অত্যাচারী কংস রাজার নিধন করিতে,
ভাগ্না রুপে জন্ম নিলেন কৃষ্ণ মথুরাতে।
আজ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগের কথা।দ্বাপর যুগ।মথুরাতে তখন দুষ্ট অসুর রাজা কংসের শাসন।রজঃগুণ মিশ্রিত অহংকার ও দর্পে ভারাক্রান্ত হয়ে এসেছিল পৃথিবী। মানব তার মান ও হুঁশকে ভুলে আসুরিক শক্তিতে শক্তিমান হয়ে উঠেছিল।এদিকে অসুর রাজা কংস ছিলেন,খুবুই অত্যাচারী ও বিভিন্ন আসুরিক শক্তির অধিকারী।তাঁর অত্যাচারে স্বর্গ লোকের দেবতাগন সহ সমগ্ৰ মথুরাবাসী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন।দিন-দিন কংসের অত্যাচার এতই বেশি হয়ে ওঠে যে, দেব-দেবীগন পুরুষোত্তম ভগবান বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন।এবং বিষ্ণু তাদের প্রার্থণা স্বীকার করে আকাশে দৈববাণী নিক্ষেপ করেন, ‘হে ব্রহ্মা, আমি খুব তাড়াতাড়ি বাসুদেব ও দেবকীর গর্ভে তৃতীয় বারের জন্য অষ্টম পুত্র সন্তান রুপে পৃথিবীর দুঃখভার লাঘব করিতে মথুরার ধরাধামে অবতীর্ণ হইব কংস বধিতে।এবং অন্ধকার কে বিনাশ করে জগতে আলোর পথ দেখাতে।
এই আকাশবাণী শোনার পর দেবকুলের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। অবশেষে পুরুষোত্তমের আকাশবাণী ফলিত হল। একে একে দেবকীর গর্ভে জন্ম নেওয়া সাত সন্তানকে কংস হত্যা করার পর,অবশেষে দুর্যোগপূর্ণ অর্ধরাত্রে।সময় রোহিনী নক্ষত্র।ভাদ্রমাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথিতে অষ্টম পুত্র সন্তান রুপে মানব জন্ম নিলেন বিষ্ণুর অষ্টম অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।আকাশে তখন বজ্র বিদ্যুৎ-সহ অবিরাম বৃষ্টি ধারা বইতে লাগিল। নিরবিচ্ছিন্ন দুর্যোগময় রাত্রি, অন্য দিকে অত্যাচারী কংসের অত্যাচারে সমস্ত দেবতাগণ উদ্বিগ্ন এবং সদ্বগুণরূপী বসুদেব ও দেবকী কংসের কারাগারে আবদ্ধ।এই রকম একটি দুর্যোগময় দিনে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নিয়েছিলেন মাতা দেবকীর উদরে।সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি মাতাও তাঁর ভাণ্ডার উন্মোচন করে দিয়েছিলেন। চতুর্দিকে এক দিব্যজোতি দেখা গিয়েছিল। বনের পশু, পক্ষী, বৃক্ষ প্রত্যেকেই নিজ নিজ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়েছিল। নদী-সাগরেরও জলতরঙ্গের জোয়ার উঠল। চতুর্দিকে কেবল তখন আনন্দই-আনন্দ। স্বর্গের দেবতারাও স্বর্গলোক থেকে আনন্দের শঙ্খধ্বনি বাজাতে শুরু করলেন এবং পুষ্পবৃষ্টি করিতে লাগলেন। চর্তুভূজ,শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী সুন্দর আকৃতি ও তেজঃপুঞ্জ সেই নবজাতককে দেখতে লাগলেন পিতা বাসুদেব।আর মনে মনে ভাবলেন, ভগবান তাঁর পুত্ররূপ নিয়ে জন্ম নিয়েছেন।সঙ্গে সঙ্গে সেই অর্ধরাত্রিতেই কংস মামার হাত থেকে ভাগ্নে কৃষ্ণকে রক্ষা করার জন্য কংসের কারাগার থেকে পুত্রকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন পিতা বাসুদেব। একে একে বৃহৎ লৌহ কপাট সব খুলে গেল। প্রচণ্ড বজ্রবিদ্যুৎপূর্ণ রাতে অনন্তদেব সহস্র ফনা বিস্তার করে বৃষ্টির হাত থেকে নিস্তারের জন্য বসুদেবের পিছু নিলেন। মথুরাবাসী এবং গোকুল বাসীদের অজান্তে নিশুতি রাতের সমস্ত ঘটনার সাক্ষী রইলেন শুধুমাত্র দেবতাগণ।
আর সেই একই দিনে শুভক্ষনের শুভ তিথিতে গোকুলে যশোদার গর্ভে ঘর আলোকিত করে কন্যাসন্তান জন্ম হয়।বাসুদেব নিজের অষ্টম সন্তানকে গোকুলের নন্দ রাজের ধরম পত্নী যশোধার কাছে রেখে তাঁদের একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিয়ে চলে আসেন কংসের কারাগারে।
কারাগারের রক্ষকগণ নবজাতকের কান্না শুনে কংসকে সংবাদ দিতেই, কংস তৎক্ষনাৎ কারাগারে ছুটে আসেন। এবং কংসকে দেখে ভগ্নী দেবকী করুণ ভাবে পায়ে ধরে বললেন, একে বধ করবেন না দাদা। এর আগেও আপনি আমার সাত পুত্র সন্তানকে বধ করেছেন। এটি আমার কন্যা সন্তান ও শেষ সন্তান। একে ভিক্ষা দিন আমায়। কংস নবজাতিকাকে দেবকীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পা দু’টি ধরে সজোরে পাথরের উপর নিক্ষেপ করেন। তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণের অনুজা সেই কন্যা কংসের হাত থেকে মুক্ত হয়ে অষ্টভূজা দেবী যোগমায়া রুপে আকাশ মার্গে গমন করলেন। আট হাতে ধনু, শূ্ল, বান, চর্ম, অসি, শঙ্খ, চক্র, গদা ধারণ করে কংসকে বললেন, “তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে”।
যোগমায়ার দৈব্যবাণী শুনে অত্যাচারী ভীত কংস কৃষ্ণকে বধ করার জন্য নানা ভাবে বিভিন্ন কৌশলে আসুরিক শক্তি প্রয়োগ করিতে লাগলেন। রাক্ষসী পূতণা কে পাঠালেন বিষমাখা স্তন পান করিয়ে হত্যা করার জন্য। কখনো ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করে তৃণাবধ কে পাঠালেন হত্যা করার জন্য শ্রীকৃষ্ণকে। তো কখনো গরুর পালে গরুর বেশ ধারণ করে বকাসুর কে পাঠালেন। কিন্তু কংস মামার একের পর এক সমস্ত আসুরিক শক্তিকে পরাজিত করলেন ভাগ্নে শ্রীকৃষ্ণ। তাই তো এখনও প্রত্যেক বাঙালীর বাড়িতে মামা যদি রাগী, বদমেজাদি, ও খারাপ গুনের অধিকারী হয় তাহলে সেই মামাকে অত্যাচারী কংস মামার সাথে তুলনা করা হয়ে থাকে।
এদিকে নন্দের গৃহে কৃষ্ণ জন্মগ্ৰহণ করায়, সমস্ত বজ্রবাসী মহানন্দে নন্দ উৎসব পালন করতে লাগলেন। দুধ, দই,মাখনের গন্ধে গোকুলের আকাশ বাতাস মুখরিত হল। কারণ কৃষ্ণের প্রিয় খাবার দই, দুধ ও মাখন।তাই তো কৃষ্ণ ননী চোরা , মাখন চোর প্রভৃতি নামে বিখ্যাত। এখনও জন্মাষ্টমীর দিনে দেশের নানা প্রান্তে কৃষ্ণের ননী চুরির কায়দায় উঁচুতে উঠে হাঁড়ি ভাঙার প্রথা প্রচলন রয়েছে। এছাড়াও এই মাখন চুরিকে কেন্দ্র করে বহু ভক্তিগীত রচনা করা হয়েছে বর্তমান যুগের সঙ্গীত শিল্পে।কোন কোন গীতিকার রচনা করেছেন,
"গোপালকে দড়ি বেঁধে রাখিস নে,ছেড়ে দে মা জননী/মাখন চুরি করুক গোপাল,চুরি করে খাক ননী"।
এছাড়াও রচিত হয়েছে,
” মাখন চুরি ছেলেবেলায়/ মন চুরি তার বড়োবেলায়”।
কারণ, কৃষ্ণের বাল্যকালের জীবনীতে যেমন আমরা মাখন চুরির কথা জানতে পেরেছি। ঠিক তেমনি যৌবনের বয়ঃসন্ধিতে জানতে পারি, বৃন্দাবনের প্রাণের সখী রাধারানীসহ অসংখ্য গোপিনীদের সাথে তাঁর প্রেমময় রাসলীলার কাহিনীও।রাধারানী শুধুই তাঁর প্রাণের সখী নয়, রাধা হলেন শ্রীকৃষ্ণের আত্মা।যিনি পরমাত্মার সাথে মিলিত হয়েছেন।আর রাস কথাটি এসেছে ‘রস’ থেকে। ‘রস’ মানে আনন্দ, দিব্য অনুভূতি, দিব্য প্রেম। ‘লীলা’ অর্থ নৃত্য।তাই রাস লীলার সম্পূর্ণ অর্থ হলো,এক ধরণের বৃত্তাকার নাচ।যা আট,ষোলো, বা বত্রিশ জনে একসাথে সম্মিলিতভাবে উপস্থাপনা করা হয়।
শ্রীমদ্ভাগবতের মতে, বস্ত্রহরণের দিন গোপিনীদের কাছে কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, পরবর্তী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি রাসলীলা করবেন।
“যখন করেন হরি বস্ত্রহরণ, গোপীদের কাছে তিনি করিলেন পণ। / আগামী পূর্ণিমাকালে তাঁহাদের সনে,করবেন রাসলীলা পুণ্য বৃন্দাবনে।।”
বংশী বিহারী শ্রীকৃষ্ণের সুমধুর বংশীধ্বনিতে মুগ্ধ হয়ে গোপিনীবৃন্দ সংসারের সকল মোহ পরিত্যাগ করে বৃন্দাবনে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং সখা শ্রীকৃষ্ণের চরণে নিজেদের তন-মন সমর্পন করেছিলেন। প্রথমে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের স্ব-গৃহে ফিরে যেতে অনুরোধ করে বলেন, তাদের সংসার-ধর্ম পালন করা উচিত। কিন্তু গোপিনীরা নিজেদের মতে দৃঢ় ছিলেন। ভগবান শুধুই ভক্তের। তাই শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের দৃঢ়ভক্তি দেখে তাদের মনোকামনা পূরণার্থে রাসলীলা আরম্ভ করেন। ভারতের উত্তরপ্রদেশের মথুরা,বৃন্দাবন, এবং বাংলায় নদীয়া ও নবদ্বীপ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতি বছরের ন্যায় মহাধূমধামের সহিত পালন হয়ে আসছে এই রাসলীলা অসংখ্য ভক্ত জুড়ে।
এভাবেই গোকুলে বাড়িতে লাগিলেন কৃষ্ণ। এবং ব্রজবাসী ও বৃন্দাবনের রাধিকাসহ গোপিনীদের সাথে বিভিন্ন ধরণের লীলাখেলায় মেতে উঠলেন।কখনো নিজের কড়ে আঙুলে গিরিধারী গোবর্ধন পর্বত ধারণ করিলেন।তো আবার কখনো যমুনা নদীতে থাকা বিষধর কালিয়া নাগ কে শাপমোচন থেকে মুক্তি দিতে নৃত্য করিলেন স্বয়ং যা কালিয়া দমন নামে যমুনা নদীর সেই স্থান পরিচিত।
শ্রীকৃষ্ণকে বধ করার অজস্র কৌশল ব্যর্থ হওয়ায় ক্ষুব্ধ কংস, কৃষ্ণ ও ভাই বলরামকে মথুরায় মল্লযুদ্ধে আমন্ত্রণ জানাই।কংসের নির্দেশে মথুরা থেকে রথ নিয়ে আসেন বৃন্দাবনে কংসের পাঠানো দূত।কৃষ্ণ ও বলরাম মথুরায় যান। এবং যুদ্ধে মল্লযোদ্ধাদের নিহত করেন।এতে কংস আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয়ে যান। এবং কৃষ্ণ ও বলরামকে নির্বাসনে পাঠানোর নির্দেশ দেন।একই সাথে বাসুদেবকে হত্যা করারও নির্দেশ দেন।কংসের এই আদেশ শোনামাত্র কৃষ্ণ সিংহাসন থেকে কংস মামাকে নামিয়ে ছুড়ে আছাড় মেরে হত্যা করেন। এবং মথুরায় সুখ- শান্তি, ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করেন।
জন্মাষ্টমী কেন পালন করা হয়?
ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে হিন্দু সনাতন ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস ও আস্থার সহিত ভক্তিভরে নিজেদের আরাধ্য দেবতা রুপে পূজো করেন। তারা বিশ্বাস করেন, পৃথিবী থেকে দুরাচারী দুষ্টদের দমন করতে আর সজ্জনদের রক্ষা করার জন্যই বারবার ভগবান বিষ্ণুর অবতার স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন। ধর্মগ্রন্থ গীতাও সেই সাক্ষ্য দেয়। হিন্দু পুরাণমতে, ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের অষ্টম তিথিতে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নেন।তাই শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথির দিনটিকেই ভারতের প্রবাসী হিন্দু বাঙালীরা জন্মাষ্টমী উৎসবে মেতে উঠেন। এবং ভক্তিভরে পূজো-পাঠ ও অর্চনার মাধ্যমে মহাধূমধামের সহিত পালন করে আসছেন পরম্পরা অনুযায়ী। কৃষ্ণ ভক্তরা এই দিন ভগবানের নিকট প্রার্থনা করেন, জগতের সমস্ত দুষ্ট শক্তিকে বিনাশ করে যেন আবার শ্রীকৃষ্ণ জগতের সমস্ত শান্তি ফিরিয়ে দেন।তাই শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীর পূণ্যতিথিতে সকল মানুষের উচিত শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে কৃষ্ণ সাধনা করা। বর্তমানে মানুষ কিছু স্বার্থ নিয়ে ডাকে, স্বার্থপূরণ না হলে সেই সব মানুষের কাছে ভগবান মিথ্যে হয়ে যায়। তাই স্বার্থ ত্যাগ করে ভগবানকে নিষ্কাম ভাবে ডাকতে হবে। তবেই ভগবান ভক্তের মাঝে যুগে যুগে অবতীর্ণ হবেন।
কৌশিক দাস