সাধক থেকে যুদ্ধের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছেন এমন বীরের সংখ্যা ভারতের ইতিহাসে খুবই নগণ্য, তবুও বিধর্মীদের আক্রমণ হতে ভারতমাতাকে রক্ষা করার ব্রত নিয়েছিলেন এমন এক সন্ন্যাসী বীর যোদ্ধার কাহিনী আমাদের অনেকেরই অজানা। কাশ্মীরের পুঞ্চ জেলার রজৌরী গ্রামে 1670 সালের 16 ই অক্টোবর বৃহস্পতিবার জন্মগ্রহণ করেন লছমন দাস। বাবা রামদেব রাজপুত ডোগরে স্থানীয় জমিদার ছিলেন।পারিবারিক আর্থিক সচ্ছলতা যথেষ্টই ছিল এই পরিবারের।রামদেব পুত্র লছমন দাসকে রীতি অনুযায়ী ঘোড়সওয়ারী,শিকার করা,কুস্তি প্রভৃতি যাবতীয় শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যবস্থা করলেও পুঁথিগত শিক্ষার বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। সময় এগিয়ে চলে।লছমন দাস যৌবনে পদার্পণ করেন। এই সময় এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যা লছমন দাসের জীবনে আমূল পরিবর্তন বয়ে আনে। একবার শিকার করতে গিয়ে তিনি এক হরিণীর শিকার করেন।সন্তানসম্ভবা হরিণী দুই শাবক সহ ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই ঘটনাতে লছমন দাস বিচলিত হয়ে পড়েন এবং মনের মধ্যে নানা প্রশ্ন তাঁর মনকে অশান্ত করে তোলে।
মানসিক শান্তির আশায় তিনি সাধু সঙ্গ শুরু করেন। এই সময় শ্রী জানকী প্রসাদ নামে এক সাধু রজৌরী আসেন। সাধু মহাত্মাকে লছমন তার মনের পীড়ার কথা বলেন। সাধু জানকী প্রসাদ শিষ্য কে চিনতে পারেন। জানকী প্রসাদের কথা মতো লছমন দাস সংসার ত্যাগ করে তার সাথে লাহোরের (বর্তমানে পাকিস্তানে) আশ্রমের নিয়ে আসেন।এবং তিনি লছমন দাসের নাম পরিবর্তন করে রাখেন মাধো দাস। কারণ জানোকী প্রসাদ জানতেন আজ নয়তো কাল লছমন দাসের পিতা রামদেব পুত্রের খোঁজে নিশ্চয়ই লাহোর আসবেন। তাই এই নামের পরিবর্তন তিনি করেন। এদিকে লছমন দাস ওরফে মাধো দাসের মন তবুও কিছুতেই শান্ত হলো না। তিনি শান্তির খোঁজ করতে থাকলেন। 1686 সালে লাহোরের কাছে কসুর এলাকাতে বৈশাখী মেলাতে তিনি অন্য এক সাধু শ্রী রাম দাস কে গুরু হিসেবে স্বীকার করলেন।এবং শান্তির খোঁজে দক্ষিণ ভারত অভিমুখে যাত্রা করলেন। বহু তীর্থ ক্ষেত্র ভ্রমণ করলেন শাশ্বত জ্ঞানের প্রাপ্তির লক্ষ্যে।কিন্তু শাশ্বত জ্ঞান তাঁর প্রাপ্তি কিছুতেই হল না।এই সময় পঞ্চবটী এলাকাতে তিনি দর্শন পান যোগী শ্রী অঘোড়নাথ বাবাজীর। এই যোগী ঋদ্ধি-সিদ্ধি ও তান্ত্রিক বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। এই যোগীর কাছেই লছমন দাস ওরফে মাধব দাস তন্ত্র-মন্ত্র ও যোগবিদ্যা শিক্ষা শুরু করেন। এবং গুরুর সেবায় মগ্ন হয়ে যান। সেবায় তুষ্ট হয়ে অঘোড়নাথ মাধো দাসকে যোগের গূঢ় বিষয় ও জাদু বিদ্যার শিক্ষা প্রদান করেন। অঘোড়নাথের মৃত্যুর পর মাধো দাস গোদাবরী নদীর তীরে নানদেড় নগরে এক সুন্দর আশ্রম স্থাপন করেন। এখানেই মাধো দাস ঋদ্ধি-সিদ্ধি- যন্ত্র-মন্ত্র ও চমৎকারী শক্তির সাধনায় মগ্ন হন। এবং স্বল্প সময়ে পার্শ্ববর্তী এলাকাতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।তাঁর নতুন নাম হয় মাধো দাস বৈরাগী। এই সময়ে কিছু মানুষ তাদের দুঃখ কষ্ট দূর করার জন্য মাধো দাস বৈরাগীর শক্তিকে ব্যবহার করতে শুরু করলে মাধো দাস অভিমানী হয়ে ওঠেন এবং কখনও কখনও তিনি রুদ্রমূর্তি ধরে মানুষজনকে ভয় দেখাতেও শুরু করেন। যার ফলে তাঁর মহিমার বিকৃত স্বরূপ অনেকে প্রচার করতেও শুরু করেন। এদিকে সেসময় ঔরঙ্গজেবের শাসন চলছে।
মুসলিমদের অত্যাচারের সমগ্র উত্তর ভারত জর্জরিত।হিন্দুরা মুসলিম শাসন হতে মুক্তি চাইছে। এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সেই সময় দশম শিখ গুরু শ্রী গুরু গোবিন্দ সিং এর নেতৃত্বে খালসা বাহিনী গড়ে ওঠে।সেসময় আনন্দপুর সাহিব এলাকা শিখ ভাতৃত্ববোধের পীঠস্থান হয়ে ওঠে ও প্রভূত উন্নতি করে।যা মুসলিম শাসকদের চক্ষুশূল এর কারণ হয়। তাই কোনো কারণ ছাড়াই মুসলিমরা গুরু গোবিন্দ সিং এর দুর্গ আক্রমণ করে 1695 সালের এক শীতের রাতে। নির্মম ভাবে চারদিক থেকে ঘিরে ধরে যুদ্ধ নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলিমরা আক্রমণ করে। এবং ছলনার দ্বারা গুরু গোবিন্দ সিং কে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়। যুদ্ধে গুরু গোবিন্দ সিং এর দুই পুত্র অজিত সিং(17)ও জুঝার সিং (14) বীরগতি প্রাপ্ত হন।গুরু গোবিন্দ সিং এর ছোট দুই পুত্র জোরোয়ার সিং (9)ও ফতেহ সিং (7) এবং গুরু গোবিন্দ সিং এর মাতা গুজরি কে বন্দী বানায় দুষ্টু উজির খান। ওই ছোট দুই শিশুকে ইসলাম গ্রহণ করতে বলা হয়। তারা কোনমতেই ইসলাম গ্রহণ করবে না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়।ফলে 1704 সালের 26 শে ডিসেম্বর সারহিন্দ এ উজির খানের দরবারের সামনেই ছোট দুই শিশুকে দেওয়ালে জীবন্ত পুঁতে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। এইভাবে গুরু গোবিন্দ সিং চার পুত্রই বীরগতি প্রাপ্ত হন। এর কিছু সময় পরে গুরু গোবিন্দ সিং দক্ষিণ ভারতে ধর্ম প্রচারে আসেন। এবং স্থানীয় লোক মুখে তিনি জানতে পারেন যে গোদাবরী নদীর তটে এক বৈরাগী সন্ন্যাসী আছেন যিনি সাধনার দ্বারা সিদ্ধি প্রাপ্ত করেছেন।এবং এই সন্ন্যাসী অভিমানী প্রকৃতির। এই কথা শুনে গুরু গোবিন্দ সিং এর মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। তিনি সেই সাধু অর্থাৎ মাধো দাস বৈরাগীর সাথে সাক্ষাৎ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। অতঃপর গুরু গোবিন্দ সিং তাঁর শিষ্যদের নিয়ে নানদেড় এ মাধো দাস বৈরাগীর মনোরম আশ্রমে পৌঁছে যান। সেই সময় আশ্রমে মাধো দাস বৈরাগী ছিলেন না। তিনি আশ্রমের পাশে নদীর তটে ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। মাধো দাস বৈরাগীর শিষ্যরা গুরু গোবিন্দ সিং এর ঠিকমত আতিথেয়তা করছেন না, এই বলে গুরু গোবিন্দ সিং তাঁর শিষ্যদের দুপুরের ভোজন প্রস্তুত করতে আদেশ দিলেন ঐ আশ্রমেই। গুরু গোবিন্দ সিং আদেশ দিলেন ছাগলের মাংস রান্না করতে।এবং সেই মতো আশ্রমের প্রানি হত্যা করে রান্নাবান্না চলল জোরকদমে। আর মাধো দাস বৈরাগীর শয়ন কক্ষে বসে বসে গুরু গোবিন্দ সিং তার শিষ্যদের আদেশ দিতে ও সমস্ত বিষয় পর্যবেক্ষন করতে লাগলেন। আশ্রম এ অবস্থিত মাধো দাস বৈরাগীর শিষ্যরা সমস্ত কিছু দেখেও কিছু বলতে পারলো না।শিখ শিষ্যরা উক্ত আশ্রমের প্রায় সম্পুর্ন দখল নিয়ে নিল। অবশেষে মাধো দাস বৈরাগীর কাছে খবর গেল যে আপনার আশ্রমে একজন তেজস্বী এবং পরাক্রমী পুরুষ এসেছেন। এবং তিনি পুরো আশ্রম দখল করে রেখেছেন ও প্রাণী হত্যা করে মাংস রান্না করছেন। মাধো দাস বৈরাগী অতিসত্বর আশ্রমে পৌঁছালেন। এবং তাঁর জাদু ও মন্ত্রের দ্বারা গুরু গোবিন্দ সিং যে খাটে বসে ছিলেন তা উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন ।তাঁর মন্ত্র শক্তি কোন কাজ করল না।লছমন দাস মাধো দাস বৈরাগী বুঝলেন ইনি কোন সাধারণ পুরুষ নয়।
সৌম্যকান্তি ও নির্ভয় ব্যক্তিত্ব দেখে মাধো দাস জিজ্ঞাসা করলেন- আপনি কে প্রভু ? গুরু গোবিন্দ সিং বললেন- “আমি সেই ,যার জন্য তুমি দীর্ঘ সময় ধরে প্রতীক্ষা করছো” এরপর কিছুক্ষন চুপ থেকে মাধো দাস বললেন -আপনি কি গুরু গোবিন্দ সিং? গুরু গোবিন্দ সিং বললেন -তুমি ঠিকই চিনতে পেরেছ।মাধো দাস বললেন- “আপনার দর্শন পাওয়ার বড় ইচ্ছা ছিল,তা যে এইভাবে হবে তা বুঝতে পারিনি,গুরু এসেছে শিষ্যের কাছে। আমি আপনার ‘বান্দা’ প্রভু। আপনি বলুন আপনার কি সেবা করতে পারি?” মাধো দাস বৈরাগী গুরু গোবিন্দ সিং এর চরণে দণ্ডবৎ প্রণাম করলেন এবং প্রণাম শেষে বললেন-প্রভু আপনি যে আমার আশ্রমে প্রাণী কেটে হত্যা করে ভোজন প্রস্তুত করছেন এটা তো পাপ!!! গুরু গোবিন্দ সিং বললেন-আর মুসলিমরা যে নির্দোষ দের কচুকাটা করছে তা পাপ নয়? তাতে তোমার হৃদয় কাঁপে না? তুমি যদি সত্যিকারে আমার ‘বান্দা’ হয়ে থাকো তাহলে সংসারে অনীহা কেন? যে সময় বিধর্মীরা হিন্দুদের হত্যা করছে, নারীদের মর্যাদা লংঘন করছে, শিশুদের দেওয়ালে জ্যান্ত পুঁতে ফেলছে ,তখন তোমার মত তেজস্বী লোক যদি হাতিয়ার ফেলে সন্ন্যাস নেয়,তাহলে সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে কে? এই সময় তোমার মত বলিষ্ঠ যোদ্ধার একান্তে ধ্যানের সময় নয়।সময় এসেছে তরোয়াল ধরার।বলিদানই তোমার তপস্যা হওয়া উচিত। এবং সেটাই হবে সবচেয়ে বেশি ফলদায়ক। মাধো দাস বৈরাগী বিনীত ভাবে বলল- প্রভু, আমি আপনার ‘বান্দা’। আমি বুঝতে পারিনি আমার সঠিক মার্গ কি হওয়া উচিত,তা আপনিই বলুন। তবে আমি এও বুঝে গেছি যে, চরিত্রগত দিক থেকে আমি একজন সাধু ও কর্তব্যের দিক থেকে আমি একজন সিপাহী হতে চলেছি। গুরু গোবিন্দ সিং এরপর মাধো দাস কে গুরু দীক্ষা দেন ও মাধো দাস কেশধারী সিং এ পরিণত হন। গুরু গোবিন্দ সিং এর শিষ্যরা লছমন দাস মাধো দাস বৈরাগীর নাম রাখেন গুরু বক্স সিং। কিন্তু মাধো দাস নিজেকে গুরু গোবিন্দ সিং এর ‘বান্দা’ বলেই পরিচয় দিতে থাকেন। এবং মাধো দাস এর নতুন নাম হয় বান্দা সিং।পরবর্তীতে তাঁর যুদ্ধ কৌশল ও রণনীতি দেখে গুরু গোবিন্দ সিং তাঁকে বাহাদুর উপাধি দেন।তখন থেকে মাধো দাস ‘বান্দা সিং বাহাদুর’ নামেই পরিচিত হয়। আর এইভাবে ইতিহাসের পাতায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার জন্ম হয়- বান্দা সিং বাহাদুর। গুরু গোবিন্দ সিং তাঁর উত্তরাধিকারী ও খালসা বাহিনীর প্রমুখ হিসেবে বান্দা সিং বাহাদুরকেই মনে মনে নির্বাচন করে ফেলেন। এর জন্য তিনি বান্দা সিং এর বিশেষ প্রশিক্ষণ শুরু করেন। খালসা বাহিনীর (মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গুরু গোবিন্দ সিং এর তৈরী করা বাহিনী) একজন যোদ্ধার প্রশিক্ষণ ছিল শাস্ত্র ও শস্ত্র উভয় বিষয়েই। প্রশিক্ষণ শেষ হলে সমস্ত শিষ্যদের নিয়ে আলোচনায় বসেন গুরু গোবিন্দ সিং এবং বান্দা সিং এর প্রশংসা করেন সকলেই। এরপর গুরু গোবিন্দ সিং তাঁর নিজের বেল্ট ও তরবারি বান্দা সিং বাহাদুর কে পরিয়ে দেন।এবং আশীর্বাদ করেন- তোমার মাধ্যমেই খালসা প্রথা জীবিত থাকবে। বাহাদুর উপাধি দিয়ে বান্দা সিং কে পাঞ্জাবের অভিমুখে সৈন্য নিয়ে রওনা হতে বলে গুরু গোবিন্দ সিং বিদায় নেন। গুরু গোবিন্দ সিং কে বিদায় জানিয়ে বান্দা সিং বাহাদুর পাঞ্জাবের দিকে যাত্রা করেন। এর কয়েকদিন পরেই গুরু গোবিন্দ সিং দেহত্যাগ করেন। যাবার পথে তিনি অন্য সৈন্যদের কাছ থেকে শোনেন মুসলিম শাসকরা কিভাবে গুরু তেগ বাহাদুর সিং ও গুরু গোবিন্দ সিং এর চার পুত্রকে হত্যা করেছে। যা শুনে বান্দা সিং বাহাদুর আরো দৃঢ় ও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠেন।এবং মোঘল শাসকের অবসানের প্রতিজ্ঞা করেন। এইভাবে প্রতিজ্ঞা ও ক্রোধকে তিনি বীরত্বে বদলে দেন। পথে গোয়ালিয়রের এক গাঁয়ে ডাকাতের ভয়ে ভীত গ্রামবাসীকে তিনি রক্ষা করেন। এবং ওই ডাকাত কে হত্যা করেন। ফলে বেশকিছু গ্রামবাসী ও তাঁর সৈন্যবাহিনীতে যুক্ত হয়।এই গ্রামবাসীকে তিনি কয়েক দিনের জন্য সেনা প্রশিক্ষণও দেন। পথে অনেক ছোট ছোট গ্রামের নানা সমস্যা মিটিয়ে ফেলতে তিনি সমর্থ হন। ও বহু মানুষ তাঁর এই খালসা প্রথা কে সম্মান জানায় ও যুক্ত হয়। প্রাথমিকভাবে তার মূল লক্ষ্য ছিল সিরহিন্দ এ গুরু গোবিন্দ সিং এর শিশু পুত্রের হত্যাকারী উজির খানকে শিক্ষা দেওয়া। কিন্তু রাস্তায় পাঞ্জাবের মাঝা এলাকায় শের মোহাম্মদ খানের সঙ্গে তাঁর বাহিনীর যুদ্ধ হয়। যাতে শের খান সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়।এবং মৃত্যুবরণ করে। সরহিন্দের সুবেদার উজির খান খালসা দলের সেনা নায়ক বান্দা সিং বাহাদুর কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। উজির খান দিল্লি থেকে ও সাহায্য চান। মিত্র রাজ্য ও অন্যান্য মুসলিম শাসকদের এক করে তিনি জেহাদ ঘোষণা করেন বান্দা সিং বাহাদুরের বিরুদ্ধে। প্রচুর তোপ ও গোলা বারুদ সংগ্রহ করতে থাকে উজির খান। ভীত উজির খান সামান্য কিছু শিখ সৈন্যদের জন্য প্রায় এক লক্ষেরও বেশী সৈন্য একত্র করেন।এবং ছলনার দ্বারা খালসা বাহিনীর খবর সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
বান্দা সিং বাহাদুর ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করেন। এবং এজন্য তিনি মাঝা এলাকা হতে সেনা বাহিনীতে ভর্তি শুরু করেন।অবশেষে 1710 সালের 12ই মে Battle of Sirhind বা সিরহিন্দ এর যুদ্ধে সুকৌশলে বান্দা সিং বাহাদুর বিশাল মোঘল বাহিনীকে পরাস্ত করেন। এক্ষেত্রে তিনি বুদ্ধি ও মোঘলদের মতো ছলনার আশ্রয় ও নেন। উজির খানের মৃত্যু হয়। গুরু গোবিন্দ সিং এর দুই পুত্র কে যেখানে জীবন্ত দেওয়ালে পুঁতে ফেলা হয়েছিল সেই স্থানে গিয়ে বান্দা সিং বাহাদুর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। সিরহিন্দ এ খালসা নিয়ম চালু হয়। এবং শিখ রাজ্য গঠিত হয়। এরপর বান্দা সিং বাহাদুর মালেরকোটলা এলাকা দখল করেন।এবং লাহোর অভিমুখে অভিযান শুরু করেন। পথে বহু নিম্নবর্ণের হিন্দুরা খালসা বাহিনীতে এসে যুক্ত হয়। একের পর এক অনেক মুসলিম রাজ্য তিনি দখল করেন। মালেরকোটলার পথে তিনি এক পূন্য কাজ সম্পন্ন করেন। 1704 সালের ডিসেম্বরে শিখদের সাথে যুদ্ধে শের মুহাম্মদ খান এক শিখ নারীকে হত্যা করে লুকিয়ে কবর দিয়েছিলেন। বান্দা সিং বাহাদুর খনন করে ওই মহিলার শিখ পরম্পরা অনুযায়ী সংস্কার সম্পন্ন করেন। এইভাবে বান্দা সিং বাহাদুরের অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার সামনে বহু রাজ্য নতিস্বীকার করে। পাঞ্জাব ও আশেপাশের বহু এলাকা থেকে অনেক মানুষজন বান্দা সিং বাহাদুরের খালসা বাহিনীতে যোগ দেয়।বান্দা সিং বাহাদুর অনেকগুলি যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধ গুলি হল- Battle of Sonipat, Battle of Samana, Battle of Chappar Chiri, Battle of Sadhaura,Battle of Lohgarh, Battle of Jammu, Battle of Rahon, Battle of Jalalabad, Battle of Gurdas Nangel,Battle of Sirhind প্রভৃতি। সমস্ত পাঞ্জাব ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা তে বান্দা সিং বাহাদুরের জয়জয়কার হতে থাকে।এরমধ্যে বান্দা সিং বাহাদুর এক পার্বত্য রাজার কন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের অববহিত পরেই তিনি আবার মোঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। পাঞ্জাব ও পূর্ব লাহোর এলাকাতে শিখদের এই আধিপত্য কোন মতেই মেনে নিতে পারছিলেন না দিল্লির বাদশা বাহাদুর শাহ। তিনি তখন রাজস্থানের যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু বান্দা সিং কে হত্যা করার পরিকল্পনা করে তিনি পাঞ্জাব অভিমুখে রওনা দিলেন।বান্দা সিং বাহাদুরকে পরাস্ত করতে ও হত্যা করতে পুরো ইম্পিরিয়াল ফোর্সং সংগঠিত হয়। সমস্ত জেনারেলকে সম্রাটের সেনাবাহিনীতে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হয়।সৈন্য শিবিরে কোনো শিখ এজেন্ট আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে 1710 সালের 29শে আগস্ট সমস্ত হিন্দুদের দাড়ি কাটার আদেশ জারি করা হয়,মোঘল শাসকের তরফ থেকে। কারণ শিখরা কোনমতেই দাড়ি কামাবে না,তা মোঘলরা জানতো। বান্দা সিং যখন উত্তরপ্রদেশে ছিলেন সেই সুযোগে মোঘল বাহিনী সিরহিন্দের আশেপাশের অঞ্চলে এসে লুকিয়ে থাকে।এবং আদেশ দেয় যে শিখ দেখতে পেলেই গলা কেটে হত্যা করতে হবে। বান্দা সিং খবর পেয়ে রাতেই দুর্গের বাইরে চম্পা বনে এসে আশ্রয় নেন।এবং সৈন্য বাহিনীকে একত্র করে বীর যোদ্ধার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন। বান্দা সিং এর বাহিনীর রণকৌশলে রীতিমতো ঘাবড়ে যায় মোঘলরা।তারা পিছু হটতে থাকে, কিন্তু তাদের সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রচুর।দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলতে থাকে। অবশেষে ,1715 সালের মার্চ মাসে আব্দুস সামাদ খান যিনি লাহোরের গভর্নর ছিলেন, তাঁর সৈন্য বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করতে করতে তাদের চালাকিতে বান্দা সিং ও শিখ সৈন্যরা গুরুদাস নানগল(গুরুদাসপুর,পাঞ্জাব) গ্রামে এসে পৌঁছায়। নানগলের এই দুর্গকে শিখ সৈন্যরা আট মাস ধরে আগলে রাখে। কিন্তু প্রবল খাদ্যাভাব দেখা দেয়। বহু সৈন্য না খেতে পেয়ে মারা যান। অনেকে দূর্গের দেওয়ালের গায়ে গজিয়ে ওঠা লতা-পাতা , গুল্ম ও কীটপতঙ্গ খেয়ে কোনমতে জীবনধারণ করতে থাকে। মোঘলরা তাদের সমস্ত দিক থেকে ঘিরে ধরে পাশবিকভাবে জল ও খাদ্যের যোগান বন্ধ করে দেয়।যা ছিল সম্পূর্ণ যুদ্ধ নীতি বিরুদ্ধ। অবশেষে 1715 সালের 7 ই ডিসেম্বর বান্দা সিং বাহাদুর ও বেঁচে থাকা শিখ সৈন্যদের বন্দী বানায় মুসলিম শাসকরা। এবং একটি লোহার শক্তপোক্ত খাঁচাতে করে বান্দা সিং বাহাদুরকে হাতির পিঠে করে শোভাযাত্রার মত করে অপমান করতে করতে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয়। পেছনে পেছনে 780 জন বন্দী শিখকে সারা রাস্তা চাবুক মারতে মারতে দিল্লির দিকে শোভাযাত্রা করে মুসলিমরা নিয়ে আসে যাতে শিখরা ভীত ও লজ্জিত হয়। 2000 শিখ সৈন্যের কাটা মুন্ডু ও বর্শার ডগাতে করে নাচাতে নাচাতে নিয়ে আসা হয়। এবং প্রায় 700 জন শিখ সৈন্যের ক্ষত বিক্ষত দেহ সারা রাস্তাসহ দিল্লির দূর্গের সামনে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
যাতে ভীত হয়ে বাকি শিখরা ইসলাম গ্রহণ করে ,এই উদ্দেশ্যে। সারা রাস্তা জুড়ে এইভাবে নারকীয় কান্ড ও জঘন্য মানসিকতার বার্তা বয়ে নিয়ে পৌঁছালো বান্দা সিং বাহাদুর ও নিরীহ শিখরা এবং নরখাদকের দল। C.R.Wilson’s লিখেছেন -“Malice did its utmost to cover the vanquished with ridicule and shame……..a dead cat on a pole,Banda himself, dressed out of mockery in a turban of red cloth,embroidered with gold,and a heavy robe of brocade flowered with pomegranates, sat in an iron cage, placed on the back of an elephant…………After him came the other 740 prisoners………The road to place, for several miles was lined with troops and filled with exultat crowds,who mocked at the teacher (Guru) and laughed at the grotesque appearance of his followers. They wagged their heads and pointed the finger of scorn at the poor wretched a they passed. HU!HU!HU! infidel dog worshippers your day has came. “ প্রায় তিন মাস বান্দা সিং বাহাদুর ও তাঁর চার বছরের শিশু পুত্র অজয় সিং সহ অন্য শিখদের বন্দী বানিয়ে জেলে রাখা হয়। এবং নিত্যদিন ইসলাম কবুল করার জন্য নানারকম অত্যাচার করা হতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় একজন কেও মুসলিমরা তাদের ধর্ম দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়নি। রাগে ক্রোধে তখন বাহাদুর শাহ পাগল হয়ে যান। জীবনে তিনি প্রথম হার মানলেন বলেই মনে হয়, কারণ তিনি অবাক হলেন এই দেখে যে এত অত্যাচার সহ্য করেও কেউ ইসলাম কবুল করলো না।এমনকি চার বছরের ছোট্ট শিশুটি ও। অবশেষে 1716 সালের 9ই জুন রবিবার সকলকে জবাই করার পরিকল্পনা করল মোঘলরা।বিশাল সভা বসল। এবং সকলকে শেষবারের মতো ইসলাম কবুল করতে বলা হলো। কিন্তু কোন লাভ হল না। তখন শিখ সৈন্যদের পশুর মাংস যেমন কাটা হয়, ঠিক একই রকম ভাবে বড় কাঠের টুকরোর(গুঁড়ি) ওপর শিখদের মাথা রেখে, গলা থেকে শরীর আলাদা করে একে একে সকলকে হত্যা করা হলো। রক্তের বন্যা বয়ে গেল। আর কাটা মুন্ডু ও শরীরের ছিন্ন ভিন্ন অংশ বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইল। এক নারকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো ওই দিন।এদিকে এক কোণে পিছমোড়া করে বেঁধে বসিয়ে রাখা হয়েছিল বান্দা সিং বাহাদুরকে, যাতে সে নিজের চোখে এই হত্যালীলা দেখে যেতে পারে। এরপর বান্দা সিং কে একটি তরোয়াল দিয়ে তাঁর পুত্র অজয় সিং কে হত্যা করতে বলা হলো। বান্দা সিং বাহাদুর চুপ করে থাকলেন। পৃথিবীর সবথেকে জঘন্যতম পাপ মনে হয় আর কিছু হয়না।4 বছরের শিশুকে ও ইসলাম কবুল করতে বলা হলো কিন্তু সেও তার পিতার মতো মাথা উঁচু করে নিজের ধর্মকেই শ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করল। এবার জল্লাদ ছুটে এসে সজোরে বান্দা সিং বাহাদুরের 4 বছরের পুত্র অজয় সিং এর বুকে তরোয়াল দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করল। ও সেই শিশুর রক্তমাখা হৃদপিণ্ড বান্দা সিং এর মুখে ও সারা শরীরে মাখিয়ে দিল। এর থেকে নির্মম আর কিছু হতে পারে বলে মনে হয় না ।এরপর বান্দা সিং এর দুই চোখে গরম লোহার রড ঢুকিয়ে ও সারা শরীরে গরম চিমটে দিয়ে চামড়া তুলে ও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হলো।এই হত্যার সাক্ষী থাকল প্রকৃতি – আকাশ- বাতাস আর স্বয়ং ঈশ্বর। বীরগতি প্রাপ্ত হলেন লছমন দাস ওরফে মাধো দাস বৈরাগী ওরফে বান্দা সিং বাহাদুর। এরপর তাঁদের শরীরের টুকরো গুলি কি করা হয়েছিল? Mohammed Hansi বলছেন-” Their bodies were loaded on wagons and taken out of town to be thrown to the vultures. The heads were hung up on trees or on poles near the market place to be a lesson to all rebels.” বান্দা সিং বাহাদুরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে দিল্লির কুতুবমিনারের কাছে মেহেরৌলি এলাকাতে যেখানে তাঁদের হত্যা করা হয়েছিল ও তাঁর চার বছরের শিশুকে জবাই করা হয়েছিল, সেখানে Gurdwara Shahidi Asthaan Baba Banda Singh Bahadur অবস্থিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বান্দা সিং বাহাদুর কে নিয়ে লেখা বন্দী বীর কবিতায় লিখেছেন—-
………………
এসেছে সে এক দিন
লক্ষ পরানে শঙ্কা না জানে, না রাখে কাহারো ঋণ —
জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য,চিত্ত ভাবনাহীন।
পঞ্চনদীর ঘিরি দশ তীর এসেছে সে এক দিন।।
দিল্লিপ্রাসাদ কূটে
হোথা বার বার বাদশাজাদার তন্দ্রা যেতেছে ছুটে।
কাদের কন্ঠে গগন মন্থে, নিবিড় নিশীথ টুটে–
কাদের মশালে আকাশের ভালে আগুন উঠেছে ফুটে?
…………………..
মোঘল – শিখের রণে
মরন -আলিঙ্গনে
কন্ঠ পাকড়ি ধরিল আঁকড়ি দুইজনা দুইজনে–
দংশনক্ষত শ্যেনবিহঙ্গ যুঝে ভুজঙ্গ-সনে।
সেদিন কঠিন রণে
‘ জয় গুরুজীর’ হাঁকে শিখ-বীর সুগভীর নিঃস্বনে।
মত্ত মোগল রক্তপাগল ‘দীন দীন’ গরজনে।।
গুরুদাসপুর গড়ে
বন্দা যখন বন্দী হইল তুরানি সেনার করে,
সিংহের মতো শৃঙ্খলগত বাঁধি লয়ে গেল ধরে
দিল্লি নগর’- পরে।
বন্দা সমরে বন্দী হইল গুরুদাসপুর গড়ে। ।
সম্মুখে চলে মোগল সৈন্য উড়ায়ে পথের ধূলি
ছিন্ন শিখের মুণ্ড লইয়া বর্শাফলকে তুলি–
শিখ সাত শত চলে পশ্চাতে, বাজে শৃঙ্খলগুলি।
রাজপথ’- পরে লোক নাহি ধরে,বাতায়ন যায় খুলি।
শিখ গরজয় ‘গুরুজীর জয়’ পরানের ভয় ভুলি।
মোগলে ও শিখে উড়ালো আজিকে দিল্লি পথের ধূলি। ।
পড়ি গেল কাড়াকাড়ি–
আগে কেবা প্রান করিবেক দান,তারি লাগি তাড়াতাড়ি।
দিন গেলে প্রাতে ঘাতকের হাতে বন্দীরা সারি সারি
‘জয় গুরুজীর ‘ কহি শত বীর শত শির দেয় ডারি। ।
সপ্তাহকালে সাত শত প্রান নিঃশেষ হয়ে গেলে
বন্দার কোলে কাজি দিল তুলি বন্দার এক ছেলে–
কহিল, ‘ইহারে বধিতে হইবে নিজ হাতে অবহেলে।’
দিল তার কোলে ফেলে–
কিশোর কুমার,বাঁধা বাহু তার ,বন্দার এক ছেলে।।
কিছু না কহিল বাণী,
বন্দা সুধীরে ছোটো ছেলেটিরে লইল বক্ষে টানি।
ক্ষণকালতরে মাথার উপরে রাখে দক্ষিণপানি,
শুধু একবার চুম্বিল তার রাঙা উষ্ণীষখানি।
…………………….
বালকের মুখ চাহি
‘জয় গুরুজীর ‘কানে -কানে কয়,’রে পুত্র, ভয় নাহি।’
নবীন বদনে অভয়কিরণ জ্বলি উঠে উৎসাহি–
কিশোর কণ্ঠে সভাতল, বালক উঠিল গাহি
‘জয় গুরুজীর,কিছু নাহি ভয়’ বন্দার মুখ চাহি। ।
………………….
‘গুরুজীর জয় ‘ কহিয়া বালক লুটালো ধরনীতলে। ।
সভা হল নিস্তব্ধ।
বন্দার দেহ ছিঁড়িল ঘাতক সাঁড়াশি করিয়া দগ্ধ।
স্থির হয়ে বীর মরিল, না করি ‘একটি কাতর শব্দ।
দর্শকজন মুদিল নয়ন,সভা হল নিস্তব্ধ। ।
ড.সুমন পানিগ্রাহী (Dr. Suman Panigrahi)
তথ্যঋণঃ 1.জতথেদার বান্দা সিং বাহাদুর (হিন্দি),জসবীর সিং।
- সঞ্চয়িতা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
- উইকিপিডিয়া ।
চিত্রঋনঃ গুগুল ইমেজ।