কংগ্রেসের নেতৃত্বের ধরন কিংবা প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করলে কংগ্রেসের কিছু অত্যুৎসাহী সমর্থকের সমালোচনা সহ্য করতে হয়। এই সমালোচনার প্রধান বিষয় হলো কংগ্রেস কাকে তাদের সর্বোচ্চ নেতা বানাবে সেটা কংগ্রেসের নিজস্ব ব্যাপার এবং সেখানে অন্য কারোর কিছু বলার থাকতে পারে না। এটা একান্তই কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কোনো গুপ্তগোষ্ঠী নয়। বরং দেশের অন্যতম প্রধান সর্বভারতীয় দল। ১৩৪ বছরের পুরানো একটি রাজনৈতিক সংগঠন। সেই হিসাবে কংগ্রেস ভারতের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে এদেশে একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আছে। একাধিক অঙ্গরাজ্যে কংগ্রেস ক্ষমতার অধিষ্ঠিত। এদেশের কেন্দ্রীয় আইনসভার নিম্নকক্ষ লোকসভার নির্বাচনে অংশ নিয়ে দলটি কেন্দ্রে ক্ষমতায় ফিরতে চায়। তাই কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিয়ে আলোচনা বা বিশ্লেষণের অধিকার সব মানুষেরই আছে।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেকগুলি ধারার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা যে আবর্তিত এবং পরিচালিত হয়েছিল কংগ্রেসকে কেন্দ্র করে এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। যদিও দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সুবাদে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস তার মদতপুষ্ট ঐতিহাসিকদের দিয়ে এই ধারাটিকেই একমাত্র ধারা বলে প্রমাণ করতে চেয়েছে। কিন্তু সত্য হলো এই যে, কংগ্রেসের নেতৃত্বে পরিচালিত হওয়া ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ধারাটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা ছিল। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কংগ্রেস কোনো দলও ছিল না সেই অর্থে। এটি দিল একটি ব্যাপকভিত্তিক সংগঠন। অনেকটা প্ল্যাটফর্মের মতো যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠী (এমনকী যদি তাদের পরস্পর বিরোধী মতাদর্শও থাকে) ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত কংগ্রেস এভাবেই কাজ করেছে। যে কারণেই সংগঠনটির নাম কংগ্রেস। Congress, এই ইংরেজি শব্দটির মূল অর্থ ছিল— a formal meeting or a series of meetings’l এই নামে কোনো দল হয় না। স্বাধীনতার পরেও প্রশ্ন উঠেছিল কংগ্রেস সংগঠনটির অস্তিত্ব আর টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন আছে কিনা। যাইহোক কংগ্রেসের তৎকালীন নেতৃত্ব একে একটি পুরোদস্তুর রাজনৈতিক দলে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের হয়তো মনে হয়েছিল কংগ্রেসের অবলুপ্তি ঘটালে ভারতের রাজনীতিতে একটি শূন্যতা দেখা দিতে পারে। সমস্যা দেখা দিত কিনা সেটা কল্পনার বিষয়। কিন্তু এটা সত্য যে সে সময়ে কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত নেতারা ক্ষমতা লাভের জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন। ফলে কেবল ক্ষমতালাভের প্রয়োজনে কোনো সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ ব্যাতিরেকে গড়ে উঠল একটি রাজনৈতিক দল। দলটির সমস্যার বীজ কিন্তু এর মধ্যেই নিহিত। সাধারণভাবে উদারনীতিকে কংগ্রেস আদর্শ হিসেবে মানলেও, এ সম্পর্কেকংগ্রেসকর্মীদের একটা বড়ো অংশের স্বচ্ছ ধারণা আছে বলে মনে হয় না।
সাধারণভাবে কংগ্রেসকর্মীরা ক্ষমতার বাইরে থাকতে পছন্দ করে না। অর্থাৎ ক্ষমতা হলো অনেকটা সুতোর মতো যা বিভিন্ন অংশকে বেঁধে রাখে। ১৮৬৬ সালের ১১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর আকস্মিক মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হলে কংগ্রেসে এক নতুন সংস্কৃতির উদ্ভব হয়। সেটা হলো সরকার এবং সংগঠন। উভয়ের ক্ষমতা একজনের বা একটি পরিবারের হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়া। ১৯৬৬ সালে লালবাহাদুর শাস্ত্রীর প্রয়াণের পর কংগ্রেসের তৎকালীন নেতৃত্ব (যেমন অতুল্য ঘোষ, নিজলিঙ্গাপ্পা, কামরাজ প্রমুখ) স্বাধীনচেতা স্বভাবের মোরারজী দেশাইকে ক্ষমতায় না বসিয়ে ‘গুসি গুড়িয়া’ ইন্দিরা গান্ধীকে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন এই আশায় যে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন পরিচালিত হবে দলের নির্দেশে। কিছুদিনের জন্য কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে কাজ করলেও ১৯৬৯ সালে ইন্দিরা দলটিকে তৈরি করলেন তাঁর মতো করে। একই ব্যক্তির হাতে সরকারি প্রশাসন এবং দলীয় নেতৃত্ব চলে এল। এমন ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়করা গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যেই একনায়কের মতো আচরণ করতে থাকেন। দলের অন্য সবাইকে সন্দেহ করতে থাকেন। তার প্রতিদ্বন্দ্বী এবং নেতৃত্বের কাছে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। নির্ভর করতে থাকেন ঘনিষ্ঠজনদের উপর। ইন্দিরা নির্ভর করতেন তার কনিষ্ঠপুত্ৰ সঞ্জয় গান্ধীর উপর। ১৯৮০ সালের ২৩ জুন এক বিমান দুর্ঘটনায় সঞ্জয় গান্ধী নিহত হলে তার স্থান পূর্ণ করতে আনা হলো জ্যেষ্ঠপুত্র রাজীব গান্ধীকে। ভারতে চালু হয়ে গেল এক অতি কুৎসিত পরিবারতন্ত্র। এখন কংগ্রেসের রাজনৈতিক সংস্কৃতিই হলো এই যে পরিবারের বাইরে কারোর পক্ষে শীর্ষ নেতৃত্বে আরোহণ করা অসম্ভব। পরিবারেরই কেউ হবেন সমস্ত ক্ষমতার মালিক। তার প্রতি শর্তহীন আনুগত্যই সাংগঠনিক কাঠামোতে সাফল্যের চাবিকাঠি। একবারই (১৯৯১-১৯৯৬) গান্ধী পরিবারের বাইরে পিভি নরসীমা রাওয়ের হাতে কংগ্রেসের সাংগঠনিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ ছিল। একথা অধিকাংশ মানুষই স্বীকার করেন যে মাত্র পাঁচ বছরের সময়কালে নরসীমা রাও রাষ্ট্রপরিচালনা এবং সুদূরপ্রসারী নীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের নিয়ন্ত্রণে থাকতে অত্যন্ত কংগ্রেস নেতা কর্মীদের এক অংশ নরসীমা রাওয়ের নেতৃত্বে মানতে চাননি। অর্জুন সিংহের মতো পরিবার অনুগতরা বার বার বিদ্রোহ করেছেন। অর্জুন। সিংহকে দল থেকে বহিষ্কার করেও নরসীমা রাও দলকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। আর পরিবারকে অবহেলা করে দল ও প্রশাসন চালানোর সাহস দেখানোর মূল্য জীবনকালে না হলেও মৃত্যুর পর দিতে হয়েছিল নরসীমা রাওকে। তার মৃতদেহটিকেও কংগ্রেস দপ্তরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
সংগঠনে পরিবারতন্ত্রের প্রবহমানতার সাম্প্রতিক সংযোজন রাহুল গান্ধী। সোনিয়া গান্ধীর পর দলের শীর্ষ নেতৃত্বে রাহুল গান্ধীকে অধিষ্ঠিত করতে প্রথমে তাকে দলের সহ-সভাপতি করা হলো ২০১৩ সালে, যদিও কংগ্রেসের দলীয় সংবিধানে এই ধরনের কোনো পদই নেই। পদটি তৈরিই হয়েছিল রাহুল গান্ধীকে সংগঠনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ দিয়ে নিয়ে আসতে। ২০১৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে রাহুল গান্ধী প্রত্যাশামতোই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি রাহুল গান্ধী সভাপতি হওয়ার পর গান্ধী পরিবারের চাটুকারিতায় সিদ্ধহস্ত কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আইয়ার মন্তব্য করেছিলেন ‘সম্রাটের সন্তান তো সম্রাট হবেই’। খাঁটি কথা!
একটি ব্যাপারে রাহুল গান্ধী বাস্তববাদী। তিনি বোঝেন যে ২০১৯-এ কেন্দ্রে দলকে। ক্ষমতায় আনতে না পারলে সমূহ বিপদ। নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। তাতে পরিবারের অপ্রতিহত কর্তৃত্বের সামনে বিপদ আসতে পারে। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক চাটুকারিতার (competetitire psychophancy) আবহে বাস করা পরিবার তাহলে বিপদগ্রস্ত হবে। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে। গণআন্দোলন গড়ে তোলার মতো তেমন ইসুও নেই।আর গণআন্দোলন গড়ে তোলার কোনো মানসিকতাও কংগ্রেস নেতৃত্বের নেই। তাই অনেক ভেবে বের করা হয়েছে রাফাল ইসু, সেহেতু চুক্তিটি দুটি দেশের মধ্যে এবং যুদ্ধবিমানগুলিকে অত্যন্ত গোপীনয়তার সঙ্গে অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত করা হবে। সুতরাং রহস্য সৃষ্টির এটাই সেরা পন্থা। দিকে দিকে রাহুলের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস কর্মীদের গলা ফাটানো চিৎকার ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। তাতেও খুব সুবিধা হচ্ছে না। দেখে এবার দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় সুপ্রিম কোর্টকে নিয়েও টানাটানি শুরু হলো।
গত ১০ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেন যে প্রতিরক্ষা দপ্তর থেকে পাচার হওয়া নথিও রাফাল মামলায় সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে গৃহীত হতে পারে। আনন্দের আতিশয্যে রাহুল গান্ধী দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে বলে ফেললেন সুপ্রিম কোর্টও নাকি মেনে নিয়েছে চৌকিদার চোর হ্যায়। বিজেপি নেত্রী মীনাক্ষী লেখি বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগাৈইয়ের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ রাহুল গান্ধীকে জবাব দিতে বলেন। আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের রায়কে গুলিয়ে। ফেলার জন্য রাহুল দুঃখ প্রকাশ করলেও সুপ্রিম কোর্ট একেবারেই এই জবাবে সন্তুষ্ট হননি। কোর্ট রাহুলের বিরুদ্ধে নোটিশ জারি করেছেন।
রাহুলের লক্ষ্য হলো রাফালকে কেন্দ্র করে বোফর্স ধাঁচের অবস্থা তৈরি করা। ১৯৮৭ সালে জনসাধারণের সামনে উন্নোচিত বোফর্স কেলেঙ্কারি ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে রাজীব গান্ধী সরকারের পতনের কারণ হয়েছিল। রাহুল সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চান। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব নয়। কারণ বোফর্স কেলেঙ্কারিতে কোর্ট রাজীব গান্ধীর বিরুদ্ধে প্রমাণ না পেলেও বহু প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি; কি করে অট্টাভিও কাত্রোচ্চি সিবিআইয়ের জেরা এড়াতে ভারত ছাড়তে পারল ? পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাধন সিংহ সোলাঙ্কি সুইডেন সফরকালে সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বোফর্স তদন্ত বন্ধ করতে চিঠি দিয়ে এসেছিলেন কেন? বোফর্স মামলায় এফ আই আর করতে সিবিআই এতো দেরি করেছিল কেন? আর্জেন্টিনা থেকে কাত্রোচ্চিকে ভারতে প্রত্যার্পণের ব্যাপারে এত দুর্বল মামলা সাজানো হয়েছিল কেন? কাত্রোচ্চির বিরুদ্ধে ইন্টারপোল রেড করার নোটিশ তুলে নেওয়া হয়েছিল কেন? ইউপিএ আসলে কাত্রোচ্চির লন্ডনের এক ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টের ব্যবহারের উপর নিষেধাজ্ঞা তুলতে ব্যাঙ্ককে অনুরোধ করা হয়েছিল কেন? এমন বহু প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। আর ২০১৩ সালের ১৩ জুলাই অক্টাভিও কাত্রোচ্চির মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সত্য জানার সমস্ত সম্ভাবনাও শেষ হয়ে গেছে।
রাহুল গান্ধী অতি দ্রুত ক্ষমতায় আসতে চান। একটি দলের নেতা হিসেবে দলকে ক্ষমতায় আনার চেষ্টার মধ্যে অন্যায়ের কিছু নেই। কিন্তু তার অতি হঠকারিতা দলকে ক্ষমতায় আনার বদলে বিস্মৃতির অতলে পাঠিয়ে দিতে পারে। ইতিমধ্যে সেই লক্ষণগুলি স্পষ্ট হতে শুরু করেছে।
বিমল শঙ্কর নন্দ
2019-05-02