
এক ছাত্র আমাকে বলল, ‘আমাদের যিনি ইংরাজির টিউটর, তিনি ক্রিশ্চান। উনি হিন্দু দেবদেবীদের নিয়ে খুব আজেবাজে কথা বলেন। আর বলেন, ‘কৃষ্ণ তো সর্বশক্তিমান ঈশ্বর, তিনি তো যুদ্ধটা আটকাতে পারতেন। তা না করে এমন রক্তক্ষয় হতে দিলেন কেন? তাহলে তিনি কিসের ঈশ্বর?’
“তার উত্তরে তুমি কি বললে”?
ছাত্র – ‘কিছু তেমন বলতে পারিনি। ওঁর সাথে আমার এমন age difference, শ্রদ্ধা দেখাতে হয়’।
ছাত্রের মা বললেন, ‘আমিও বলি, তুই তর্ক করতে যাস না। হয়ত খাতায় নম্বর কমিয়ে দেবে’।
ছাত্রটির দিকে তাকিয়ে বললাম, “দুদিন পরে যদি তোমার নিজের মায়ের চরিত্র নিয়ে তিনি কথা বলেন, তখনও তুমি age difference’র কথা ভেবে চুপ করে থাকবে? তোমার ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে কথা বলছেন মানে তো তোমার স্বদেশরূপী মা’কে নিয়েই বলা হচ্ছে। বয়স দিয়ে শ্রদ্ধা আসে না গুণ ও কর্ম দিয়ে আসে? যিনি অপরকে শ্রদ্ধা করতে পারেন তিনিই শ্রদ্ধা অর্জন করার অধিকারী হন।

তোমার ইংরাজির টিউটরকে জিজ্ঞাসা কোর, তাহলে শ্রীকৃষ্ণের কী করা উচিত ছিল? পাণ্ডবদের বোঝানো উচিত ছিল? যুদ্ধ না ক’রে হে পাণ্ডবগণ, তোমরা আবার জঙ্গলে পালিয়ে যাও! যেমন অধর্ম চলছিল চলুক। পরের ধন হরণ করে যে দুর্জন, সেই দুর্যোধনের রাজ্যে জনগণের প্রাণ ওষ্ঠাগত হোক, ওসব নিয়ে তোমাদের মাথা ঘামাতে হবে না। অপশাসনের পরাকাষ্ঠা যে দুঃশাসন তার অত্যাচারে নাভিশ্বাস উঠে যাক, হে ভীম, তুমি তার রক্তপানের আশা ত্যাগ করে জঙ্গলে ছাগদুগ্ধ পান করা অভ্যেস কর। আগামীতে ক্রিশ্চানরা ও যুক্তিবাদীরা যেন আমার বদনাম না করতে পারে। এক গালে চড় খেয়ে অপর গাল বাড়িয়ে দেওয়ার তত্ত্ব যাতে ওরা আমার নামে চালাতে পারে?
অথবা তোমরা একটা কাজ কর পাণ্ডবগণ। তোমরা কৌরবদের তৈরি করা স্কুলের মাস্টার হও, কৌরবদের অফিসের কেরানি হও, কৌরব নেতাদের চাটুকার হও, কৌরব মিডিয়ার সঞ্চালক হও, কৌরবদের ভাড়া করা বুদ্ধিজীবি হও। ওদের খুশি করে চলতে পারলে অন্ধ রাজার সাথে করমর্দন করতে পারবে, চোখে ফেট্টি বাঁধা রাণীর হাত থেকে শংসাপত্রও জুটে যাবে। নিদেনপক্ষে গান্ধারের রাজ্যপালও করে দিকে পারেন সেই বিখ্যাত মামা। মাঝেমধ্যে বেতন বাড়ানোর তাগিদে বা চাকরি জোটাতে সত্যাগ্রহ করবে, আইন অমান্য করবে, দুদিনের অনশন করবে।
দ্যাখো বাপু, নৃশংসতা কৌরবদের ধর্ম। ওদের শাস্ত্রে অপহরণ, দুর্নীতি, বলাৎকার ও অনাচারের অনুমতি আছে। তোমাদের তো তা নেই। তোমাদের শিখতে হবে আপোস, ভীরুতা, দুর্বলতা। কাপুরুষতাকে তোমরা শান্তিকামীতা বলে চালাবে। অধর্ম যখন বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে, তখন তার কাছে নতিস্বীকার করাই হচ্ছে বুদ্ধিজীবিদের কাছে প্রশংসিত হওয়ার উপায়।

রাধাকৃষ্ণের মধুর লীলা স্মরণ ক’রে বৈষ্ণবরা মশগুল হয়ে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণ নিজে কোনদিন খঞ্জনি বাজিয়ে কীর্তন করেছেন বলে শোনা যায়নি। তিনি ছিলেন প্রখর রাজনীতিবিদ, দূরদর্শী কূটনীতিবিদ ও কুশলী সামরিক নেতা। ভুললে চলবে না যে পাণ্ডবদের দূত হয়ে শান্তি প্রস্তাব নিয়েই তিনি গিয়েছিলেন দুর্যোধনের কাছে। প্রথমে ভদ্র ভাষায় বুঝিয়েছিলেন, সাত্ত্বিক পথ, সাম নীতি। পরে লোভ দেখিয়েছিলেন, পাণ্ডবদের পাঁচটি গ্রাম ছেড়ে দাও, বাকি গোটা রাজ্য তোমাদের, রাজসিক পথ, দান নীতি। ভয় দেখালেন যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে, বিশ্বরূপ ভাব প্রকট করলেন, আরও চরম রাজসিক নীতি। কোন কিছুতেই যখন কাজ হোল না, তখন হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন, তামসিক পথ, দণ্ড নীতি। সাম-দান-দণ্ড ভেদ, উনি নিজেই বলেছেন। ধর্মের পাঠশালায় তোমার আচার্য এখনও শিশু শ্রেণির ছাত্র। শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব নিয়ে প্রশ্ন না তুলে বরং ওই মহতের পদতলে বসে তিনি ধর্মের প্রাথমিক সংজ্ঞার পাঠ নিন।
আর গত দেড় হাজার বছর ধরে শান্তির ধর্ম ছড়িয়ে দিতে ক্রিশ্চানরা কত ক্রুসেড করেছে, কত সংস্কৃতি ধ্বংস করেছে, কত ইনকুইজিশন ক’রে অন্য ধর্মালম্বী মানুষকে হত্যা করেছে, কত স্বাধীন চিন্তা করা নারীদের ডাইনি অপবাদে পুড়িয়েছে, তার হিসেবটা একবার তোমার শিক্ষক মহাশয়কে জিজ্ঞাসা কোর। ওঁর আরাধ্য যীশু যে মহাজনদের অনাচার ও দুর্নীতির বহর দেখে রীতিমত ক্রোধান্বিত হয়ে জেরুজেলমের প্রধান মন্দির ভেঙে ফেলতে উদ্যত হয়েছিলেন, সেখানে তাঁর শান্তি ও ক্ষমার কেমন দৃষ্টান্ত স্থাপন হয়েছিল, সে বিষয়েও আলোকপাত করতে অনুরোধ কোর।
সর্বোপরি, তোমার শিক্ষক ইংরাজিতে পারদর্শী। তিনি সেই বিষয়ের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখুন, ভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলা তাঁর অনধিকার চর্চা। ধর্ম নিয়ে কথা বলবেন ধার্মিক। বাকিরা কথা বলতে গেলে নির্বুদ্ধিতার দুর্গন্ধ বেরোবে”।
ছাত্রের মা’কে বললাম, “আপনি বীরাঙ্গনা মা হয়ে উঠুন। স্বামীজী ও নেতাজীর ছাত্র জীবন দেখুন। কেমন অনাপোসী, প্রতিবাদী, নির্ভীক। আপনার সন্তানকে কয়েকটা নাম্বারের জন্য নিজের চরিত্র বিসর্জন দিতে শেখাবেন না। এগিয়ে দিন তাকে সত্যের পথে, ধর্মের পথে, সাহসের পথে। একজন মা হয়ে দেশের প্রতি, আমাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি এই সামান্য স্বার্থত্যাগটুকু করতে আপনি দায়বদ্ধ”।
🇮🇳- জয়দীপ

