কোহিতুর, ঝুমকো রানি, তোতাপুরী, জাহানারা : বাংলার ঐতিহ্যবাহী আম পর্যটন

প্রভাশঙ্কর, অনুপম, ভাদুরী, ভবানী – দেখে মনে হতে পারে, একগুচ্ছ নামবাচক বিশেষ্য তুলে আনা হয়েছে এলোমেলোভাবে। এগুলি পশ্চিমবঙ্গের ২০০-র বেশি ধরনের আমের মধ্যে চারটি। পশ্চিমবঙ্গে আমের বৈচিত্র্য সারা ভারতের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। তবে যত বড়োই আমপ্রেমী হন, অধিকাংশ বাঙালিই ১০-এর বেশি রকম আমের নাম বলতে পারবেন না।

বাংলার প্রধান ফল আম। ৮০.৯০ হাজার হেক্টর, অর্থাৎ মোট ফল চাষের জমির ৪১ শতাংশ অঞ্চলে আম উৎপাদন হয়। বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যানপালন বিভাগ থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, “আলাদা আলাদা কাল্টিভার এবং হাইব্রিড পরীক্ষা করে জানা গিয়েছে, গড়ে প্রত্যেকটি ফলের ওজন ৭০.০ গ্রাম (সুবজা) থেকে ৭৬৮.৮ গ্রাম (তোতাপুরী) পর্যন্ত হতে পারে। যেসব গাছের গুণাগুণ চাষিরা কৃত্রিমভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, সেগুলোকে বোঝাতেই বিজ্ঞানীরা ‘কাল্টিভার’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন।

পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ জেলায় আম চাষ হয়। তবে সবথেকে বিখ্যাত মুর্শিদাবাদ আর মালদা। মুর্শিদাবাদে আম চাষের প্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। মুঘল দরবারেও এখানকার আমের খ্যাতি পৌঁছেছিল। বিশেষ করে জাহাঙ্গির ও শাহজাহানের আমলে। এঁরা দুজনও ছিলেন ‘ফলের রাজার’-র বিশেষ ভক্ত। চার হাজার বছরের বেশি সময় ধরে ভারতে আমের ফলন হয়। ইংরেজি ‘ম্যাংগো’ শব্দটি এসেছে মালায়ালম ‘মাংগা’ থেকে। প্রথম এই শব্দটি গ্রহণ করেন পর্তুগিজরা। তারপর ইংরেজরা। এখন ভারতে এক হাজারেরও বেশি রকম আম পাওয়া যায়। মোট উৎপাদিত ফলের প্রায় ৩৫ শতাংশ।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাপত্র বলছে, “বাংলায় আমের বৈচিত্র্য এত বেশি থাকা সত্ত্বেও তাকে সম্পূর্ণ ব্যবহার করা যায়নি। এছাড়া বেশিরভাগ জার্মপ্লাসম চিহ্নিত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।” মুশকিল আসানের একমাত্র উপায় আম পর্যটন। মালদা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ায় ঘুরে দেখা, কোন কোন অঞ্চলে সেরা আমের ফলন হয়।

ফজলি

মে মাসের মাঝামাঝি থেকে জুনের শুরুতে আপনি পাকা অবস্থায় পেয়ে যাবেন অমৃত, ভবানী, ভুতো বোম্বাই, বিনি, বিরা, কালো আলফানসো, গোলাপখাস, হিমসাগর, জাহানারা, ঝুমকো রানি, লেট ফোর, লোহাজং এবং সারদামণি ভোগ। মাঝ থেকে শেষ জুনে পাবেন আনারস, বিশ্বনাথ চ্যাটার্জি, বিশ্বনাথ মুখার্জি, কোহিতুর, তোতাপুরী এবং প্রভাশঙ্কর। জুলাই-অগাস্টে পেকে উঠবে বিখ্যাত ফজলি এবং চৌসা আর খানিকটা অপরিচিত মাজিল পসন্দ, আম্রপালী এবং আশ্বিনা।

বুঝতেই পারছেন, এইসব আমের বেশিরভাগই আপনার স্থানীয় বাজারে এসে পৌঁছায় না। যদি নানান রকম আম চেখে দেখতে চান, সবথেকে ভালো উপায় হল জেলায় জেলায় আমবাগানে গিয়ে সংগ্রহ করা। বাজারের থেকে অনেক কম দামে কিনতে পারবেন। যেমন ধরুন সবচেয়ে দামী আম কোহিতুর। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এই আমের জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করেছে। নবাব সিরাজদ্দৌলার সময় আমের সংকর ঘটিয়ে কোহিতুর প্রথম উৎপাদন করা হয়। খেতেন কেবল নবাব এবং অভিজাতরাই। এখন বাজারে প্রতিটি কোহিতুরের দাম প্রায় ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। পাওয়া যায় একমাত্র মুর্শিদাবাদে।

হিমসাগর

পশ্চিমবঙ্গে পুরোনো বেশ কিছু রকমের আম লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। যেগুলো এখন পাওয়া যায়, আম পর্যটনে গিয়ে স্বাদ নিন সেগুলোর। যে ৩টে জেলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, প্রত্যেকটিরই রয়েছে প্রাচীন সমৃদ্ধ ইতিহাস। ঘুরতে গেলে অতীতের স্মৃতি জড়ানো নানা ডেস্টিনেশন নিজের চোখে দেখার সুযোগ পাবেন। উপলব্ধি করতে পারবেন বাংলার গৌরবময় আম-ঐতিহ্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.