বাংলায় একটি প্রচলিত প্রবাদ, “গা নষ্ট কানায়, পুকুর নষ্ট পানায়।” একটি পুকুরের মাছচাষ কীভাবে আগাছার দ্বারা ক্ষতি হয়, এ তারই নির্যাস। কিন্তু পুকুর কতখানি নষ্ট হল? যতখানি গ্রাম নষ্ট হয়েছে কানাই বা কৃষ্ণের দ্বারা। হিন্দুর আরাধ্য শ্রীকৃষ্ণকে এখানে সরাসরি ও পরিস্কার নষ্টলোক হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়েছে। এখানেই আসল খেলাটা খেলে রেখেছে সেকুলার হিন্দু আর বিধর্মীদের হাতযশ, পরে দীর্ঘদিনের বামপন্থীদের প্রচেষ্টা তাতে আরও প্রবল ইন্ধন যুগিয়ে এসেছে। কারণ যত হিন্দুধর্মের যোদ্ধা-দেবতার চরিত্রকে কলুষিত করা যায়, ততই তো ধর্মান্তকরণের কাজ হাসিল করাটা সহজতর হবে! কী তাই না? এই বিষয়ে কিছুটা দিকপাত করতেই প্রস্তুত-পোস্ট।
বলা হয়, প্রবাদ লোকসমাজের সৃষ্টি। অনেক সময়ই সৃষ্টিকর্তার সন্ধান পাওয়া যায় না; যদিও প্রবাদ তৈরির প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা এবং প্রগল্পের ইতিহাসে তার উৎস ধরার চেষ্টা দেখা যায়। অনেকসময় অনেক সাহিত্যিকের উল্লেখযোগ্য কথা প্রবাদ-প্রতিম বাক্য বলে স্বীকৃত হয় এবং প্রচলিত হতে থাকে, যেমন “সে কহে অধিক মিছে/যে কহে বিস্তর।” অনেকসময় অনেক লোককবির কবিতা/ছড়ার উল্লেখযোগ্য বাক্য প্রবাদ রূপে আখ্যা পায়; সেখানে লোকসমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তির বিশেষ প্রবণতা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা কাজ করে। “গা নষ্ট কানায়, পুকুর নষ্ট পানায়।” — এমনই একটি বাক্য, যা সমাজের মাথা বলে পরিচিত মানুষের দ্বারা কৃষ্ণ-বিদ্বেষের বিষ হিসাবে থরে-বিথরে প্রকাশিত হতে পারে। এখন এ কাজ কারা করলেন? এর সরাসরি উত্তর না দিয়ে বরং বঙ্কিমচন্দ্রের “কৃষ্ণচরিত্র” গ্রন্থ থেকে কিছু উপযুক্ত উদ্ধৃতি দেওয়া যাক।
কৃষ্ণদ্বেষীদের কাছে যে কথা কৃষ্ণচরিত্রের প্রধান কলঙ্ক রূপে প্রচলিত, তা হল কৃষ্ণের সঙ্গে ব্রজগোপীদের সম্বন্ধের কথা। বঙ্কিম লিখছেন, “মহাভারতে ব্রজগোপীদিগের কথা কিছুই নাই। সভাপর্বে শিশুপালবধ-পর্বাধ্যায়ে শিশুপালকৃত সবিস্তার কৃষ্ণনিন্দা আছে। যদি মহাভারতপ্রণয়নকালে ব্রজগোপীগণঘটিত কৃষ্ণের এই কলঙ্ক থাকিত, তাহা হইলে, শিশুপাল অথবা যিনি শিশুপালবধবৃত্তান্ত প্রণীত করিয়াছেন, তিনি কখনই কৃষ্ণনিন্দাকালে তাহা পরিত্যাগ করিতেন না। অতএব নিশ্চিত যে, আদিম মহাভারত প্রণয়নকালে এ কথা চলিত ছিল না — তাহার পরে গঠিত হইয়াছে।”
এখন দেখা যাক কৃষ্ণচরিত্রের প্রামাণ্য দিকটি কোথায় কোথায় আছে? ব্রহ্মপুরাণের পূর্বভাগে আছে, বিষ্ণুপুরাণের ৫ম অংশে আছে, বায়ুপুরাণে আছে, শ্রীমদ্ভাগবতে ১০ম ও ১১শ স্কন্ধে আছে, ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণের ৩য় খন্ডে আছে, এবং পদ্ম ও বামনপুরাণে ও কূর্মপুরাণে সংক্ষেপে আছে। এই সব পুরাণগুলিই মহাভারতের পর লেখা এবং এর অনেকগুলিই অধুনাতন বা অর্বাচীন বলে স্বীকৃত।
এখন যে ব্রহ্মবৈবর্ত্ত পুরাণ প্রচলিত আছে, তা নতুন গ্রন্থ, প্রাচীন পুরাণ নয়। আর এই ব্রহ্মবৈবত্তপুরাণেই রাধাকৃষ্ণের আদিরসাত্মক স্রোত যেন টগবগিয়ে ফুটছে। বঙ্কিমচন্দ্র রাধাকৃষ্ণের প্রেমরস প্রচার বিষয়ে লিখছেন, “মহাভারতের পর বিষ্ণুপুরাণ দেখিতে হয়, এবং পূর্বে যেমন দেখিয়াছি, এখনও তেমনই দেখিব যে, বিষ্ণুপুরাণ, হরিবংশ এবং ভাগবত পুরাণে উপন্যাসের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি হইয়াছে। এই ব্রজগোপীতত্ত্ব মহাভারতে নাই, বিষ্ণুপুরাণে পবিত্রভাবে আছে, হরিবংশে প্রথম কিঞ্চিৎ বিলাসিতা প্রবেশ করিয়াছে, তাহার পর ভাগবতে আদিরসের অপেক্ষাকৃত বিস্তার হইয়াছে, শেষে ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণে তাহার স্রোত বহিয়াছে।”
এখন দেখা যাক কোন পুরাণ কখন রচিত। উইলসন সাহেবের মতে কোনও পুরাণই সহস্র বৎসরের অধিক প্রাচীন নয়। পুরাণের প্রণয়নকাল তিনি যেভাবে নিরূপণ করেছেন, তার সহায়তা যদি নিই, সেই মতানুসারে বিষ্ণুপুরাণ দশম শতাব্দীতে লিখিত; ভাগবত পুরাণ খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে লিখিত; পদ্মপুরাণ ত্রয়োদশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে লেখা; বামনপুরাণ বঙ্কিম যুগ থেকে ধরলে ৩/৪ শত বৎসরের গ্রন্থ; কূর্মপুরাণও প্রাচীন নয়; বায়ুপুরাণের সময় নিরূপিত না হলেও প্রাচীন বলে লিখিত আছে। এখন ভারতবর্ষে এই সময় কারা শাসন ক্ষমতায় ছিল, তার সুলুকসন্ধান জরুরি হয়ে পড়বে। আরও সুলুকসন্ধান জরুরি এর মধ্যেও কালে কালে নানান প্রক্ষেপণ এসেছে কিনা, কোন শাসনামলে এবং কার দ্বারা।
এদিকে দেখা যাচ্ছে, কৃষ্ণ সম্পর্কে যত নষ্টামির কথা লেখা হচ্ছে তা সবই ভারতবর্ষে মুসলমানী শাসন কালে সংগঠিত হয়েছে। বিদেশি শাসক, যারা বিধর্মীদের উপর শাসনকার্য পরিচালনার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মপ্রচারও চেয়েছিল, তারা হিন্দু সভাসদ পন্ডিত ব্যক্তিকে কী ততখানিই পৃষ্ঠপোষণ করবেন না, যতটা তাদের ধর্মপ্রচার ও নিয়ন্ত্রণের সুবিধা হয়? কানাইকে নষ্টচরিত্র করে তুলতে গল্পগাছা বানিয়ে রাজানুগ্রহ পাওয়ার ইতিহাস কী একেবারেই কষ্টকল্পনা মনে হচ্ছে? মধ্যযুগে বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্যের ধারায় যে সমস্ত কবিরা বিকশিত হয়েছেন তাদের সম্পর্কে তন্বিষ্ঠ পাঠও এক্ষেত্রে জরুরি বলে মনে হয়। তার সঙ্গে রিলেট করাতে হবে তখনকার ধর্মীয় উন্মাদনার সত্যিকারের ইতিহাস। তারপর মিলিয়ে নেওয়া উচিত “গা নষ্ট কানায়, পুকুর নষ্ট পানায়” — এই প্রবাদ কবে কোথায় কীভাবে পরিপুষ্টি লাভ করল! এক শেয়ালের রা, সবাই উচ্চৈস্বরে সমস্বরে করে এসেছে কিনা। বুঝে নেবার দরকার আছে, আমার কৃষ্ণ সত্যিই লম্পট কিনা। মহাভারতে যেভাবে শ্রীকৃষ্ণ উপস্থাপিত, তার সঙ্গে বৃন্দাবন লীলার অতি নষ্টামি মিলিয়ে দেওয়ায় চেষ্টায় গুরুচন্ডালী দোষ হয়ে যাচ্ছে কিনা!
বঙ্কিমচন্দ্র আরও লিখছেন, “মহাভারতে কেবল ঐ সভাপর্বে দ্রৌপদীবস্ত্রহরণকালে, দ্রৌপদীকৃত কৃষ্ণস্তবে ‘গোপীজনপ্রিয়’ শব্দটা আছে…. বৃন্দাবনে গোপীদিগের বাস। গোপ থাকিলেই গোপী থাকিবে। কৃষ্ণ অতিশয় সুন্দর, মাধুর্য্যময় এবং ক্রীড়াশীল বালক ছিলেন, এজন্য তিনি গোপ গোপী সকলেরই প্রিয় ছিলেন। হরিবংশে আছে যে, শ্রীকৃষ্ণ বালিকা যুবতী বৃদ্ধা সকলেরই প্রিয়পাত্র ছিলেন। এবং যমলার্জ্জুনভঙ্গ প্রভৃতি উৎপাতকালে শিশু কৃষ্ণকে বিপন্ন দেখিয়া গোপরমণীগণ রোদন করিত এরূপ লেখা আছে। অতএব এই ‘গোপীজনপ্রিয়’ শব্দে সুন্দর শিশুর প্রতি স্ত্রীজনসুলভ স্নেহ ভিন্ন কিছুই বোঝায় না।”
# শ্রী কল্যাণ গৌতম