
ব্রিটিশ শাসনে দেশবাসী বৈষম্যের স্বীকার হয়েছিল। সাদা চামড়া — কালো চামড়া। তারও আগে মোঘল আমলে ধর্মীয় বৈষম্য প্রবল ছিল। তাই রামমোহনের যুগ থেকে বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে প্রকটিত হল ভারতের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ঘটনাচক্রে তা ছিল হিন্দু-জাতীয়তাবাদ। ঊনিশ শতকে মননে, আকাঙ্ক্ষায়, চিন্তায় এল মস্ত বড় চৌম্বক ঢেউ। সমাজের মধ্যে উত্তাল হল তার প্রবাহ, তার গতি। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেল বিশ শতকে গিয়ে; তা গেল জাগরণ ও বিস্ফোরণের পর্যায়ে। তারপর এলো অগ্নিময় অধ্যায়। অহিংস-সহিংস-আধ্যাত্মিক-বৌদ্ধিক নানান ধারায় তা পরিপুষ্টি লাভ করল। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে ডাক দিলেন, বিজ্ঞানের কাজ থেমে থাকতে পারে, কিন্তু স্বরাজের কাজ নয়।
ইতিহাস শিক্ষা দেয় সত্যের কুসুমকলি সংগ্রহ করতে। কিন্তু ইতিহাসবিদের মধ্যেও যে ‘ভূয়ো’ মানুষ রয়েছেন অজস্র এবং তাদের ‘মেন্টর’! তারা মনগড়া ইতিহাস লেখেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এইভাবে নানান মতাদর্শের ঐতিহাসিক স্পর্শে বহুধা খণ্ডিত হল। তবুও বানানো ইতিহাসের মধ্যে আমরা খোঁজ পেয়ে গেছি আসল ইতিহাসের রূপ। সে বিতর্কে না গিয়ে আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে আমরা সমস্ত মুক্তি-সন্ধানী বীরযোদ্ধাদের যথাযোগ্য স্মরণ করতে চাই। কিন্তু যে কথা না বললে বক্তব্য অসম্পূর্ণ থেকে যাবে তা হল — রাজনৈতিক বন্ধন থেকে কেবল মুক্তি নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বন্ধনমুক্তি ছাড়া অখণ্ড স্বাধীনতার স্বাদ সম্ভব নয়। সে কাজ ইদানীং শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে বলেই ভূয়ো দেশপ্রেমিকরা গর্ত থেকে বেরিয়ে বিরোধিতার রাস্তায় যাচ্ছেন। যারা মনে করেন: দেশপ্রেম হচ্ছে অতি জাতীয়তাবাদ এবং একটি বিষাক্ত মানসিকতা — তাদের সঙ্গে একমত হওয়া চলে না।
“শৃণ্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ”। সমগ্র বিশ্বকে নিয়ে ভাবনাচিন্তার রসদ আছে বৈদান্তিক ভারতবর্ষে। সমগ্র পৃথিবীকে সঙ্গে নিয়ে মানব সম্পদের সাধারণ তহবিল — এ ভারতবর্ষই বলে এসেছে, এরজন্য পাশ্চাত্যের ‘ইজম’ দরকার নেই। ভারতবর্ষের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে আছে উন্নয়নের উপযুক্ত পুষ্টি, বিকাশের অজস্র সূত্র। অন্ধ ভিখারি সেজে যারা তা না দেখতে চান, তাদের হেড কোয়ার্টার ভারতবর্ষে অন্তত নেই।
ভারতবর্ষে এখন যেটা প্রয়োজন, তা হল ভেতরের পাপ সরানো — দেশের মধ্যে লালিত দীর্ঘদিনের পাপ, ভ্রান্ত ইতিহাসের পাপ, ভারত বিরোধী মানুষের যাবতীয় মনের পাপ; তাদের অকৃপণ বীভৎসতার পাপ। সন্ত্রাসবাদ আমরা চাই না, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চাই না, আবার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলে চালানো মায়াবাদও চাই না। যে রাজ্যে একটা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে শাসক দলের হাতে ৪৩ জন বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থক খুন হয়ে যান, সে রাজ্য কী আদৌ স্বাধীন ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত? যে রাজ্যে প্রতি পদে সাধারণ মানুষ এবং বিরোধী দল গণতান্ত্রিক অধিকার হারায়, সে রাজ্য কী স্বাধীন দেশের অন্তর্ভুক্ত? যে রাজ্যে দেশ বিরোধিতার শিকড় বহুদূর বিস্তৃত, অথচ সে টুঁ-শব্দটি নেই বুদ্ধিজীবীদের, সে কী ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত? সর্বকথামালায় কেন্দ্রের বিরোধিতা করা, অখণ্ডতা-বিরোধীদের শক্তিমান করার খেলা ভারতবর্ষেই হয়। তাই হিন্দু নিধনযজ্ঞের দিন ‘খেলা হবে দিবস’ পালিত হয় এই ভারতবর্ষেরই একটি অঙ্গরাজ্যে। তাদের কথার জাগলারিতে না ভোলাই ভালো। তারা অধিকারের নামে মানুষ খেপাতে চান। সার্বভৌমত্বের পরিবর্তে ‘ইজম’-এর আন্তর্জাতিকতা চান। ইজম-পসন্দের আগ্রাসনে ভারতবর্ষের মাটিতে জেহাদ নামিয়ে আনাটাই তাদের মূল লক্ষ্য। কথার শব্দজব্দে, ইজমের বাক্সে ভারতের স্বাধীনতাকে বন্দী করতে চান তারা।
বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশে তার সার্বভৌমতা, অখণ্ডতা বজায় রেখে গড়তে হবে মানবিক সম্পদ। ভারতমাতার কাছে প্রার্থনা চাই, ‘মানুষ’ করে তোলার, ‘ভারতবাসী’ করে তোলার। যে, যে কাজটি করছেন, তাকে অন্তর থেকে মান্যতা দিন, দিন তার ভালবাসা, দিন তার নান্দনিকতা। কী Production, কী Education, কী Arts, কী Sports, কী Politics – সর্বত্র। খোঁজ নিন নিজ অন্তঃপুরে, নিজের বিবেক যেখানে রাজত্ব করছে। Each soul is potentially free, আমরা প্রত্যেকেই মুক্ত। আমরা বিবেকের বন্ধনেই কেবল আবদ্ধ। চাই জীবনের সর্বক্ষেত্রে স্বাধীনতা — মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বৌদ্ধিক জগতের স্বাধীনতা, অন্তরাত্মার স্বাধীনতা। কিন্তু স্বাধীনতার অপব্যবহার রোধ করাটা তার চেয়েও জরুরি; ওখানেই যত কুমির হাঙ্গরের দল বসে আছে। নিশ্চয়ই সুনিশ্চিত করতে হবে অন্তেবাসী-প্রান্তবাসী মানুষের স্বাধীনতার দাবী। নারী স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ করা যাবে না। তবে স্বাধীনতা রক্ষার সব চাইতে বড় অস্ত্র হল ব্যক্তি সততা, দেশের প্রতি সততা, জাতির প্রতি সততা, রাজনৈতিক সততা। সততাই যথার্থ দেশপ্রেম। আমরা সেই দেশপ্রেমে বুঁদ হতে চাই। অধিকার আদায়ের নামে দেশপ্রেম-উৎপাটন করা এবং দেশকে দেউলিয়া করার ভণ্ডামি ভালো নয়। দেশীয় সুরক্ষা মঞ্চ থেকে পালিয়ে কৌশল পার্টি অফ ইণ্ডিয়ার বুজরুকি এবার ত্যাগ করতে হবে। মানুষ এই দুষ্ট-রাজনীতি ধরে ফেলেছে।
কল্যাণ গৌতম।