আদি পেশা সুপারি-মশলা দিয়ে সাজানো খিলি পান বিক্রি করা। বারুজীবিরা করেন পানের চাষ আর সেই পান সাজিয়ে বিক্রি করার পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা হলেন “তাম্বুলী” এবং তা থেকে চলতি কথায় “তামলী।”

বৃহদ্ধর্মপুরাণে তামলীরা উত্তম সংকর এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে তাঁরা স‍ৎ শূদ্র। আর বল্লালীয় বিভাগে তাঁরা নবশাখ ( নবশায়ক) শ্রেণীভুক্ত।

বৃন্দাবন দাস তাঁর লেখা “চৈতন্য ভাগবত”, আদি, দশম অধ‍্যায়ে শ্রীচৈতন‍্যের আবির্ভাবের সময় নবদ্বীপের তামলীদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে—

“মালাকার প্রতি প্রভু শুভদৃষ্টি করি।

উঠিলা তাম্বুলি ঘরে গৌরাঙ্গ শ্রীহরি। ।

তাম্বুলি দেখয়ে রূপ মদনমোহন।

চরণের ধুলি লই দিলেন আসন। ।

তাম্বুলি কহয়ে বড় ভাগ্য সে আমার।

কোন ভাগ্যে তুমি আমা ছারের দুয়ার। ।

এত বলি আপনেই পরম সন্তোষে।

দিলেন তাম্বুল আনি প্রভু দেখি হাসে। ।”

বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তাম্বুলীরা নিজেদের ঘরের উঠোনে চুন পাত্র, কয়েকটি পান পাতা, সুপারি ও যাঁতি রেখে পুজো করার রেওয়াজ আছে।

একসময় দক্ষিণ কলিঙ্গ দেশের তামিল জাতির সঙ্গে তাম্রলিপ্ত বন্দরের সম্পর্ক ছিল। তামিল থেকেই এসেছে তাম্রলিপ্ত নামটি। এই তাম্রলিপ্ত এলাকাতেই আবির্ভাব ঘটে তাম্বুলী জাতির। খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতকে তাম্রলিপ্তে দেবরক্ষিত বণিক নামে এক রাজা ছিলেন, যিনি তাম্রলিপ্ত এলাকার তামলী জাতির প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ বলে পরিচিত।

তামলী জাতির মধ্যে রয়েছে ৩৭ টি আশ্রম বা পদবি। এ বিষয়ে তামলীদের প্রাচীন কুলজী গ্রন্থে দেখা যাচ্ছে—

“দে, দত্ত, পাল, সেন প্রধান চারিঘর,

জানা, দাস, নাগ, নন্দ হয় তারপর।

কুণ্ডু, গুঁই, লাহা, তদপর হয় বেল,

সিং, রক্ষিত, দাঁ, চন্দ্র এই ষোল মেল।

কর, গণ, বর্ধন, মৌলিক মধ্যে গণি,

ত্রন্দ, কেন্দ, বিট, পিরি তৎপর বাখানি।

চার, স্কার, শো, শীল, পাদ, কচ, ধল,

রুদ্র, খাঁ, পরম, ঘোষ হয় এক মেল

মান মুগুর তদপর সর্বশেষ ভুঁই।”

রাঢ়বঙ্গের ৪২ টি গ্রামে ছিল তামলীদের বসবাস। তাই প্রবাদ রয়েছে—

“এত আশ্রম ৪২ গাঁই।

এছাড়া আর তাম্বুলী নাই। ।”

রাঢ়বঙ্গের তাম্রলিপ্ত অঞ্চলের তামলীদের মধ্যে তিনটি থাক্ রয়েছে—জাহানাবাদী ( আরামবাগ), বর্ধমেনা ও রাজহাটি। বর্ধমেনাটি হচ্ছে দামোদর নদ কেন্দ্রিক। অন্য দুটি দারকেশ্বর ও রূপনারায়ণ কেন্দ্রিক। বাঁকুড়া জেলার ওন্দা থানার উত্তরে দারকেশ্বর নদের তীরে অবস্থিত বীরসিংহপুর রাজহাট গ্রামে একসময় ছিল সাতশো ঘর তাম্বুলীর বসবাস। পরে ওই সব পরিবারের লোকজন ছড়িয়ে পড়েন বাঁকুড়া, ছাতনা, ইন্দপুর বিভিন্ন গ্রামে এবং রাজহাটি তামলীদের একটি বিরাট অংশ মানভূম, পুরুলিয়া, হাজারিবাগ ও রাঁচিতে বসবাস করতে শুরু করেন। তবে রাজহাটি তামলীরা যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁদের সঙ্গে রাজহাট বীরসিংহপুরের তামলীদের সম্পর্ক রয়েছে। রাজহাটি তামলীদের কুলদেবতা হরিহরপুরের শিবকে আজও মেনে চলেন তাঁরা। তাই রাজহাটি তামলী পরিবারের লোকজন যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁদের ছেলেমেয়েদের বিয়ে কিংবা অন্নপ্রাশনে প্রথমেই হরিহরপুরের শিবের উদ্দেশ্যে ষোল আনা তুলে রাখেন এবং শিবের গাজনের সময় সেই টাকা সেখানে পাঠিয়ে দেন।

খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতকে ষষ্ঠীবর সিংহ হালদার ব‍্যবসায়িক কারণে অন্য জায়গায় গিয়ে বসবাস করতে থাকেন এবং আশ্রয় নেন শ্রীমন্ত খাঁ নামে এক তামলীর কাছে। এরপর ষষ্ঠীবর পিতার সম্মতি ছাড়াই বিয়ে করেন শ্রীমন্ত খাঁয়ের মেয়েকে। এর জন্য ষষ্ঠীবর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হোন। এরপর আত্মীয় স্বজন নিয়ে তিনি ১৪ টি গ্রামে বসবাস করতে থাকেন। এভাবে তৈরি হয় তামলীদের ১৪ টি থাকের। তামলীদের মধ্যে রাজহাটিরাই সংখ্যায় বেশি এবং তাঁদের অধিকাংশ বসবাস করেন বাঁকুড়া জেলায়। আর বীরভূম জেলায় তামলীদের মধ্যে রয়েছে চারটি থাক্—পাড়া গেঁয়ে, বিয়াল্লিশ গেঁয়ে, চৌদ্দ গেঁয়ে ও গয়লা পেড়ে। বর্তমানে অন‍্যান‍্য জাতির মতো তামলীদের মধ্যেও বৃত্তি বদল ঘটছে।

তথ‍্যসূত্র:

1) The Tribes and Castes of Bengal: H.M. Rislay.

2) রাঢ়ের জাতি ও কৃষ্টি, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় খণ্ড: মানিকলাল সিংহ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.