২০১৯ – এ প্রায় সব রাজনৈতিক শক্তিকে পিছনে ফেলে অমিত বিক্রমে দেশের শাসন ক্ষমতায় আবার আসীন হয়েছে নরেন্দ্র দামােদরদাস মােদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। আর সেই সরকারের দ্বিতীয় লৌহপুরুষ হিসেবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আসনে বসানাে হয়েছে অমিত বিক্রমশালী, ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য-মস্তিষ্ক অমিত শাহকে। এবং নিদ্বিধায় বলা যেতে পারে, মন্ত্রিসভা গঠনের। একেবারে প্রথম পর্যায়েই এই সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী মােদীজীর একটা মাস্টারস্ট্রোক। মাস্টারস্ট্রোক বলছি এই কারণেই যে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সামনে এবার নির্বাচনােত্তর পরিবেশে আশু দুটি চ্যালেঞ্জ হলাে :
১। কাশ্মীর উপত্যকার ওপর থেকে ৩৭০ ধারা ও ৩৫-এ ধারার রক্ষাকবচ তুলে যেওয়া।
২। নাগরিকত্ব আইন সংশােধন ও নাগরিক পঞ্জীকরণের কাজ শুরু করা।
এবং এই ভয়ংকর স্পর্শকাতর বিষয় দুটি সঠিকভাবে রূপায়ণ ও তার পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া সামলাতে প্রয়ােজন ছিল অমিত শাহর মতােই মানসিক শক্তি ও চাণক্যসম মস্তিষ্কের। মােদীজী জানেন, গােটা দেশের সামনেও এই দুটি বিষয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ দুটি বিষয়ই ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং জনসংখ্যার বিস্ফোরণের মােকাবিলায় সবচেয়ে বড়াে চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনী প্রচারেও বিজেপি এই দুটি বিষয়ের ওপর জোর দিয়েছিল বেশি। রাজনৈতিক সেই প্রচারে বিশ্বাস রেখেছে মানুষ। এখন মানুষের প্রত্যাশার চাপ বাড়বে প্রতিদিন। কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে সেই প্রত্যাশা পূরণের পথে এগােতে হবে এখনই।
কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যদিও দ্বিখণ্ডিত ভারতবর্ষের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ক্ষণে কাশ্মীরই হয়ে উঠেছিল। তৎকালীন ভারত সরকারের কাছে এক জ্বলন্ত সমস্যা। সমস্যা মেটাতে সংবিধানে যুক্ত হয়েছিল ৩৭০ ধারা যা কাশ্মীরে বসবাসকারী জনগণের তৎকালীন প্রয়ােজনের ভিত্তিতে বিশেষ কিছু নাগরিক সুযােগ-সুবিধা সহজে পেতে সাহায্য করেছিল।
ঠিক একইভাবে প্রয়ােগ হয়েছিল ৩৫-এ ধারা যেখানে বলা হয়েছে, কাশ্মীরে জমিজমা ও সম্পত্তি ক্রয়বিক্রয় করার অধিকার থাকবে। শুধু কাশ্মীরবাসীর। অন্য রাজ্য বা রাষ্ট্রের মানুষের সে অধিকার থাকবে না। এমনকি বিবাহসূত্রে অন্য রাজ্যের মহিলা কাশ্মীরের পরিবারের সদস্য হলেও, তাকেও কাশ্মীরে কোনাে সম্পত্তি কেনার অধিকার দেওয়া হবে না।
৭০ বছর আগে যে অধিকার দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন বিশেষ পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, ইতিমধ্যে ঝিলম, বিপাশা, শতদ্রু নদীতে হাজারাে স্রোত বয়ে গেলেও, কেন্দ্রের কোনাে সরকারই আইনের ওই রক্ষাকবচগুলি সরাবার সাহস করেনি। মােদী প্রথমবার ক্ষমতায় এসেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কাশ্মীর সমস্যার অন্যতম এই কারণ দুটিকে নির্মূল করতে হবে। নানা কারণে প্রথম ধাপে তা সম্পন্ন করা যায়নি। কিন্তু এবার তিনি বদ্ধপরিকর। মানুষের রায় পেয়েছেন। একই দেশের মধ্যে আইনের দ্বৈত সত্তা নির্মূল করার রায়। আর সে দায়িত্ব নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর।
আরও বড়াে দায় — দেশকে অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে রক্ষা করে জনবিস্ফোরণের বিপদমুক্ত করা। এজন্য একমাত্র বিজ্ঞানসম্মত পথ নাগরিক পঞ্জীকরণ এবং তা সম্পূর্ণরূপে রূপায়ণের জন্য পরিপূরক ব্যবস্থা হিসেবে নাগরিকত্ব আইন সংশােধন করা। গত পাঁচ বছরে বিজেপি চেষ্টা করেছে, কিন্তু সংখ্যালঘু তােষণকারী রাজনৈতিক দলগুলির তীব্র বাধায় তা সম্পূর্ণ করা যায়নি। এবার মানুষ রায় দিয়েছে তােষণের বিরুদ্ধে। বেআইনি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে। জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে এবং প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে।
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতবর্ষের কংগ্রেস প্রশাসনের ওপর ভারতবাসী চোখ বুজে বিশ্বাস রেখেছিল যে ভারতবর্ষের অখণ্ডতায়। দ্বিতীয়বার হাত পড়বে না। ভারতবাসী শঙ্কিত হবে না আরও একবার ভারতীয়ত্ব এবং হিন্দুত্ব হারাবার। কিন্তু দুঃখের বিষয় এবং দুর্ভাগ্যজনকও বটে, রাজনৈতিক ক্ষমতায় টিকে থাকার লােভে সংখ্যালঘু তােষণের মাত্রা কংগ্রেস সহ বহু জাতীয় ও আঞ্চলিক দল (ব্যতিক্রম শুধুমাত্র বিজেপি) এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে যায় যে এখন গােটা ভারতবর্ষ শঙ্কিত হয়তাে শতাব্দী শেষের আগেই নিজ দেশে পরবাসী হতে হবে ভারতবাসীকে। হয়তাে আরও একবার হারাতে হবে স্বাধীনতা। কেননা—দেশ জুড়ে চলেছে বেআইনি মুসলমান অনুপ্রবেশ আর মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের জনবিস্ফোরণ। একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ১৯৯১-২০০১ সালের মধ্যে গােটা দেশে মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে ২৯.৫২ শতাংশ হারে। সেখানে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৯.৯২ শতাংশ। গােটা বিশ্বের হিসেবে পাকিস্তান এবং ইন্দোনেশিয়ার পর ভারতবর্ষ হলাে তৃতীয় রাষ্ট্র যেখানে মুসলমান জনসংখ্যার হার বেড়ে চলেছে তীব্র গতিতে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্য হলাে পশ্চিমবঙ্গ— যেখানে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার এবং রাজ্যের ৩৪ বছরের জরদগব বামফ্রন্ট সরকার বাংলাদেশী মুসলমানদের জন্য রাজ্যের দরজা উন্মুক্ত করে রেখেছিল। শুধুমাত্র সংখ্যালঘু ভােটব্যাঙ্ককে পুষ্ট করার তাগিদে। ফলে ১৯৮১ থেকে ২০১১–এই ৩০ বছরে মুসলমান জনসংখ্যা বেড়ে গেল ৫.৫ শতাংশ। ২০১১-র হিসেব অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে মুসলমান জনসংখ্যা হলাে মােট জনসংখ্যার ২৭.০১ শতাংশ যা ১৯৫১ সালে ছিল ১৯.৮৫ শতাংশ। এই মুহূর্তে সরকারি হিসেব না পেলেও মুসলমান জনসংখ্যা কমপক্ষে ৩০/৩১ শতাংশ তাে বটেই। কারণ তৃণমূল কংগ্রেসের মুসলমান তােষণের রাজনীতি পুরােপুরি খােলামেলা যেখানে মুখ্যমন্ত্রী নিজেই সাংবাদিক সম্মেলনে তা স্বীকার করে নেন এই বলে—“যে গােরু দুধ দেয়, তার লাথি তাে খেতেই হবে। এর ফলে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলাগুলির জনভিত্তিটাই নষ্ট হতে বসেছে। লােকসভা কেন্দ্রের শুধুমাত্র ভােটারদের সংখ্যা হিসাব করলেই জনভিত্তির পরিমাপটা পরিস্কার হয়ে যাবে। যেমন মুর্শিদাবাদ লােকসভা কেন্দ্র। এখানে হিন্দু ভােটার ২৬.২২ শতাংশ। মুসলমান ভােটার ৭৩.৬৮ শতাংশ। বহরমপুরে হিন্দু ভােটার ৩৯ শতাংশ। ভােটার ৬০.২২ শতাংশ। মালদা উত্তর লােকসভা কেন্দ্রে হিন্দু ভােটার রয়েছেন। ৫০.৬৮ শতাংশ। মুসলমান ভােটার রয়েছেন ৪৯.২৯ শতাংশ। মালদা দক্ষিণে হিন্দু ভােটার সংখ্যা মাত্র ৩৪.৯২ শতাংশ আর মুসলমান ভােটার অনেক বেশি ৬৫.০২ শতাংশ। উত্তর দিনাজপুরের রায়গঞ্জে এখন মুসলমান ভােটার ৫৩.০৫ শতাংশ। হিন্দু ভােটার রয়েছে ৪০.৮৫ শতাংশ। এমনকি বীরভূম, উলুবেড়িয়া, কৃষ্ণনগর, ডায়মণ্ডহারবার, বসিরহাট ইত্যাদি অঞ্চলেও সংখ্যালঘু জনসংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। অস্বাভাবিক হারে। সবচেয়ে দুঃশ্চিন্তার বিষয়– মােট মুসলমান জনসংখ্যার ৩৭ শতাংশই হলাে ৬ বছর থেকে ২৭ বছর বয়সী। তুলনায় বৃদ্ধ বা অতি বৃদ্ধের সংখ্যা যথেষ্ট কম। ঠিক এই হারে যদি পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু জনসংখ্যা বাড়তে থাকে তাহলে ২০৫০ সালে গােটা রাজ্যে হিন্দু হয়ে যাবে সংখ্যালঘু। মুসলমান হবে সংখ্যাগুরু। তখন পশ্চিমবঙ্গ হয়তাে পরিচিত হবে পশ্চিম বাংলাদেশ। এই ভয়াবহ পরিস্থিতির কথা জানেন মােদীজী। জানেন অমিত শাহও। পশ্চিমবঙ্গবাসী এবার বিজেপিকে উজাড় করে ভােট দিয়েছে বা দেবার চেষ্টা করেছে। শুধুমাত্র জাতিসত্তাকে অক্ষুন্ন রাখার স্বার্থে। মুখ্যমন্ত্রী যতই চীৎকার করুন—পশ্চিমবঙ্গে নাগরিক পঞ্জীকরণ করতে দেবেন না, তাঁর সে চীৎকার জনরােষের চীৎকারে ঢাকা পড়ে যাবে। স্বাগতম অমিতজী’ ধ্বনিতে মুখর হবে পশ্চিমবঙ্গ। হবেই। পশ্চিমবঙ্গবাসীর এটাই প্রত্যাশা। এটাই আশ্বাস।
সনাতন রায়
2019-07-12