কিছু ঘটনাবলী স্মৃতিপটে ছাপ রেখে যায়, আজকের দিনে তা শুধুই নীরব ইতিহাস অথচ সেসব তখন কতই না বর্ণময় আড়োলন সৃস্টিকারী পালাবদলের নেপথ্যের নীরব সাক্ষী।

আমরা অনেকেই তখন নেহাতই কিশোর, বালক, সদ্যজাত শিশু বা অনেকেরই তখন জন্ম হয়নি। বিশ্ব রাজনীতির বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ।ভিয়েতনাম মুক্তি ফৌজের একের পর এক বিজয়। সিয়াচীনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পতন, শেখ মুজিবের সপরিবারে হত্যা ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন।

সেই সময়েই মানে ১৯৭৫ সালে ভারত আণবিক বোমা ফাটায়ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ (Fakruddin Ali Ahmed) পঞ্চম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। সিকিম ঘোষিত হয় ভারতের ২২ তম রাজ্য ।ভারত আর্যভট্ট উৎক্ষেপণ করে। সেই বছরেই ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন গভীর রাতে জরুরি অবস্থা জারি হয়।আগের রাতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকিরুদ্দিন আলি আহমেদকে দিয়ে জরুরি অবস্থার নির্দেশনামা সাক্ষর করান ইন্দিরা৷ রেডিওতে ইন্দিরা গান্ধী বললেন “The President has proclaimed Emergency. There is nothing to panic about.”(“অযথা আতঙ্কিত হবেন না৷ রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা জারি করেছেন৷’’) ।সংবিধানকে সম্পূর্ণ ধূলিস্যাত করে গণতন্ত্র হত্যার কালো ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। ওই ঘোষণার আগে পর্যন্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যেরই অজানা ছিল যে দেশে জরুরি অবস্থা জারি হতে চলেছে।জরুরি অবস্থা জারির পাশাপাশি সংবাদপত্রর যাতে প্রকাশিত হতে না পারে তাই দুদিন ছাপাখানায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। বহু বিরোধী রাজনৈতিক নেতা, সমাজকর্মী, শ্রমিক নেতারা জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করায় গ্রেফতার করা হয়৷

সারা দেশে ও বিশেষত মহানগরীর রাস্তায় রাস্তায় পুলিশের কালো ভ্যানের অবিরত আনাগোনা আর সি.আর.পি এবং রাজ্য পুলিশের ভারী বুটের শব্দে হাড় হিম করা অনুভুতি। প্রতিটি মানুষ, ছাত্র, সেবামুলক সংস্থা ও সামাজিক সংগঠনগুলি এক শীতল আতংকের আবহের শিকার ছিল।

ইন্দিরা গান্ধী (Indira Gandhi) বলেছিলেন ওই সময় জাতীয় স্বার্থে এমনই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

কিন্তু বাস্তবটা ছিল একটু ভিন্ন। ১৯৭৩ সালে গুজরাতের কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী চিমনভাই প্যাটেলের মুখ্যমন্ত্রীত্বে দুর্নীতিগ্রস্থ শাসন৷ আহমেদাবাদের ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রেরা ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদে ধর্মঘট করে৷ এক মাস পরেই গুজরাত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রেরা দুর্নীতিগ্রস্থ রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করার দাবিতে বিক্ষোভ দেখায়৷ যা “নবনির্বাণ আন্দোলন” নামে পরিচিত৷ গুজরাতের অনুরুপ আন্দোলনে দানা বাধে বিহারেও৷ ছাত্রদের আন্দোলনের সাথে সাথে বর্ষীয়ান নেতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী ৭১ বছরের জয়প্রকাশ নারায়ণের (জেপি) নেতৃত্বে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বিহার৷ রামলীলা ময়দানে জয়প্রকাশ নারায়ণ বিপুল সমাবেশে ভাষণ দিচ্ছিলেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।তখন জয়প্রকাশ বলেছিলেন, “বিনাশকালে বুদ্ধিনাশ”।বিহারের আন্দোলনে দেশ যখন জ্বলে উঠছে তখনই রেল ধর্মঘটে স্তব্ধ করে দেওয়া হল যোগাযোগ ব্যবস্থা৷ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জর্জ ফার্নান্ডেজ৷ ১৯৭৪ সালের মে মাসে তাদের ধর্মঘটের জেরে অচল হয়ে গিয়েছিল যাত্রীবাহী এবং পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল ব্যাবস্থা।

ছাত্র শ্রমিক ইউনিয়নের বিক্ষোভের পাশাপাশি ইন্দিরা গান্ধীকে সেই সময় দুশ্চিয়তায় ফেলে দিয়েছিল সোসালিস্ট নেতা রাজনারায়ণ যিনি ১৯৭১ সালে রায়বেবেলি লোকসভা কেন্দ্র থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে ইন্দিরার জয়ী হয়েছিলেন বলে মামলা করেছিলেন৷ দেশের অশান্তির আবহে ১৯৭৫-এর ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরিয়েছিল এবং ইন্দিরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। তাই সম্যক প্রতিকুলতার হাত থেকে মুক্তির চাবিকাঠি হিসাবেই তিনি রাতের অন্ধকারে জরুরি অবস্থা ঘোষনা করেন।

সমস্ত বিরোধী নেতাকে গ্রেফতার করা হয় সে সময়ে।জগজীবন রাম, হেমবতী বহুগুণা, চন্দ্রশেখর বন্দি হন। অটলবিহারী বাজপেয়ী, লালকৃষ্ণ আদবানি, সুব্রহ্মণ্যন স্বামী, অরুণ জেটলি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও গ্রেফতার হন।সারা দেশে ১৩৫৬ সংঘ প্রচারকের মধ্যে ১৮৯ জনকে জেলে পাঠানো হয়। সরসংঘচালক শ্রী দেওরস সহ আরো অনেককে গ্রেফতার করা হয়।লোক সংঘর্ষ সমিতি গঠিত হয় এবং জরুরি অবস্থার বিরোধিতা করার জন্য লক্ষাধিক সমর্থক সত্যাগ্রহ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কারাবরন করেন।মিসা আইনে ধৃত ৩০০০০ জনের মধ্যে ২৫০০০ জনই সংঘ পরিবারেরই সদস্য ছিলেন।সংঘের ১০০ জন কার্যকর্তাকে জরুরি অবস্থা চলাকালীন অধিকাংশই কারাগারে অথবা বাইরে মৃত্যু বরন করতে হয়।রাস্ট্রীয় সয়ংসেবক সংঘকে জরুরি অবস্থায় সমুহ প্রতিকুলতার সম্মুখীন হতে হয়। সভা সমিতি, জনসংযোগ, প্রকাশনা সব কিছুই নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। তা সত্বেও জরুরি অবস্থার বিরোধীতার পথ থেকে সংঘ বিচলিত হয় নি।সংঘেরই একমাত্র সারা দেশব্যাপী শাখা বিন্যাস ছিল যার মাধ্যমে সংঘের জনসংযোগ কিন্তু অন্য রাজনৈতিক দলগুলির মতো ব্যাহত হয়নি।

জয়প্রকাশ নারায়ন গ্রেফতার হবার পূর্বে লোক সংঘর্ষ সমিতির আন্দোলনের দায়ীত্ব রাষ্ট্রীয় সয়ংসেবক সংঘের পুর্বকালীন কার্য্যকর্তা শ্রী নানাজী দেশমুখের উপর অর্পন করেন।নানাজী দেশমুখের কারাবরণের পরে সেই দ্বায়ীত্ব সর্বসম্মত ভাবে শ্রী সুন্দর সিং ভান্ডারীর ন্যস্ত হয়

ঐ সময়ে কংগ্রেস সরকার কোনও নির্বাচন করেনি৷

দেশের সাধারন মানুষের নাগরিক স্বাধীনতা ছিলনা৷ সংবাদ মাধ্যমেরও স্বাধীনতা ছিলনা ।সমাজবিদ নেতা শ্যামনন্দন মিশ্র ,মধু দন্ডবতেকেও কারাবরন করতে হয়েছিলো।

দিল্লীর (Delhi) মসনদে আসীন থাকতেই ইন্দিরা সিদ্ধার্থ রায়ের পরামর্শে জরুরি অবস্থা জারি করেন।

ইন্দিরাপুত্র সঞ্জয় গান্ধীর তুর্কমান গেটে বুলডোজার চালিয়ে গরিব মানুষদের উচ্ছেদ ইন্দিরার সেই কালো শাষনকে আরো কলঙ্কিত করে তোলে।সঞ্জয় গান্ধীর সৈরাচারের নিদর্শন তুলে ধরায় শ্রী অমৃতলাল নাহাটা পরিচালিত “ কিস্সা কুর্সি কা” চলচিত্রটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় ও পুড়িয়ে ফেলে প্রমাণ লোপাট করা হয়। দেশ শাসনের চালিকাশক্তি সকলের অলক্ষ্যে চলে আসে সঞ্জয় গান্ধীর হাতে অনৈতিকভাবে। ওনার ব্যাপারে মার্ক টুলি বলেছিলেন-“His inexperience did not stop him from using the Draconian powers his mother, Indira Gandhi, had taken to terrorise the administration, setting up what was in effect a police state.”

বংশীলালের মতো কিছু চাটুকার বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে সঞ্জয়ই দেশের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে দাঁড়ান।আইনের শাষন প্রহসনে পর্যবসিত হয়ে যায়।

সেদিনও ছিল “এগিয়ে বাংলা”। পশ্চিমবঙ্গে গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (এপিডিআর) এবং তাদের প্রকাশনাও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল।পশ্চিমবঙ্গের ৯৮ কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়।এগারো হাজারেরও বেশী বেকার হন। দেড় হাজারের মতো শ্রমিক ছাঁটাই হয়। ৩৯২ টা কারখানায় লে-অফ হয়, লক্ষাধিক শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হন। জরুরি অবস্থায় ভারতে ১৪৭ টা পত্রিকা ও পশ্চিমবঙ্গে ৩০ টা পত্রিকা বন্ধ করা হয়।আপামর বাঙ্গালীর জীবন দেবতা রবীন্দ্রনাথ। সমাজ সচেতনতার আতঙ্কে ২৬ টি রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ ঘোষিত করা হয়

গৌরকিশোর ঘোষ, বরুন সেনগুপ্ত সহ বাংলার আট জন স্বনামধন্য সাংবাদিক গ্রেফতার হন। সম্পাদকীয়র কলম লেখা যেত না, খালি রাখতে হতো।

সে সময়ে সারা দেশব্যাপী ইন্দিরা বিরোধী আন্দোলনের বাতাবরন রচনা করছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ন এবং সেই উদ্দেশ্যে কলকাতা এলে তিনি যুব কংগ্রেসের প্রবল বিরোধীতার মুখে পড়েন। ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষিত জরুরি অবস্থার সমর্থনে আজকের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী সেদিন জয়প্রকাশজীর যাত্রাপথের গতি রোধ করেছিলেন। তাঁর গাড়ির বনেটের উপর উঠে নাকি নাচও করেছিলেন।এই আচরনেই প্রকাশ পায় যে গনতন্ত্র তিনি কখনই মানতেন না বরং ফ্যাসিবাদেরই আরাধনা করতেন।

সিদ্ধার্থ শঙ্করের পরামর্শে মেইনটেন্যান্স অব ইন্টারনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (মিসা) আইন চালু হয়| জরুরি অবস্থায় “মিসা” ধারায় গ্রেফতার হন ৬২৪৪ তার মধ্যে ৫০০৯ জনই পশ্চিমবঙ্গের

বিনা বিচারে যেকোনো ব্যক্তিকে জেলে বন্দী করে রাখার জন্য নতুন করে মিসা অর্ডিন্যান্স হিসাবে চালু হয়েছিল।এই আইনে বামপন্থী এবং কংগ্রেসেরও বিক্ষুব্ধ হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। যাতে শ্রমিক, কর্মচারী, খেতমজুর, কৃষক, সাধারণ মানুষকে বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে না পারে তাই মিশা, ডি. আই. আর ইত্যাদি আইনে গ্রেপ্তার ও জেলে পুলিশি অত্যাচারের ভয় দেখানো হয়েছিল। বলাবাহুল্য, এক বিরাট পুলিশ-রাজ আত্মপ্রকাশ করেছিল সেইসময়। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বক্তৃতার স্বাধীনতা, সংগঠন ও জমায়েতের অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার বলতে কিছুই ছিল না।

১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে শ্রী সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে পুলিশ খানাতল্লাশি চালিয়েছিল। নকশাল পরবর্তী সময়ে শান্তি স্থাপনার নামে আন্দোলনরত মেধাবী ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করে ও লাসও লোপাট করা হয়েছিল।সিদ্ধার্থ শঙ্করের সুশিক্ষিত পুলিশ নিপুন হস্থে নিঃশব্দে সেই সব হত্যালীলা সমাধা করেছিলো।

শুধুমাত্র সংবাদপত্র, নাটক এবং চলচ্চিত্রর ওপরেই সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেই ক্ষান্ত হননি। এমনকি, চলচ্চিত্রের এককালের বিশিষ্ট অভিনেতা ও জনপ্রিয় গায়ক কিশোর কুমারের হিন্দি ছবিতে কাজ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যুব কংগ্রেসের আয়োজিত দিল্লির সংগীত সন্ধ্যায় তিনি অংশগ্রহণ করেননি বলে তাঁর রেডিও প্রোগ্রামও বাতিল করা হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু হরণ করে তার সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিবৃত্ত করেছিল। সর্ব প্রকার গনমাধ্যমের কন্ঠরোধের শেষ সীমা অতিক্রম করছিলে। ২১ মাসের আন্ধাকানুনের শেষে দেশব্যাপী প্রবল বিরোধী বাতাবরনে কেন্দ্রে ও রাজ্যে নির্বাচনে পর্যুদস্ত হন ইন্দিরা

সাল ১৯৭৭ জরুরি অবস্থা তুলে নেওয়ার পর শান্তিনিকেতনেক পাঠভবনের মাঠে ধুলিঝড় উড়িয়ে হেলিপ্যাডে অবতরন করল আশ্রমকন্যার সেনাবাহিনীর হেলিক্পটার। তখনও “এগিয়ে বাংলা”। ছাতা হাতে সুসজ্জিত মানুদা লম্বা পদক্ষেপে ম্যাডামের সঙ্গে তাল রাখছেন। আমি তখন NCC করি। শুরু হলো “গার্ড অফ অনার”। অকম্পিত কন্ঠে কমান্ড হলো “সেলামী শাস্ত্র্”। জাতীয় পতাকা উঠলো – ব্যান্ডে বাজলো জাতীয় সঙ্গীত। অপলক চক্ষে চেয়েছিলাম একনায়কতন্ত্র ও সৈরাচারের একনিষ্ঠা পুজারিনী এক সুন্দরীর দিকে।

সেই বছরেই কেন্দ্রে ও রাজ্যে কলংকিত কায়েমি রাজত্বের শেষে রাজনৈতিক পালা বদল হ্য়। পরাস্ত হন এশিয়ার “মুক্তি সূর্য ইন্দিরা গান্ধী”।

সৌমিত্র সেন (Soumitra Sen)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.