গল্পটা ফ্রাঙ্ক কাফকার। কাফকা ছোট বেলা থেকেই রুগ্ন ও অসুস্থ থাকতেন। ওঁর বাবা হরমন কাফকা এইজন্য ছেলেকে মোটেই পছন্দ করতেন না। দীর্ঘ মজবুত শরীরের অধিকারী হরমন কাফকা ছেলেকে দুর্বল স্বাস্থ্যের জন্য ঘৃণা করতেন;অপদার্থ মনে করতেন ছেলেকে। হরমন কাফকা ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কসাইয়ের কাজ করতেন। তারপর, বহু সংগ্রামের মাধ্যমে নিজের ব্যবসা দাড় করান। তাই, অবচেতনেই রুগ্ন ফ্রাঙ্ককে নিজের ছেলে বলে মেনে নিতে পারতেন না। ছেলের উপর অকারণেই উৎপীড়ন করতেন। ফ্রাঙ্কের তখন নয় বছর বয়স। একদিন রাতে ঘুমের সময়, ফ্রাঙ্ক মায়ের কাছে জল খেতে চান। কিন্তু, তাঁর বাবা হটাৎ তাঁর উপর ক্ষিপ্ত হয়ে বাড়ির খোলা বারান্দায় বের করে দেন।
প্রাগের প্রচন্ড ঠান্ডা রাত। ফ্রাঙ্ক কাফকা সারারাত খোলা বারান্দায়, একটা পাতলা শার্ট পরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। কিন্তু, নিজের অপরাধ কী ছিল, সেটাই বুঝতে পারেননা। সেইদিনের ঘটনা কাফকার মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন আনে। এরপর থেকে তিনি আর কখনো বাবার কথা অমান্য করেননি। সর্বদা বাবার ভয়ে তটস্থ থাকতেন। বাবাও ছেলের ভয় দেখে, তার করা অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়েই চললেন। কিন্তু, ফ্রাঙ্ক কাফকা বাবার এই আচরণকে স্বাভাবিক মনে করতে লাগলেন। এমনকি, প্রেমিকা ডোরাকেও কাফকা বিয়ে করতে পারেননি, বাবার ভয়েই। তবু, তিনি স্বপ্ন দেখতেন, ডোরাকে বিয়ে করে ইসরাইলে সংসার করার। তাঁর অমর লেখাগুলোকে কাফকা অপাঠ্য মনে করতেন। তাই, 1924 সালে,মাত্র 39 বছরে ওনার মৃত্যুর আগে খুব কম লেখাই প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বাবা হরমন কাফকাও কখনো জানতে পারেননি, ছেলে ভবিষ্যতে বিরাট সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হবেন। মৃত ফ্রাঙ্ক সম্পর্কে তিনি সর্বদা ঘৃণা পোষণ করে গেছেন।
কাফকার লেখাতেও আমরা বারবার তাঁর বাবার আচরণের প্রতিচ্ছবি পাই। দুর্বলের প্রতি সবলের আধিপত্য, যেখানে অতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। Ethics of Morality নিতান্তই কথার কথা; আরো নগ্ন ভাবে বললে, ফালতু কথা। যার হাতে ক্ষমতা আছে, সে তার চরম ব্যবহার করবে, এটাই স্বাভাবিক।
কাফকাদের পরিবার ইহুদি ছিল। অস্ট্রিয়া দখলের পর হিটলার দলে দলে ইহুদিদের যখন আউৎভিতজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পাঠাচ্ছিল, হ্যা, সেই ইহুদি দলে কাফকার পরিবারও ছিল। কাফকা অসুস্থ অবস্থায় প্রয়াত না হলে, হয়ত তিনিও সেই দলেই থাকতেন।
আচ্ছা, হিটলার ঘরের ভেতরে কী পরে ঘুরতেন? জার্মানিতে যা ঠান্ডা! নিশ্চই হাওয়াই চটি জাতীয় কিছু। সেই চটি জোড়া কি পাওয়া গেছে? মানে, সেটা কি কোনো ভাবে রবীন্দ্রনাথের দেশে আসতে পারে? জানিনা। তবে, এইটুকুই জানি, আমাদের সবার মধ্যেই 'কাফকায়ত্ব' আছে। নইলে, আমাদের চারপাশে ঘটে চলা ধারাবাহিক অন্যায় কিকরে আমরা নির্বিকার চিত্তে মেনে নেই! যখন আমাদের নির্বাচনী অধিকার হরণ করা হয়, আমাদের কাফকায়ত্ব প্রতিবাদ করতে বাঁধা দেয়। কন্টাক্টর রাস্তা খারাপ জিনিস দিয়ে তৈরি করছে দেখেও আমরা চুপ করে থাকি। শাসকদলের নির্দেশে, প্রতিদিন মৌলিক অধিকারগুলির হত্যা দেখেও আমরা চুপ করে থাকি। বিরাট প্রশাসনিক শক্তি আর শাসকদলের ক্ষমতার কাছে নিজেদের অসহায় মনে করি; এটাই আমাদের 'কাফকায়ত্ব'।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট দানবীয় শাসকদল, যেকোনো সময় আমাদের পোকা মাকড়ের মত পিষে মারতে পারে। আমাদের সমস্ত অধিকার করতে পারে পদদলিত। কিন্তু, আমাদের মগ্নচৈতন্যে লুকিয়ে থাকা কাফকা এটাকে শাসকদলের অধিকার মনে করে। তাই, বাগটুই হোক বা মরিকঝাঁপি, শাসকদলের হয়ে সাফাই দেওয়ার লোকের অভাব নেই। বোম্ব ব্লাস্ট তখন হয়ে যায়, শর্ট সার্কিট, মরিকঝাঁপি চলে যায় বিস্মৃতির অন্তরালে। মেরুদণ্ড ততক্ষণ পর্যন্ত বাঁকানো চলে, যতক্ষণ না হিটলারের হাওয়াই চটির কিছুটা জিভে উঠে আসে। এই হাওয়াই চটি কিন্তু অক্ষয়। একের পর এক শাসকের পায়ে এটা ঘুরতে থাকে। আর, এই চটির এমন মহিমা জনগণ ঝাঁকে ঝাঁকে এর বশীভূত হয়। চরম বেকারত্ব, পার্ক স্ট্রিট গণধর্ষণ, সগর্বে ঘুষ হওয়ার চিত্র,চিটফান্ড কেলেঙ্কারি, রামপুরহাট গণহত্যা সব চাপা পড়ে হাওয়াই চটির নীচে।
' ফ্যাসি' অর্থ আকর্ষণী ক্ষমতা। প্রতিটা ক্ষমতা একটা 'ফ্যাসি সার্কেল' তৈরি করে। সেই সার্কেলে আটকা পড়ে শাসক নিজেই। একসময়ের সততার মূর্তি কখন হিটলার হয়ে যায়, টেরই পাওয়া যায় না। রামপুরহাট-বাগটুই কবে আউৎভিতজ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত হয়, জানতেই পারা যায় না। এমনকি, যারা তাদের স্বজন হারায়, তারাও একসময় চটির কাছে মাথা ঝোঁকায়। লাশও বিক্রি হয়। ভালো দামেই। চাকরি, বিপুল অর্থ, ভোটের টিকিটের বিনিময়ে স্বজন হারানো শোক বিক্রি হয়। সত্যিই তো! শোক কি উচ্চাকাঙ্ক্ষা মেটাতে পারে! সেটা মেটাতে পারে, একমাত্র ক্ষমতা। ফ্রেডরিক নিতসে বলেছিলেন, 'ঈশ্বর মৃত'। তিনি যদি সত্যিই থাকতেন, হিটলার বা হিটলারের হওয়াই চটি পরা দানব কিছুই তৈরি হতো না। শুধু শিশুদের লাশগুলোর মত আমরাও একসময় মেনে নেই, ক্ষমতা কখনো অন্যায় করতেই পারে না; আমাদের সবার অবচেতনে লুকিয়ে থাকা নয় বছরের কাফকা, সেটাই আমাদের বোঝায়…
সুমন চক্রবর্তী