প্রয়াত হয়েছেন রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রমের প্রাক্তন ছাত্র সংসদের দীর্ঘমেয়াদী প্রাক্তন সম্পাদক শ্রী করুণাময় চন্দ।
রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৪৪ সালের ১ লা সেপ্টেম্বর। রহড়া বালকাশ্রমের সঙ্গে এই প্রাক্তন ছাত্র সংসদের নিবিড় ও অমোচ্য বন্ধন। ১৯৫২ সালে আশ্রমের প্রথম কর্মাধ্যক্ষ স্বামী পুণ্যানন্দজীর স্নেহের পরশে জন্ম নিয়েছিল প্রাক্তন ছাত্র সংসদ। আশ্রম গড়ে ওঠার পর প্রথম ব্যাচ বেরিয়ে যাবে। মহারাজের মন তখন ভারাক্রান্ত, সহপাঠীরাও বন্ধু বিচ্ছেদের আবহে ব্যথিত। মহারাজ চাইলেন ছেলেরা বছরের একটি দিন অন্তত নিজেরা দেখা করার সুযোগ পাক, আশ্রমের ঐশী ছায়ায় ফিরে আসুক। সেই থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ওই সংগঠনের সভাপতিত্ব করেছেন এবং অন্যতম প্রেরণাদাতা ও পৃষ্ঠপোষক হয়ে ছিলেন। এটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সমর্থিত একটি অরাজনৈতিক ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর স্থায়ী ঠিকানা প্রথম থেকেই ছিল বালকাশ্রমের পুরোনো আশ্রমবাড়ীর অভ্যন্তরে। বরাবর এই সংগঠনের সভাপতি হয়ে আসছেন বালকাশ্রমের তদানীন্তন কর্মসচিব।
শ্রী করুণাময় চন্দ ১৯৭৬ সাল থেকে একাদিক্রমে প্রায় ৪২ বছর ধরে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশন বালকাশ্রম প্রাক্তন ছাত্র সংসদের নেতৃত্বে ছিলেন। পরবর্তীকালে সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন, সেটাও প্রায় পঁচিশ বছর। বেলুড় মঠের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতির জন্য স্বামী নিত্যানন্দজী (কেষ্ট মহারাজ) অপসারিত হলে রহড়ায় কর্মসচিব হয়ে আসেন স্বামী রমানন্দজী মহারাজ। তখন থেকেই করুণাময় বাবু দায়িত্ব নিলেন প্রাক্তন ছাত্র সংসদের, সঙ্গে পেলেন শ্রী সুরেশ বিশ্বাসকে। পুরনো, পরিচিত প্রাক্তনীরা তখন একে একে যাতায়াত শুরু করেছেন ব্যারাকপুর রিভারসাইড রোডে বিবেকানন্দ মিশনে স্বামী নিত্যানন্দের ছত্রছায়ায়। সেই সময় রহড়ায় প্রাক্তনীদের বাঁধলেন করুণাময় চন্দ। কাজটি মোটেই সহজ ছিল না তখন, কারণ মামলা দাঁড়িয়েছিল কোর্টে। দু পক্ষই চাইছিলেন প্রাক্তন ছাত্র সংসদের আইনী দাবীদার হতে। শুরু হল কোর্টের লড়াই, সে লড়াই-এর সমাধান হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। কিন্তু যেটা হল, রহড়া কেন্দ্রিক প্রাক্তনীদের অবিসংবাদী নেতা হয়ে গেলেন করুণাময় বাবু। আশ্রমের সুখে-দুঃখে তার অমোচ্য সংপৃক্তি ছিল। তারই সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন সময়কালে রহড়া বালকাশ্রমে অনুষ্ঠিত হয়েছে গোল্ডেন জুবিলি, তাতে প্রাক্তন আশ্রমিকদের ঐতিহাসিক উপস্থিতি ছিল; তার সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল প্রাক্তন ছাত্রদের পত্রিকা ‘দিব্যায়ন’। করুণাময় চন্দের উদ্যোগে প্রাক্তন ছাত্র সংসদ পল্লী বিকাশেও অংশগ্রহণ করেছিল। ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিবেকানন্দ হলে আয়োজন করে সারাদিনব্যাপী পরিবেশ-কেন্দ্রিক ঐতিহাসিক সেমিনার, আশ্রমে ভেষজ উদ্যান ও চারা তৈরির নার্সারী। তিনি শেষজীবনে সন্ন্যাস রোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কয়েক বছর গৃহবন্দী ছিলেন।
তাঁর স্মৃতিলোপ হয়েছিল অনেকাংশে। ২০১৯ সালে তাঁর কাছে গিয়েছিলাম। তখন মনে করার চেষ্টা করলেন নিজের জন্মসাল– ১৯৪০ বা ৪১ সালের কোনো এক অক্টোবর। বললেন, সেটাও হয়তো সঠিক নয়; কারণ পুণ্যানন্দজীর কাছে আশ্রয় পাবার পর স্বামীজি আনুমানিক একটি জন্মতারিখ বলেছিলেন, সেটাই লেখা হত সর্বত্র। তার পিতা – সত্যেন্দ্র নাথ চন্দ, মাতা – কিরণপ্রভা দেবী। বললেন, ২০০২ সাল নাগাদ তিনি কর্মক্ষেত্র থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নেন SBI, বালিগঞ্জ শাখা থেকে। তখন তার পদমর্যাদা ছিল সহকারী শাখা প্রবন্ধক। তিনি বি.কম পাশ করেন কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে। অবসর নেবার পর আশ্রমে সেবাকাজ আর প্রাক্তন ছাত্র-সংসদের কাজ শুরু করলেন আরও নিবিড়ভাবে। করুণাময় বাবুর সহধর্মিণীর নাম – শ্রীমতী চন্দ্রিমা চন্দ, এম.এ, বি.টি; তিনি গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলের ইংরাজি ভাষার শিক্ষিকা ছিলেন, বেশ কয়েক বছর আগে চাকরি থেকে অবসরগ্রহণ করেছেন। একমাত্র কন্যা কথাকলি চন্দ মুম্বাই নিবাসী এবং প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সম্পাদক।
বালকাশ্রম মন্দিরের সামনে পুরাতন নিমগাছটি বাঁচিয়ে রাখার ক্ষেত্রে করুণা দার অসামান্য অবদান ছিল। তিনিই মাঝেমাঝে কৃষিবিদ হিসাবে আমাকে ডেকে নিয়ে মালীকে দিয়ে পরিচর্যা করিয়েছিলেন এই গাছ সহ আশ্রমের নানান গাছের। যদিও এই পুরাতন নিমগাছটি বিগত অ্যাম্ফূন ঘূর্ণিঝড়ে ভূপতিত হয়ে যায়।
করুণাময় চন্দের সাধারণ সম্পাদনার সময় দুই এক দফায় সাংস্কৃতিক সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব সামলেছি। আশ্রমের নানান কাজে অংশ নিয়েছি তাঁর স্নেহমিশ্রিত নির্দেশে। তাঁর এই প্রয়াণে আমি ব্যথিত, মর্মাহত। প্রার্থনা করি তাঁর বিদেহী আত্মার চিরশান্তি। তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ভাবান্দোলনে তিনি ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। আশ্রমিক ইতিহাস হয়তো তাঁকে চিরকাল মনে রাখবে। মনে রাখবেন সেই ইতিহাসের তন্বিষ্ট পাঠকও।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।