“কাশ্মীর” নামটি এসেছে কাশ্যপ মুনির নাম থেকে। যাঁকে পুরাণে বলা হচ্ছে ব্রহ্মার পুত্র।
মাইথলজিক্যাল কাহিনিতে আছে~ওই প্রাচীন উপত্যকায় বিশাল একটি হ্রদ ছিল।সতীসার বা পার্বতীসাগর। সেই জলাশয়ে এক দৈত্যের আবির্ভাব ঘটে। পরিত্রাণে কাশ্যপ মুনি দীর্ঘ তপস্যা করে হিমালয়ের কোলে গড়ে ওঠা ওই মনোরম উপত্যকাকে রক্ষা করেন। তাঁর হাতে নবজীবন লাভ করেছিল বলে নাম হয় ~”কাশ্মীর”। কাশ্যপ + মীর বা মার। সেখান থেকেই “কাশ্মীর”।
পাঁচ হাজার বছরের ভারতীয় আর্য সভ্যতার সাথে যুক্ত। মাত্র চৌদ্দশ বছরের আরবীয় সভ্যতার সাথে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়।
শ্রীনগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন রাজা প্রভাকর সেন। না,না।প্রভাকর সম্রাট অশোকেরও আগের। “শ্রী” মানে সুন্দর। মোটেও আরবি ফার্সি বা উর্দু শব্দ নয়। রাজা রামদেব প্রতিষ্ঠা করেন~মাত্তানের মন্দির। সেটাও যীশুখ্রিষ্টের জন্মের আগে।
এরপর বৌদ্ধ কালচার এল কাশ্মীরে। কনিষ্কের তৃতীয় বৌদ্ধ মহা সম্মেলন কাশ্মীরেই হয়েছিল।
কুষাণ বংশের কুখ্যাত মিহিরকুল কাশ্মীরি বৌদ্ধদের নিধনে মেতে ওঠেন। বৌদ্ধরা অনেকেই পার্শ্ববর্তী স্থানে আশ্রয় নেয়। সেই স্থানটি আজ তিব্বত। যা চিন নামের মাওবাদী সন্ত্রাসী উৎপাদক দেশটি দখল করে রেখেছে। বাকি যারা বৌদ্ধ আজও তারা লে বা লাদাখে আছে~’থ্রি ইডিয়টস’-এর ফুংচুক ওয়াংড়োর মতন।
এরপর কাশ্মীরে এল শৈব যুগ। অষ্টম শতাব্দীতে এলেন বসুগুপ্ত। কালট্ট ভট্ট, সোমানন্দ, উৎপল দেব, ক্ষেমেন্দ্র, দামোদর গুপ্ত~এক সে বড়কর এক বড় বড় পণ্ডিত শাস্ত্রী এই কাশ্মীরের সুসন্তান। বিশ্ববিখ্যাত “কথা সরিৎসাগর” কাশ্মীরি পণ্ডিত সোমদেবের লেখা।
জগৎবিখ্যাত ভারতীয় রসশাস্ত্রবিদ আলংকারিক অভিনব গুপ্ত তো কাশ্মীরেরই ছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্য দর্শনের অজস্র গ্রন্থ প্রণেতা কাশ্মীরি। প্রকৃতির কোলে লালিত হয়েছিলেন বলেই হয়তো এত এত সৃষ্টি সম্ভব হয়েছিল।
বিখ্যাত কাশ্মীরি পণ্ডিত বিলহনের কথা কে না জানে! তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি “চৌর পঞ্চাশিকা”।
কাশ্মীরেরই গুণাঢ্য “বৃহৎকথা” লিখেছিলেন পৈশাচী প্রাকৃতে।
কাশ্মীরের প্রাচীন হিন্দু সভ্যতার সবচেয়ে প্রামাণ্য দলিল কলহন-এর “রাজতরঙ্গিনী”। দ্বাদশ শতাব্দীর এই গ্রন্থে মোট ৭৮২৬ টি শ্লোক আছে। ১১৪৮ থেকে ১১৪৯ খ্রি~এই সময়সীমার মধ্যেই তিনি এই মহাগ্রন্থ রচনা করেন।
কাশ্মীরে ইসলামাইজেশন শুরু হয়েছিল এই তো কয়েক শতাব্দী আগে। মহম্মদ গজনভি নামে এক হানাদার আক্রমণ করে কাশ্মীর। যেভাবে ডাকাত বখতিয়ার খিলজি নদিয়া আক্রমণ করেছিল। কাশ্মীরে তখন রানির শাসন। রানির এক বিশ্বাসঘাতক মন্ত্রী(যেমনমির জাফর) শাহ মিরসেই ব্যাটা নিজেকে তখন রাজা ঘোষণা করে। রানি ইজ্জত বাঁচাতে আত্মহত্যা করেন। কাশ্মীরে ইসলামি শাসনের শুরু তখন থেকেই। এরপর যথারীতি যা হয়ধর্ষণ, গণিমতের মাললুণ্ঠনধর্মনাশওই নাদির শাহ, সুলতান মাহমুদ, মহম্মদ ঘোরি~এদের পথেই ইসলামাইজেশন। সিকন্দর নামে এক শাসনকর্তা (১৩৯৪-১৪১৬খ্রি) তো চরম অত্যাচার করেছিল। তথ্যসূত্র হুবহু দিচ্ছি “সিকন্দরের কাজ ছিল হিন্দু মন্দিরাদি ধ্বংস করা এবং হিন্দুদের জবরদস্তি করে ধর্মান্তরিত করা।”(কাশ্মীর ৬৫, পৃ. ৯)।
অন্তবর্তী পর্বে উদারচিত্ত মোগল সম্রাট আকবর কাশ্মীরের স্থিতাবস্থা অনেকটাই ফিরিয়ে আনেন। আর রোমান্টিক কিসিমের জাহাঙ্গির ভেরিনাগ, আছিবল, নাসসিম, শালিমার,~বেশিরভাগ গুলবাগিচা ফুলবাগিচার জনক। প্রেয়সী পত্নী নুরজাহানের আগ্রহে)।
১৭৫০-এ পাঠানেরা হামলা করে আহমদ শাহ দুরানির নেতৃত্বে। কাল্পনিক ধর্মরাজ্য স্থাপনের লক্ষে। হত্যা ও ধর্মান্তরকরণ চলে অবাধে। চরম অরাজকতা। কাশ্মীরি হিন্দু বৌদ্ধরা পাঞ্জাব কেশরী রণজিৎ সিঙের সাহায্য প্রার্থনা করে। ১৮১৯-এ শিখ বাহিনী কাশ্মীরকে হানাদার পাঠানদের হাত থেকে উদ্ধার করে। রাজা গুলাব সিঙের নেতৃত্বে। কাশ্মীরের রাজা হরি সিং এই গুলাব সিঙেরই বংশধর, যিনি ১৯৪৭-এ নবগঠিত ভারতেই যুক্ত থাকার জন্য সিদ্ধান্ত নেন।
ড. প্রশান্ত চক্রবর্তী
তথ্যসূত্র :
১. পাকিস্তানের বিচার~রেজাউল করিম।১৯৪২।
২. কাশ্মীর ৬৫~আনন্দবাজার সংকলন। ১৯৬৫
৩. Kashmir Shaivaism–Jagadish ch. Chatterje
৪. Kashmir in Crucible–Premnath Bajaj, 1967
৫..Kashmir : The Playground of Ashia, Sachhidananda Sinha. 1945