মা কালী ছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর শক্তির উৎস স্থান। জীবনের প্রতি পর্বে নেতাজির আরাধ্যা দেবী ছিলেন মা কালী। নেতাজীর এলগিন রোডের বাড়িতে তাঁর শয়ন কক্ষের ঘরের একদম কোণে- মা কালীর এক রুদ্র মূর্তির ছবি বাঁধানো আছে। মা কালীর টানেই তিনি প্রায়ই ছুটে যেতেন দক্ষিণেশ্বরে মা কালীর মন্দিরে। দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের সঙ্গে তাঁর অন্তরের যোগ ছিল। নৌকা করে বেলুড় মঠে যেতেন গঙ্গা পেরিয়ে। আর এই সময়ে নৌকায় গুনগুন করে গাইতেন শ্যামাসঙ্গীত। নৌকায় তাঁর সঙ্গে থাকতেন প্রফুল্ল সরকারের মতো বিখ্যাত মানুষেরা।
শ্যামাসঙ্গীত খুব প্রিয় ছিল নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর। এই প্রসঙ্গে আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। একবার উত্তাল পদ্মা নদীর বুকেও শ্যামাসঙ্গীত গেয়ে উঠেছিলেন নেতাজি। সেইদিন ঝড় উঠেছিল। কিন্তু তবুও নৌকায় পদ্মা নদী অতিক্রম করেছিলেন নেতাজি। সঙ্গী ছিলেন কংগ্রেস নেতা অবিনাশ ভট্টাচার্য। আর সেই নৌকাযাত্রায় নেতাজি গান ধরেছিলেন, “কবে আবার নাচবি শ্যামা………”।
১৯৪১ সালের জানুয়ারী মাস। নেতাজি তখন এলগিন রোডের বাড়িতে গৃহবন্দী। বাড়ির উপর নজর রাখছেন প্রায় ১৫ জন ব্রিটিশ গোয়েন্দা। রয়েছে প্রায় ৭ টি স্তরের পুলিশি বেষ্টনী। এই পুলিশি বেষ্টনী ভেদ করে নেতাজি বেরিয়ে এসেছিলেন। মহানিষ্ক্রমণের ঠিক কয়েকদিন আগে তিনি গভীর রাতে ভাইজি ইলা বসুকে মায়ের পায়ের ফুল ও চরণামৃত নিতে পাঠিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। নেতাজি সংকল্প নিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরের মা ভবতারিণীর আশীর্বাদ না নিয়ে তিনি দেশত্যাগ করবেন না। এই ঘটনার কয়েকদিনের পরই দেশত্যাগ করেন নেতাজি। নেতাজি যেখানেই যেতেন তাঁর সঙ্গে থাকত গীতা, জপের মালা এবং মায়ের পায়ের শুকনো জবাফুল। শক্তি সঞ্চয় করতে মা কালীই ছিল নেতাজির ভরসা।
নেতাজি যখন কারাগারে বন্দি তখনও করতেন মা কালীর উপাসনা। চিঠির উপরে লিখতেন ‘কালী মাতা’। ১৯৪০ সালে প্রেসিডেন্সি জেলে নেতাজি যে অনশন শুরু করেছিলেন- তা ছিল কালীপুজোর পবিত্র দিনে। সুভাষচন্দ্র চিঠিতে জেল প্রধানকে লিখেছেন- “I repeat this letter, written on the sacred day of Kali Pujah, should not be treated as a threat or ultimatum. It is merely an affirmation of one’s faith, written in all humility.” “The step that I have now taken is not an ordinary fast. It is the result of several months” mature deliberation, sealed by vow prayerfully taken by me on the sacred day of Kali Pujah.”
সুভাষচন্দ্রের কন্ঠে ধ্বনিত হয়- ” কালী তুই প্রলয়রুপিনী, আয় মাগো, আয় মোর পাশে, সাহসে যে দু:খদৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশ,কালনৃত্য করে উপভোগ,মাতৃরূপা তারই কাছে আসে।”
আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করার সময়েও সিঙ্গাপুরের রামকৃষ্ণ মিশনে নিয়মিত যেতেন নেতাজি। সাদা পোশাক পরিহিত নেতাজি আরাধনা করতেন ঠাকুরের। অনুভব করতেন মা কালীকে। নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তাঁর এই ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন-” সেদিনটি ছিল সত্যিই এক বিচিত্র আশ্চর্য দিন। আত্মনিবেদনের এক অবিস্মরণীয় দিন । সম্মুখে শুধু অন্ধকারের পারাবার। সেই চরম সংকট মুহূর্তে ,রেঙ্গুন ত্যাগের পূর্বক্ষনেই নেতাজি সামরিক পরিচ্ছদ খুলে পড়েছিলেন পট্টবস্ত্র। শুচিশুভ্র নির্বিকার যোগী একাকী চলে গিয়েছিলেন, তাঁর আদর্শের পুরুষের প্রাণদেবতার সেবায়তনে। রামকৃষ্ণ মিশনের মন্দিরে বসে ছিলেন যুগ ঋষির মূর্তির সম্মুখে সমাহিত হয়ে। তদগত। তন্ময়।উজাড় করে দিয়েছিলেন নিজেকে।”
মাত্র ১৭ বছর বয়সে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসের সম্পর্কে লিখেছিলেন “মনে পড়ে একটি চিত্র- কালীমন্দির দক্ষিণেশ্বরে। সম্মুখে খড়্গহস্তা মা-কালী- আনন্দময়ী- শিবের আসনের ওপর অধিষ্ঠাতা- শতদলবাসিনী -তাঁর সম্মুখে একটি বালক- বালক হইতেও বালপ্রকৃতি- আধ আধ স্বরে কাঁদিতেছে,এবং কাকে যেন ডেকে ডেকে বলিতেছে- ‘মা,এই নাও তোমার ভালো, এই নাও তোমার মন্দ। এই নাও তোমার পাপ,এই নাও তোমার পুণ্য।’ করালমুখী ভীষণদ্রংষ্টা মা অল্পেতে সন্তুষ্ট নয়- সব গ্রাস করিতে চায়- তাই ভালোও চাই, মন্দও চাই- পুণ্যও চাই, পাপও চাই, বালককে সবই দিতে হইবে- না দিলে শান্তি নাই- মাও ছাড়িবে না। বড় কষ্ট। মাকে সব দিতে হইবে। মা কিছুতেই সন্তুষ্ট না- তাই কাঁদিতেছে এবং বলিতেছে- ‘এই নাও,এই নাও।’ দেখিতে দেখিতে অশ্রুধারা বন্ধ হইল। গণ্ডস্থল ও বক্ষ শুকাইল- হৃদয় জুড়াইল – হৃদয়ে আর কিছু নাই- যেখানে ভীষন কণ্টক যন্ত্রণা দিতেছিল,তার চিহ্নও নাই- সবই শান্তিময়। হৃদয় মধুতে ভরিয়া গেল। বালক উঠিল।”
মা কালী ছিল নেতাজির শক্তির উৎস। আর এই শক্তি দিয়েই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে।
তথ্য : দিগন্ত সেনগুপ্তের লেখা, নেতাজি গবেষক জয়ন্ত চৌধুরীর থেকে প্রাপ্ত তথ্য