ইতিহাসের গতি স্বয়ংক্রিয় নয়। এই গতি নির্ধারণ করে মানুষ। এ কারণে ইতিহাস হলো সচেতচন কর্মপ্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি। আবার ইতিহাসের গতিপথে ব্যক্তির ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গেলে তার সামগ্রিক ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে তা করা প্রয়োজন। সামগ্রিক ভূমিকার একটি খণ্ডিত অংশকে নিয়ে যারা বার বার কোনো ব্যক্তির ভূমিকাকে বিশ্লেষণ করতে চায় তাদের একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় সাভারকরকে নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি করা হয় তার পিছনেও রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য। কেবল সাভারকরকে ছোটো করার উদ্দেশ্য নিয়েই এই বিতর্ক তৈরি করা হয় না। এই বিতর্কের লক্ষ্যই হলো স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি ধারাকে ভুলিয়ে দেওয়া। ভারতের রাষ্ট্রীয় চেতনার ভিত্তি যে জাতীয়তাবাদ তাকে গুরুত্বহীন করা। সর্বোপরি হিন্দুত্ব যে ভারতের জাতীয় চেতনার ভিত্তি হতে পারে তাকেও যতটা সম্ভব ছোটো করা। তাতে ঐক্য নয়, বৈচিত্র্যের দিকটি বেশি করে তুলে ধরা হয়। এতে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষত দেশভাগের সময় বামপন্থীরা যে কদর্য ভূমিকা পালন করেছিল তাকে ধামাচাপা দেওয়া যাবে। অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও দেশভাগ ও তৎপরবর্তী সময় লক্ষ লক্ষ হিন্দুর অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশার জন্য কংগ্রেস তার দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না। উপরন্তু স্বাধীনতার পরবর্তী দু’দশকের মধ্যেই গোটা কংগ্রেস দল ঢুকে পড়ে পরিবারতন্ত্র এবং চাটুকাকিতার আবর্তে। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেহরু পরিবার ছাড়া আর কারোর গুরত্বকে তুলে ধরার (একমাত্র ব্যতিক্রম গান্ধীজী) প্রয়োজন বোধ করেনি তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের মদতপুষ্ট ঐতিহাসিকরা। সাভারকরের কৃতিত্বকে চাপা দেওয়া এবং ভূমিকাকে ছোটো করে দেখানো হয় একটি সুনির্দিষ্ট মতলব নিয়েই।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ভারতীয় সমাজ ও জাতীয়তার গঠনে বিনায়ক দামোদর সাভারকরের অবদান কেবল গুরুত্বপূর্ণই নয়, এর বিভিন্ন দিক এখনো জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকদের চর্চার বিষয়বস্তু। সাভারকরের বিরুদ্ধে বাম ও কংগ্রেসের অনুগ্রহপুষ্ট ঐতিহাসিকদের সমালোচনা মূলত দুটি খাতে প্রবাহিত হয়। প্রথমত, এদের অভিযোগ অনুযায়ী সাভারকর একজন হিন্দুত্ববাদী। কেবল হিন্দুত্ববাদীই নয়, তাঁর। ভাবনাচিন্তায় নাকি আগ্রাসী হিন্দুত্ববাদের সন্ধান পাওয়া যায় যা বৈচিত্র্যময় বহুজাতিভিত্তিক দেশ ভারতবর্ষের ঐক্যের পক্ষে বিপজ্জনক। সাভারকর-কল্পিত ভারতে সংখ্যালঘুদের স্থান নেই। হিন্দুত্বের আরোপিত ঐক্য দিয়ে বৈচিত্র্যময় দেশ ভারতে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এই ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কিছু পশ্চিমি গণমাধ্যম সাভারকরকে দক্ষিণপন্থী গরিষ্ঠতাবাদী (right wing majoritarian) বলে চিহ্নিত করেন। সাভার করের বিরদ্ধে বাম-কংগ্রেসি ইতিহাসবিদদের দ্বিতীয় অভিযোগ হলো তার দেশপ্রেম নিয়ে। এখানে সমালোচনার প্রধান কারণ আন্দামানের সেলুলার জেলে থাকার সময় সাভারকর একাধিকবার (মোট ৪ বার) নাকি ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছ ক্ষমাভিক্ষা করছেন এবং শর্তসাপেক্ষে ছাড়া পান। সুতরাং তাঁর দেশপ্রেম নিয়ে এবং পরে স্বাধীনতা আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা যায়। এই অভিযোগগুলো শুধু বামপন্থী ও কংগ্রেস সমর্থক ইতিহাস লেখকদের নয়, বামপন্থী দলগুলি এবং কংগ্রেসের নেতারাও একই ধরনের অভিযোগ করেন। সম্ভত এই সমস্ত ইতিহাস লেখকের ভাবনাকে জনগণের চোখে বৈধ প্রতিপন্ন করতে।
ইতিহাসের গতিপথে কোনো ব্যক্তির ভূমিকা বিশ্লেষণ করতে গেলে তাকে তার সময় দিয়েই বিচার করা উচিত এবং যতটা সম্ভব নির্মোহভাবে। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতীয় রাজনৈতিক চিন্তার ইতিহাসে হিন্দুত্ববাদের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক বীর । সাভারকর, যার ব্যাখ্যায় হিন্দুত্ববাদ হিন্দুধর্মের গণ্ডি ছাড়িয়ে এক রাজনৈতিক মতাদর্শে উপনীত হয়। বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে অন্যান্য মতাদর্শের উত্থান ও বিস্মৃতির সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রেখে হিন্দুত্ববাদের গঠন (construction) করেন সাভারকর। গড়ে তোলেন আধুনিক হিন্দুত্বের ধারণা। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হয় সাভারকরের হিন্দুত্ব গ্রন্থটি যা দার্শনিক মনীষার অনবদ্য বহিঃপ্রকাশ। এই গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল জেলখানায় এবং প্রকাশিত হয়েছিল ‘জনৈক মরাঠা’ ছদ্মনামে। এই সঙ্গে সাভারকর হিন্দু জাতীয় চেতনার উৎস এবং বিকাশের ধারাটিকে ব্যাখ্যা করেন। পরবর্তীকালে তিনি এবিষয়ে কিছু উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ প্রণয়ন করেন যেমন, হিন্দু রাষ্ট্রদর্শন ও ‘ভারতের গৌরবময় ইতিহাসের ছয়টি স্বর্ণিল অধ্যায়’ প্রভৃতি। সাভারকারের কাছে হিন্দুত্ব নিছক একটি শব্দ নয়, এ এক পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস। হিন্দুত্ব কেবল আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় ইতিহাস নয়। ‘হিন্দুইজমের সঙ্গে হিন্দুত্বের পার্থক্য আছে। ইজম্ শব্দটির অর্থ নির্দিষ্ট কোনো তত্ত্ব বা সূত্র। হিন্দুইজম্ একটি ধর্মীয় শব্দ আর হিন্দুত্ব একটি ব্যাপকভিত্তিক শব্দ যা মূলত রাজনৈতিক এবং এর মধ্যে সামাজির, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তাৎপর্যও বিদ্যমান, সাভাকরের কাছে হিন্দুইজম্ ছিল হিন্দুত্বের একটি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ। এর উৎপত্তিও হিন্দুত্ব থেকে। অর্থাৎ সাভাকরের হিন্দুত্ব ভাবনাটি কেবল ধর্মীয় তাৎপর্যবাহী নয়। ১৯২৩ সালে প্রকাশিত হিন্দুত্ব গ্রন্থে সাভারকর হিন্দু জাতি গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের ভৌগোলিক, জাতিগত এবং ঐতিহ্যগত কারণগুলি নিয়ে আলোচনা করেন। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থান, এর উত্তরে উত্তুঙ্গ হিমালয় পর্বত এবং দক্ষিণে অসীম মহাসাগর ভারতীয় ভূখণ্ডকে স্বাতন্ত্র। দান করেছে। এই স্বাতন্ত্র্যই বহু বছরের প্রক্রিয়ায় গড়ে তুলেছে একাত্ববোধ সম্পন্ন হিন্দু সংস্কৃতি যা হাজার উত্থান-পতন সত্ত্বেও নষ্ট হয়ে যায়নি। হিন্দুত্বের এই দীর্ঘ লালিত একত্ববোধ সর্বসমাবেশকতা তার বড়ো শক্তি। মুসলমান বা খ্রিস্টানরা ধর্মীয় গোষ্ঠী হলেও তাদের কোনো ভৌগোলিক বন্ধন নেই। ফলে একক জাতি হিসেবে গড়ে ওঠা তাদের পক্ষে অসম্ভব। তারা ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ভারতবর্ষ হলো হিন্দুদের পবিত্র পিতৃভূমি, অন্য ধর্মের মানুষরা ভারতকে বাসভূমি হিসবে গ্রহণ করলেও তাদের আনুগত্য এই দেশের প্রতি থাকে না। ভারতের ভৌগোলিক সীমা ছাড়িয়ে তাদের মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও। হিন্দু জাতীয়তাবাদের মতাদর্শ প্রচার করতে গিয়ে সাভারকর হিন্দুত্বের য ধারণা নির্মাণ করেন তার একচি গুরত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত ভিন্ন ভিন্ন সম্প্রদায় বা জীবনধারাগুলিকে এক করে এক বৃহৎ মনোলিথিক বা এক জাতি হিসেবে উপস্থাপনা। পাশাপাশি সাভারকরের ভাবনায় ভারতে উদ্ভূত অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠী যেমন বৌদ্ধ, জৈন ও শিখরাও সমানভাবে সমাদৃত।‘হিন্দু রাষ্ট্রদর্শন গ্রন্থে সাভারকর মন্তব্য করেন যে, হিন্দুধর্ম হলো আসলে একটি সংস্কৃতি যার সঙ্গে এই সমস্ত ধর্মীয় মত ও পথগুলি কোনো না ভাবে সম্পর্কিত। এগুলিকে তিনি‘অবশিষ্ট হিন্দুধর্ম হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। জাতিগত ও সংস্কৃতিগত ভাবে হিন্দুধর্মের সঙ্গে এরাও ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। হিন্দুধর্মের সঙ্গে এদের যতটুকু পার্থক্য আছে তা দূর করা প্রয়োজন। এদের স্বার্থ ও অস্তিত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য ভাবে সম্পর্কিত। এই পথেই ভারতের মতো দেশে এর সর্বসমাবেশক জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলা সম্ভব। সাভারকর তার এই রাজনৈতিক প্রকল্পে মুসলমান বা খ্রিস্টানদের অন্তর্ভুক্ত করেননি। কারণ এদের আনুগত্য রয়ে যায় দেশের বাইরে আরবে বা প্যালেস্টাইনে। যদি তারা ভারতকে তাদের পিতৃভূমি বলে মেনেও নেয়, তবু ভারত তাদের কাছে পবিত্রভূমি নয়। তাদের পবিত্রভূমি ভারতের বাইরে অন্য কোথাও। তাদের যদি হিন্দু জাতির অন্তর্ভুক্ত হতে হয় তাহলে তাদের ভারতবর্ষকে পিতৃভূমি ও পবিত্রভূমি দুটোই মনে করতে হবে। তা না হলে এই দেশ তাদের। হবেনা। হিন্দুত্ব গ্রন্থে তিনি মন্তব্য করেন তাদের যদি ভারতবর্ষে থাকতেই হয় তবে তাদের এটা মানতেই হব যে, ভারতবর্ষ হিন্দুদের দেশ।
হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক প্রবক্তা বীর সাভারকর প্রকল্পিত হিন্দু ভারতে সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব ও ধর্মীয় পরিচয় মুছে দেওয়ার পক্ষপাতী নন, বরং তাদের ধর্মীয় সামাজিক অধিকার বজায় রাখার পক্ষপাতী তিনি। তিনি হিন্দু রাষ্ট্রগঠন গ্রন্থে তাদের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের নিশ্চয়তা প্রদান করার কথা বলেছেন। তাদের ধর্মাচরণের অধিকার নিশ্চিত করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। তারা। হিন্দুদের মতোই সমান অধিকার ভোগ করবে। সংখ্যালঘুরা যেমন তাদের ধর্ম সংস্কৃতির সংরক্ষণ করতে পারবে, হিন্দুরাও তাদের নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারবেন। সংখ্যালঘুদের অনৈতিক স্বার্থে কোনো আপোশ করা হিন্দুদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা আলাদা কোনো সুযোগসুবিধা পাবে না। সাভারকর মনে করতেন তাদের আলাদা কোনও সুযোগসুবিধা দেওয়ার অর্থই হলো এদেশে তাদের আধিপত্য মেনে নেওয়া। এখানেই জওহরলাল নেহরুর ধর্মনিরপক্ষতার ধারণার সঙ্গে সাভারকরের ভাবনার পার্থক্য। নেহরু মনে করতেন ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখার দায়িত্ব শুধুমাত্র এদেশের সংখ্যাগুরু হিন্দুদের। ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে সংখ্যালঘুদের বিশেষ কিছু সুযোগসুবিধা দেওয়া হলেও সংখ্যাগুরুদের তা মেনে নেওয়া উচিত। সাভারকরের অভিমত ছিল সংখ্যালঘু সংরক্ষণের স্বার্থে তাদের ক্রমশ সুযোগসুবিধা দিতে থাকলে সংখ্যগুরু হিন্দুদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। তাতে ব্যাহত হবে দেশ গঠনের কাজ। একটি রাষ্ট্র তখনই শক্তিশালী হতে পারে যখন তার সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এর সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে পারবে। এই কারণেই সাভারকর হিন্দু জাতির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংহতির ধারণাকে গ্রহণ করেন। তার রাষ্ট্রচিন্তা কোনো ধর্মীয় মৌলবাদী ধারণা থেকে উঠে আসেনি। এর পিছনে কাজ করছিল তার গভীর দেশপ্রেম।
সুতরাং সাভারকরের বিরদ্ধে বাম-কংগ্রেসি ইতিহাস লেখক এবং রাজনীতিবিদদের যে প্রধান অভিযোগ অর্থাৎ সাভারকর একজন সাম্প্রদায়িক এবং তার কল্পিত রাষ্ট্র ভাবনায় হিন্দু ছাড়া আর কারো স্থান নেই তা কেবল ভিত্তিহীন নয়, তা চূড়ান্ত ভাবেই দুরভিসন্ধিমূলক। সাভারকরের রাজনৈতিক ভাবনার প্রেক্ষাপট বিচার না করে কেবল কতগুলি অংশ তুলে নিয়ে তার সমালোচনা একদেশদর্শিতার ইঙ্গিত বহন করে। উনিশ শতকের শেষের দিকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে হিন্দু পরিচিতির অনুসন্ধান এবং তা নিয়ে চর্চা শুরু হয়। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে আলিগড়ে স্যার সৈয়দ আহমেদ খাঁর অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল। কলেজ (পরবর্তীকালে আলিগড় মুসলিম। ইউনিভার্সিটি) প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে যে আলিগড় আন্দোলন গড়ে ওঠে তা শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের পরিচিতি প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে পরিণত হয়। এদেশে সাম্রাজ্যবাদী শাসন দীর্ঘায়িত করতে ব্রিটিশরাও ‘বিভক্ত করো ও শাসন করো’নীতি অনুসরণ করে মুসলমানদের এই অন্দোলনকে মদত দিতে থাকে। অন্যদিকে এদেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পর প্রথম আধুনিক শিক্ষার সুযোগ গ্রহণ করলেও ১৯ শতকের শেষে এসে জনজীবন, শিক্ষাক্ষেত্র কিংবা প্রশাসন- সর্বক্ষেত্রে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত হিন্দুরা প্রান্তিক অবস্থানে চলে যেতে থাকে। পালটা, ভারতীয় জাতীয় সংস্কৃতির প্রকল্প নির্মাণের অঙ্গ হিসেবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে হিন্দু পুনর্জাগরণের পরিবেশ সৃষ্টি হয়। জাতীয়তাবাদী ধারণার প্রয়োজনে বিচিত্রগামী ও বহুধাবিভক্ত হিন্দুসমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজ শুরু করে শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্ৰেণী। বিভিন্ন ভাবে বিভক্ত হিন্দু সমাজকে। একটি মনোলিথিক বা একমাত্রিক এককে পরিণত করার উদ্দেশ্যে এর সীমাবদ্ধতাগুলিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয় এবং পশ্চিমি যুক্তিবাদের নিরিখে একে আধুনিক করার চেষ্টা করা হয়। এই ভাবনার তাত্ত্বিক সূচনা ঘটেছিল বঙ্গপ্রদেশে প্রধানত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও স্বামী বিবেকানন্দের। লেখার মধ্য দিয়ে। এই ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে স্বদেশি আন্দোলনের যুগে শ্রীঅরবিন্দ ও মহারাষ্ট্রের বালগঙ্গাধর তিলক তাদের রাজনৈতিক ভাবনা নির্মাণ করে কাজকর্ম পরিচালনা করেন। শ্রীঅরবিন্দ যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণা সৃষ্টি করেন তার ভিত্তি হলো হিন্দু ঐতিহ্য। প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি থেকে ভাবনা গ্রহণ করে সৃষ্টি হওয়া ভারতীয় জাতীয়তাবাদ অরবিন্দের মতে কোনো সংকীর্ণ ধারণা নয়। বরং এর ব্যাপ্তি অনেক বড়ো, যার মধ্যে সকলের স্থান হতে পারে। তিলক তার ধারণা ও রাজনীতির মধ্যে হিন্দুধর্মের গৌরব ও শৌর্যের প্রতীকগুলিকে গ্রহণ করেন। লক্ষ্য ছিল একটিই— এক শক্তিশালী জাতিগঠন যার ভিত্তি হবে হিন্দুত্ব। সাভারকর তার রাজনৈতিক ভাবনার সূচনাপর্বে তিলকের দ্বারা বিশেষ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এভাবেই ঊনবিংশ শতকের শেষ থেকেই হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তা এবং হিন্দু নেশনের ধারণা ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সাভারকরের ভাবনায় এই ধারারই প্রতিফলন ঘটেছে। তার লক্ষ্যই ছিল একটি শক্তিশালী জাতি ও রাষ্ট্রগঠন, তার ভিত্তি হবে হিন্দুত্ব। এই হিন্দুত্ব কেবল ধর্মীয় বন্ধনে আবদ্ধ নয়। ধর্মীয় সীমারেখা অতিক্রম করে তা হয়ে ওঠে একটি আদর্শ, যা দেশ ও জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সাভারকরকে ধর্মীয় সংকীর্ণতাবাদী ও সাম্প্রদায়িক চিহ্নিত করা তাত্ত্বিক দৈন্যের পরিচায়ক। বাম ও কংগ্রেসি ইতিহাস লেখকরা সাভারকরের সমালোচনা করে তাদের তাত্ত্বিক দৈন্যেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন।
সাভারকরের বিরুদ্ধে বাম-কংগ্রেসি ইতিহাস লেখকদের আর একটি অভিযোগ হলো আন্দামান সেলুলার জেলে থাকাকালীন ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমাভিক্ষা করে মুক্তি চাওয়া। তার প্রকৃত দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় এবং তাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী হিসেবে দেখানো হয়। যাঁরা সাভারকরের আত্মজীবনী ‘মাই ট্রান্সপোর্টেশন ফর লাইফ’ পড়েছেন তারা এই দাবি কতখানি ভিত্তিহীন তা বুঝতে পারবেন। এই গ্রন্থে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, আন্দামানে আমি যতটুকু ভালো করতে পেরেছি বা মানুষের মধ্যে যতটুকু চেতনা সঞ্চারিত করতে পেরেছি, স্বাধীন মানুষ হিসেবে ভারতে থাকলে তা করতে পারতাম কিনা সন্দেহ। নিজের স্বাধীনতার জন্য আমি এমন কিছু করতে পারি না যা বিশ্বাসঘাতকতার সমতুল, যাতে দেশের মাথা হেঁট হবে। এই ভাবে স্বাধীনতা পেলে স্বাধীনতার উদ্দেশ্যটাই নষ্ট হয়ে যাবে এবং সেটা হবে অত্যন্ত অনৈতিক কাজ।সাভারকর ছত্রপতি শিবাজীর নীতি ও কৌশল অনুসরণ করতেন। আফজল খাঁর হত্যার সময় কিংবা আগ্রা দুর্গে বন্দি থাকার সময় শিবাজীও বিভিন্ন কৌশল নিয়েছিলেন যার প্রধান লক্ষ্য ছিল শত্রুকে ধোঁকা দেওয়া। নিজের দুর্বলতার সময় পুরন্দরের সন্ধির অপমানজনক শর্ত মেনে নিলেও যখনই শক্তি অর্জনে সক্ষম হয়েছেন তখনই তার প্রতিশোধ নিয়েছেন শিবাজী মহারাজ।
যখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় সাভারকর ব্রিটিশ সরকারের কাছে একটি আবেদনপত্র পাঠান। সেখানে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন যে, ব্রিটিশরা যদি হিন্দুস্থানকে ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন দেয় এবং সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দেয় তবে বিপ্লবীরাও ইংরেজদের সাহায্য করবে। সেসময় ইউরোপে বিভিন্ন সরকার রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দিচ্ছিল এমনকী আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, সাভারকর তারও উল্লেখ করেন। তিনি লিখেছেন, ‘ব্রিটিশরা সব রাজনৈতিক বন্দিকে মুক্তি দিক। আমাকে মুক্তি না দিলেও আমার আপত্তি নেই। আমি আন্দামানের নির্জন কক্ষে বসে বন্দিদের মুক্তিতে আনন্দ করবো।
মুক্তি পেলে রাজনীতি করবেন না এই শর্ত তিনি কেন মেনে নিলেন এ ব্যাপারেও সাভারকরের বক্তব্য পরিষ্কার। তার ভাষায়, “একটি নিদিষ্ট সময়ের জন্য আমি রাজনীতিতে অংশ না নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। জেলে বসে আমি রাজনীতি করতে পারতাম না। জেলের বাইরে আমি অন্য ধরনের কাজ করতে পারি যেমন শিক্ষা, ধর্মীয় বা সাহিত্য রচনার কাজ এবং এভাবেই দেশের সেবা করতে পারি।” তিনি বুঝেছিলেন যে আন্দামানের সেলুলার জেলের ভয়াবহ পরিবেশ তিলে তিলে শেষ হয়ে যাওয়ার চেয়ে জেলের বাইরে থেকে দেশ গঠনের কাজে এবং ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার কাজে অংশগ্রহণ করা প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীর শুরতেই মুসলিম লিগ গঠন, ব্রিটিশের বিভাজন নীতি, জিন্নার সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং তা প্রতিরাধে কংগ্রেসের সীমাহীন ব্যর্থতা ভারতে হিন্দুদের মধ্যে প্রবল অনিশ্চয়তা সৃষ্টিকরেছিল।হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি বিপর্যস্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এই সময় প্রয়োজন ছিল হিন্দু সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং হিন্দুত্বকে একটি রাজনৈতিক আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা ও জনপ্রিয় করা। এই ঐতিহাসিক প্রয়োজন মিটিছিলেন সাভারকর। সেলুলার জেলের প্রাচীরের আড়ালে যদি তিনি জীবন অতিবাহিত করতেন তবে সমগ্র হিন্দু সমাজকে এক করার করার কাজ আর কারো দ্বারা হতো কিনা সন্দেহ। ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অভিঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত ভারতবর্ষ। সুতরাং সাভারকরের বিরুদ্ধে বাম-কংগ্রেসি ইতিহাস লেখক এবং রাজনীতিকদের সমালোচনা শুধুভিত্তিহীন নয়, তা দুরভিসন্ধিমূলকও। ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহকে সামগ্রিক বিচার না করে তাকে খণ্ডিত ভাবে দেখলে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার প্রতি সুবিচার করা হয় না। আজকেরশক্তিশালী উন্নত ভারতের অন্যতম রূপকার বিনায়ক দামোদর সাভারকর। বাম-কংগ্রেসিদের চোখে না হলেও জনগণের চোখে তিনি বীর। আর গণতন্ত্রে জনগণের মতই শিরোধার্য।
বিমল শঙ্কর নন্দ
2019-11-01