মহাভারতের যুদ্ধ শেষ হয়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে অসংখ্য বীর যোদ্ধাদের ছেড়া কাপড়,মুকুট, ভেঙে যাওয়া রথের চাকা, অস্ত্র-শস্ত্র, ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে...আর বায়ুমণ্ডলে রয়েছে একটা গুমোট ভাব...শকুন,শিয়াল,কুকুর হাড়হিম করা চিৎকার সেই চিৎকারের মাঝে একা নির্জন হয়ে দ্বাপর যুগের সবথেকে মহান যোদ্ধা দেবব্রত ভীষ্ম শরশয্যায় শুয়ে সূর্যের প্রতীক্ষা করছে । ঠিক তখনই তার এক পরিচিত শব্দ শুনতে পেলেন....প্রণাম "পিতামহ" !!
ভীষ্ম বললেন...স্বাগত দেবকিনন্দন, আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমার কথাই ভাবছি। কৃষ্ণ বললেন কি বলি পিতামহ এখন তো এটাও বলতে পারবো না "আপনি কেমন আছেন"
কিছুক্ষনের জন্য আবার চারিদিকে নিস্তব্ধতা তারপর ভীষ্ম বললেন পুত্র যুধিষ্ঠিরের রাজ্যাভিষেক হয়েগেছে..? কৃষ্ণ চুপ...!!
ভীষ্ম কৃষ্ণের কাছে জিজ্ঞেস করলো একটা প্রশ্ন করবো কেশব..?? বলুন পিতামহ।
যুদ্ধে যা কিছু হয়েছে সেটা কি ঠিক ছিলো..??
কাদের দিক থেকে পিতামহ কৌরব না পাণ্ডবদের..??
কৌরবদের কর্মের আলোচনার এখন কোনো অর্থই নেই…!! কিন্তু পাণ্ডব এটা কি ঠিক করলো…?? দ্রোনাচাৰ্য্য বধ, দুর্যোধনের থাইয়ের নীচে প্রহার,দুঃশাসনের বুক চিরে দেওয়া, অস্ত্রহীন কর্ণ কে বধ এগুলো কি ঠিক ছিলো..?
আমি কি ভাবে এটার উত্তর দিবো পিতামহ! এটার উত্তর তাদেরই দেওয়া উচিত যার এগুলো করেছে..!! আমি তো এই যুদ্ধে কোথাও ছিলামই না পিতামহ..!!
ভীষ্ম বললেন এখনো ছলনা করছো কৃষ্ণ? সারা পৃথিবী এটা জানবে মহাভারতের যুদ্ধ অর্জুন, ভীম জিতেছিলো…কিন্তু আমি জানি এই জয় শুধু তোমার শুধুই তোমার…তাই এর উত্তর তোমাকেই দিতে হবে কৃষ্ণ..!
তাহলে শুনুন পিতামহ কোনো খারাপ কিছুই হয়নি…যা হয়েছে সেটাই হওয়া উচিত…!!!
মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের অবতার কৃষ্ণ বলছে এটা..!! এই পতন সনাতন সংস্কৃতিতে কোনো যুগেই ছিলো না তাহলে উচিত কিভাবে..??
ইতিহাস থেকে শিক্ষা আর বর্তমান পরিস্থিতি দেখে নির্ণয় নিতে হয় পিতামহ। প্রত্যেক যুগ তর্ক আর প্রয়োজন অনুসারে নিজের নায়ক নিয়ে আসে। রাম ত্রেতা যুগের নায়ক ছিলো, আমার ভাগে দ্বাপর যুগ এসেছে তাহলে আমাদের নির্ণয় একই হবে কিভাবে…পিতামহ!
বুঝতে পারছিনা কৃষ্ণ! খুলে বলো…..”
রাম আর কৃষ্ণের পরিস্থিতির মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে পিতামহ..! রামের যুগে রাবণের মতন অশুভ শক্তিও ছিলো শিবভক্ত তার পরিবারে বিভীষণ,কুম্ভকর্ণের মতন সাধুও ছিলো। বালীর মতন দুষ্টের স্ত্রীও বিদুষী ছিলেন আর অঙ্গদের মতন ছেলে ছিলো। সেইযুগে ধর্মের কথা মাথায় রেখে সবাই চলতো…সেইজন্য রামের ধর্ম বিরুদ্ধ কোনো কাজ করতে হয় নি।। কিন্তু আমার যুগে দেখুন দুর্যোধন, দুঃশাসন,শকুনি,জরাসন্ধ এদের মতন ঘোর পাপী এসেছে। তাদের সমাপ্ত করার জন্য এই ছলনা ঠিক ছিলো পিতামহ…!
তাহলে তোমার এই নির্ণয়ে একটা ভুল পরম্পরা চালু হলো না কৃষ্ণ..?
ভবিষ্যতে এর থেকেও বেশি কিছু হবে পিতামহ... যখন হিংস্র আর অশুভশক্তি ধর্মের বিনাশের জন্য আক্রমণ করছে তখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে "বিজয়" ভবিষ্যৎ কে এটা শিখতে হবে পিতামহ।
ধর্মের বিনাশ হতে পারে কেশব..? আর মানুষ কি এটাকে আটকাতে পারবে..??
সবকিছুই ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দেওয়া মূর্খতা হবে পিতামহ..! ঈশ্বর নিজের থেকে কিছুই করে না, সব মানুষই করে...আপনি আমাকেও তো ঈশ্বর বলছেন বলুন আমি নিজে এই যুদ্ধে কি করেছি..?? এটাই প্রকৃতির সংবিধান।। এটাই পরম সত্য।।
ভীষ্মকে এখন সন্তুষ্ট মনে হচ্ছে , তার চোখ ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে…. তারপর বললেন সম্ভবত এটাই আমার শেষ রাত এই অভাগা ভক্তকে ক্ষমা করো কৃষ্ণ..! কৃষ্ণ প্রণাম করে চলে গেলেন….কিন্তু সেই অন্ধকার ভূমিতে জীবনের সবথেকে বড়ো সূত্র পাওয়া গেলো।
যখন আক্রমণ হচ্ছে তখন নৈতিকতার জ্ঞান আত্মঘাতী হয়।