কোলকাতার একটা সুন্দর ছাতা রয়েছে। নামটি তার সুন্দরবন। বিশ্বখ্যাত এই অঞ্চলটি আমাদের ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে রক্ষা করে বলেই এটাকে বলা হয় ছাতা। কেউ কেউ আবার বলে এই ছাতাটা না থাকলে কোলকাতাটাই নাকি একদিন উড়ে যেত। গ্রীষ্ম-মন্ডলীয় ঝড়ঝাপটা (Tropical Cyclone) অনেকটাই সামলে দেয় ইউনেসকোর এই ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং রাজ্যের দ্বিতীয় রামসার অঞ্চলটি। ভাবলে গা শিউরে ওঠে যদি এই ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটি আমরা না পেতাম তাহলে ২০০৭ সালের সিডার, ২০০৯ সালের আয়লা, ২০১৯ সালের বুলবুল ও ২০২০ সালের আম্পান - এর পর আমাদের অবস্থাটি কি হোত। ভূগোলটা পুরোপুরি চলে যেতো ইতিহাসের পাতায়। এবার আবার ইয়াস নামে এক ঝড়ের সংকেত সবাইকে খুব চিন্তিত করে তুলেছে। সর্বত্রই একটা কি হয় , কি হয় ভাব।
একটা দেহাতি গান, “ছাতা ধরহে দেওরা” একসময় খুবই ভালো লাগতো। এখন গানটা শুনলেই মনটা কেমন যেন উথাল পাথাল করে। কোলকাতার সেই ছাতাটা “আজ আর নেই”, ওটা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে, তাই। সুন্দরবনের ছেলেধরাটা দু-রকমের। একটা প্রাকৃতিক, আর একটা ব্যবহারিক। জলবায়ুর পরিবর্তনে বিষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রের নোনা জল বেড়ে ম্যানগ্রোভ অনেক নষ্ট হচ্ছে এবং তারসাথে লায়লারা (থুরি আয়লারা) এত জোরে মাঝে মধ্যেই এখানে নাচানাচি করে যে সুন্দরীর জঙ্গল সেই ভার সহ্য করতে না পেরে এখন ডুবেই মরছে। আর আমরা “কালিদাসরা” ওখানে কি না করছি। ব্যাপকভাবে জঙ্গল কেটে চলছে চিংড়ির চাষ আর মানুষের বসবাস। তার ওপর পর্যটনটা ওখানে পাটাতনের মতন চেপে বসেছে।
২০০ বছর আগে সুন্দরবনের যে চিত্র বা ম্যাপ ছিল – আজ তার অনেকটাই নেই। একটা উপগ্রহ চিত্র দেখছিলাম। মনে হোল যেন অর্ধেকেরও বেশী মানুষ গ্রাস করে ফেলেছে। এভাবে চললে আগামী ১০০ বছরে সুন্দরবনের স্থলে সুন্দর-সাগরই হয়তো কেবল দৃশ্যমান হবে। যেমনটা হয়েছে কপিল মুনির আশ্রম/মন্দির – এর ক্ষেত্রে।
২০১৫ তে সুন্দরবনের মামলায় গ্রীন ট্রাইবুন্যাল আমাকে আদালত-বান্ধব নিয়োগ করেছিল। কালিদাসরা ওখানে কতটা সক্রিয় বোঝাতে একটা তথ্য কোর্টের সামনে পেশ করেছিলাম। ১৯৫১ সালে ওখানকার জনসংখ্যা ছিল ১১.৫৩ লক্ষ, ২০১৮ তে সেটা পৌঁছে গেল ৬৭ লক্ষেরও ওপরে, অর্থাৎ ৬৮ বছরে জনসংখ্যা বাড়লো ৫৮২%, আদালতে বিস্তারিত জানালাম যে কীভাবে বাংলাদেশ থেকে ফ্লাই-অ্যাশ নিতে আসা খালি বার্জের খোলে প্রতিদিন কত মানুষ কীভাবে বাংলাদেশ থেকে এদেশে অনুপ্রবেশ করে। প্রায় বসবাসের অনুপযুক্ত ঐ এলাকায় এত জনস্ফীতী হোল কী করে তা সহজেই অনুমান করা গেল। পরিবেশ আদালত আদেশও দিল কিন্তু সবই এখনও চলছে, চলবে।
২০০০ সালে আদবানিজী যখন স্বরাস্ট্রমন্ত্রী একটা টিম নিয়ে তখন সুন্দরবনের জম্মুদ্বীপ গিয়েছিলাম, দেখেছিলাম মাছ ধরা ও তা শুকনো করার নামে হাজার হাজার গাছ কেটে কীভাবে বাংলাদেশীরা ওখানে স্থায়ী আস্থানা গেড়েছে। বিস্তারিত জানিয়ে মন্ত্রীকে চিঠি দিলাম। কিসের তাড়নায় জানিনা, রাজ্যের তদানীন্তন মৎসমন্ত্রী তখন আমার বিরোধিতা করেছিলেন, এমনকি পশ্চিম-ভারত থেকে এক নামজাদা পরিবেশ কর্মী হাজির হয়ে মৎসজিবীদের সমর্থনে বক্তব্য রেখেছিলেন। এখনও সেই ট্রাডিশানটা সমানে চলেছে। সুন্দরবনের ছাতাটা দ্রুত সরে যাচ্ছে।
৫ বছর আগে সুন্দরবনের দুরবস্থার ওপর বক্তব্য রাখতে একটা সেমিনারে গিয়েছিলাম। একজন বক্তা বলছিলেন যে কীভাবে ওখানকার একটা দ্বীপ তলিয়ে যেতে বসেছে। হাজার হাজার মানুষ বিপন্ন হয়ে পড়েছে এবং পড়ছে। বক্তা দাবি করেছিলেন – ঐ অসহায় মানুষদের যেন Environmental Refugee অর্থাৎ পরিবেশগত শরনার্থী হিসেবে দেশ (ভারত) স্বীকার করে। আমার বক্ত্যবে পরে বলেছিলাম তারা অসহায় মানুষ একথাটা ঠিক। ওদের পাশে দাঁড়াতেও হবে কিন্তু মানুষগুলো কোথা থেকে, কীভাবে, কখন ঐরকম চরম প্রতিকূল একটি জায়গাতে বসবাস শুরু করলো সেটাও তো নির্ধারন করা উচিৎ। কেউ আমার কথায় তেমন মান্যতাই দিল না। ভাবলাম কালিদাস হয়ে গাছের ডাল কাটতে কাটতে আমরা নিজেদের পা না কেটে বসি। সুন্দরবনের এই ছাতাটা Disaster Management – এর অঙ্গ হতে পারত কিন্তু – আর হোল না।
দয়া করে একদম ভুল বুঝবেন না – আমি কিন্তু আদৌ সাম্প্রদায়িক নই।
সুভাষ দত্ত