গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে ভারতবর্ষের তথাকথিত রাজনৈতিক দলগুলির প্রবল অনীহা।দীর্ঘদিনের অচলায়তন কে আঁকড়ে ধরে ভোটব্যাংক নির্ভর রাজনীতিই তাদের একমাত্র ধ্যান জ্ঞান।মোদী সরকারের কৃষি বিল নিয়ে সম্প্রতি ভারতবর্ষের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে আবারও একবার উপরের চিত্রটি পরিস্কার হয়।আজ যারা এই বিলের বিরোধিতা করে দেশ জুড়ে আন্দোলন করছেন তাদের উদ্দেশ্যে আমার কিছু অপ্রিয় প্রশ্ন।স্বাধীনতার পর থেকে আপনারা কৃষকদের কল্যানে যদি এতো তৎপর ছিলেন তবে স্বাধীনতার সাত দশক পরেও কেন এই দেশে প্রতি বিয়াল্লিশ মিনিটে একজন কৃষক আত্মহত্যা করে?কেন দেশের ৪০% কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে অন্য যে কোনও পেশায় যেতে চান?কেন মোট চাষযোগ্য জমির পরিমানের নিরীখে আমরা বিশ্বে সপ্তম হলেও একর প্রতি উৎপাদনে আমাদের স্থান আফ্রিকার কিছু দেশেরও নীচে ?আমাদের কাছে এতো শস্য শ্যামলা ভূমি থাকা সত্ত্বেও বিশ্বের খাদ্যশস্য রপ্তানির বাজারে আমাদের উপস্থিতি কেন নগণ্য?উপরের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর এদেশের প্রথম সারির প্রতিটি রাজনৈতিক দলের কাছেই আছে।তারা জানেন এদেশে প্রতি বছর ৯০০০০ কোটি টাকা মূল্যের খাদ্যশস্য মজুত করার পরিকাঠামোর অভাবে নষ্ট হয়।তারা এটাও জানেন এদেশের কৃষকদের মাথাপিছু জমির পরিমান মাত্র ১.০৮ হেক্টর, এত স্বল্প জমিতে শুধুমাত্র গতানুগতিক পদ্ধতিতে চাষ করে কোনও কৃষক সচ্ছল জীবনযাপন করতে পারার মত আয় করতে পারেন না।কিন্তু তারা জ্ঞানপাপী।তারা সব জেনেও কিচ্ছুটি করবে না।কারণ কৃষক যত গরিব হবে সে যত রাষ্ট্রের উপর নির্ভরশীল হবে,ততো তাকে সামান্য কিছু দান খয়রাত করে তার ভোট টা খুব সহজে পাওয়া যাবে।বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যেখানে উৎপাদিত খাদ্যসামগ্রীর প্রায় ৫০% প্রক্রিয়করণের ব্যবস্থা আছে,আমাদের দেশে তা ৫%।কেন এই অবস্থা ? কারণ স্বাধীনতার পর থেকে কৃষিক্ষেত্রে সেই অর্থে কোনও বিনিয়োগ হয় নি আর বিনিয়োগ হয় নি কারণ কোনও বেসরকারি সংস্থা কৃষক দের সাথে সরাসরি চুক্তির ভিত্তিতে ফসল ক্রয় করতে পারতো না
ভারতের কৃষকদের আর্থিকভাবে সাবলম্বী করতে গেলে তাদেরকে সংগঠিত করে সংঘবদ্ধ কৃষিকাজ ও উদ্যানপালন ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা নেই।সংঘবদ্ধ পদ্ধতিতে চাষ করলে তারা সল্পমূল্যে আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সাথে যুক্ত হতে পারবে,ফলে একর প্রতি ফলন বাড়বে আর পূর্বনির্ধারিত মূল্যে চুক্তি চাষ করলে ফসল উৎপাদনের পর তা বিক্রি করার দুশ্চিন্তা থেকে কৃষকরা মুক্তি পাবে।মোদি সরকারের প্রস্তাবিত তিনটি কৃষি বিলে ঠিক এই জিনিসটাই মাথায় রেখে করা হয়েছে।
প্রথমটি হলো ফার্মারস প্রোডিউস ট্রেড এন্ড কমার্স বিল
যে এপিএমসি আইন কে কিছুটা বদলে কৃষকদের দেশের যে কোনও জায়গায় নিজের উৎপাদিত ফসল বিক্রির স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে।এতদিন কৃষকরা শুধুমাত্র সরকার নির্ধারিত কৃষিবাজারে ফসল বিক্রি করতে পারতো।এখন সেই ব্যাবস্থার পাশাপাশি খোলা বাজারে দেশের যে কোনও প্রান্তে ফসল বিক্রির স্বাধীনতা পেল কৃষকরা, ফলে তাদের কাছে বিরাট বাজার উম্মুক্ত হলো যাতে তাদের নিজেদের ফসলের দর কষাকষির জায়গাটা মজবুত হলো।


দ্বিতীয় বিলটি হলো ফার্মারস এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস আসুরেন্স এন্ড ফার্ম সার্ভিস বিল যা কৃষকদের চুক্তিচাষ কে বৈধতা দিলো এবং যে কোনও চুক্তির ক্ষেত্রে কৃষকদের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে তার জন্য মহুকুমাশাসকের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে।
তৃতীয় বিলটি হলো এসেনশিয়াল কমডিটিস আমেন্ডমেন্ট বিল।যেটা নিয়ে বিরোধীদের বিস্তর অভিযোগ।এর ফলে নাকি খাদ্যদ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে যাবে।তাদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে এখন তো রাজ্যে বিলটি লাগু হয় নি তাও কেন প্রতিবছর আলু,পেঁয়াজ, টমেটো সহ অনেক নিত্য প্রয়োজনীয় সব্জির দাম লাগাম রাখতে মুখ্যমন্ত্রী কে নিজে বাজারে বাজারে ঘুরতে হয়? কারণ টা পরিষ্কার আগেই বলেছি আমাদের দেশে কৃষিপণ্য সংরক্ষনের পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে ফলে ফসল উৎপাদনের মরশুমে বাজারে প্রচুর যোগানের কারণে কৃষকদের সল্পমূল্যে তা বিক্রি করতে হয়,অন্য দিকে অসময়ে যোগান কম থাকার জন্য বাজারে সব্জি অগ্নিমূল্য হয়ে যায়।এখন কোনও সরকারের পক্ষেই দেশের উৎপাদিত সমস্ত ফসলের সংরক্ষন করার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়,তার জন্য প্রয়োজন বেসরকারি পুঁজি।কিন্তু কোনও বেসরকারি সংস্থা কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে সংরক্ষণের পরিকাঠামো কেন তৈরি করবে যদি তারা ইচ্ছেমতো মজুত করার স্বাধীনতা না পায়?তাই অত্যাবশ্যক পণ্যের আইন বদলের দরকার ছিল।কিন্তু তার মানে এই নয় যে খাদ্য নিরাপত্তা বলে কিছু থাকবে না।কোনও খাদ্যদ্রব্যের মূল্য দ্বিগুন হয়ে গেলে সরকার তার মূল্য নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করার কথা সংশোধিত আইনে বলা আছে।এ তো গেল বিলের কথা যা সংবাদমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে।কিন্তু সংবাদমাধ্যম যা দেখাচ্ছে না তা হলো কেন্দ্রীয় সরকার ৫০০০ কোটি টাকা খরচ করে ২০২৪ সালের মধ্যে দেশ জুড়ে ১০০০০ কৃষক উৎপাদক সংগঠন বা ফার্মারস প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে এছাড়া এক লক্ষ কোটি টাকার একটি কৃষি পরিকাঠামো তহবিল গঠন করা হয়েছে।অর্থাৎ কৃষক দের সংঘবদ্ধ করে তাদের কে আধুনিক প্রযুক্তি, সার ,বীজ কীটনাশক সল্পমূল্যে পাওয়ায় ব্যবস্থা করিয়ে তাদের জমির উৎপাদন ক্ষমতা ও ফসলের গুনগত মান বাড়িয়ে তাদের উৎপাদিত শস্যের উপযুক্ত মূল্যে বিক্রির ব্যবস্থা এই পুরো প্রক্রিয়া টা নিরঙ্কুশ ভাবে সংগঠিত করতে যা যা সম্ভাব্য করার দরকার সেটা করার চেষ্টা হয়েছে।যারা বলছেন চুক্তি চাষে নাকি কৃষকরা কর্পোরেটদের ক্রীতদাসে পরিণত হবে তারা হয়তো জানেন না এদেশের ৬৬% পোল্ট্রি ও ৯০% কফি চুক্তির ভিত্তিতে চাষ হয় যাতে কৃষকরা যথেষ্ট উপকৃত হয়েছে।আর খাদ্যদ্রব্যের বাজার কে একচেটিয়াকরণকরে কর্পোরেটগুলো নাকি খাদ্যদ্রব্যের দাম কে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে নিয়ে চলে যাবে বলে যে ভয় দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে তা যে কতটা অন্তঃসারশূন্য তার একটা উদাহরণ হলো মধু। মধু উৎপাদনের সঙ্গে বিপুলসংখ্যক মানুষ যুক্ত নেই,মৌমাছি পালন ও মধু সংগ্রহ করার কাজটি দেশের বিরাট ভৌগোলিক অঞ্চলজুড়ে হয় না তা সত্ত্বেও মধু কে কোনও কর্পোরেট একচেটিয়া করতে পারলো না আর ধান,গম,পেঁয়াজ,আলু ডালের মতো ফসলে যেখানে কোটি কোটি মানুষ যুক্ত,প্রতিটি রাজ্যে এমনকি প্রতিটি জেলায় যে ফসলের গুণগত চরিত্র আলাদা এবং যে ফসল গুলোকে গুদামজাত করতে কয়েক লক্ষ কোটি বিনিয়োগ দরকার তা কি করে একচেটিয়া করা যায় তার উত্তর টা কি বিরোধী দলগুলি দেবেন?
কাজেই শুধুমাত্র বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা বন্ধ করুন।দেশের আত্মনির্ভর হওয়ার পথ চলায় নিজেদের কে সহায়ক করে তুলতে না পারলেও অন্তত নিষ্ক্রিয় রাখুন,অন্তরায় হতে দেবেন না,তাহলে ইতিহাস আপনাদের ক্ষমা করবে না।

সোমনাথ গোস্বামী (Somnath Goswami)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.