‘আবর্তিয়া ঋতুমাল্য করে জপ, করে আরাধন দিন গুণে গুণে’–বসন্তের প্রত্যাশায়। বর্ষণসিক্ত ধরিত্রীর ভূমিগর্ভ হতে উৎসারিত শষ্যরাশি কঠোর পরিশ্রমে সেই হেমন্তেই হয়েছে গোলায়ভরা, শীতের রুক্ষতাও চলে গেছে ‘তাই আজি ধরিত্রীর যত কর্ম, যত প্রয়োজন হল অবসান।’ পরিশ্রমী মানুষেরা তাই আজ হাঁফ ছেড়েছে, হাঁফ ছেড়েছে প্রকৃতিও। কান পাতলে শোনা যায় বকুলে বকুলে শুধু মৌমাছির গুঞ্জন, চারদিকে শুধু অশোক-পলাশ-শিমুলের হোরিখেলা। আকাশে-বাতাসে শুধু অকারণ পুলকে মেতে ওঠা ক্ষণিকের আহ্বান। এমন দিনেই তো নবআনন্দে জেগে ওঠে শরীর, মন, এমন সময়ই তো হওয়া উচিত শুভ নববর্ষ।
তাই আজ বর্ষপ্রতিপদ। আজ চৈত্র শুক্ল প্রতিপদ। দিন ও রাত প্রায় সমান। নাই শীতের কামড়, নাই উষ্ণতায় নেয়ে ওঠা। তমসা রাত্রি থেকে আলোকোজ্জ্বল দিন হবে উত্তরোত্তর দীর্ঘায়িত। এমনই এক শুভদিনে ব্রহ্মপুরাণ অনুসারে মানব জাতির আবির্ভাব ঘটেছিল তাই আজই সমগ্র মানবজাতিরও নববর্ষ।
হিন্দুকালগণনা জ্যোতির্বিদ্যা অনুসারী হওয়ায় তা বিজ্ঞানসম্মতও বটে। প্রাচীনকাল থেকেই যুগ যুগ ধরে এই বর্ষপ্রতিপদকেই নববর্ষের শুভ সূচনা হিসাবে মান্য করার এক রীতি আছে আমাদের দেশে। তাই বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে এই দিনটি। ঘটনাবহুল এই শুভদিনটি আমাদের পূর্ব পুরুষদের শৌর্যবীর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ত্রেতাযুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল এই বর্ষপ্রতিপদ-এর শুভ দিনটিতেই। পরবর্তী যুগে যুধিষ্ঠির সাল গণনা ছাড়াও কলিযুগাব্দ (৫১০৯) শুরু হয় বর্ষপ্রতিপদ থেকেই। মহারাজ বিক্রমাদিত্যের রাজ্যাভিষেকের তিথিও ছিল বর্ষপ্রতিপদ এবং সেদিন থেকেই ‘বিক্রমসংবৎ’ চালু হয় অর্থাৎ আজ থেকে ২০৬৪ বছর আগে। তিনি অত্যাচারী বর্বর শকদের পরাজিত করে হিন্দুদের মধ্যে জাতীয় চেতনার সঞ্চার করেছিলেন তাই তিনি ‘শকারি বিক্রমাদিত্য’। তার ঠিক একশ পঁয়ত্রিশ বছর পর দাক্ষিণাত্যের অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশের বীর রাজা শালিবাহন পুনরায় আক্রমণকারী বিদেশী শকদের পরাজিত করে ‘শকাব্দ’-এর প্রবর্তন করেন শুভ বর্ষপ্রতিপদ তিথিতে। তা আজ থেকে ১৯২৯ বছর আগের কথা। পরাধীন ভারতবর্ষে প্রখ্যাত সমাজ সংস্কারক স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৭-১৮৮৩) ধর্ম সংস্কারকল্পে ‘আর্য সমাজ’-এর প্রতিষ্ঠা করেন এই দিনটিতেই। বর্ষপ্রতিপদের দিনটি শুধুমাত্র নববর্ষের প্রথমদিন হিসাবেই নয়, ভারতবর্ষের বহু মহাপুরুষের জন্মতিথি এটি। সিন্ধু প্রদেশের মহান সাধক সন্ত ঝুলেলাল, দ্বিতীয় শিখগুরু অঙ্গদদেব (১৫৩৯-১৫৫২) এই দিনেই জন্মগ্রহণ করেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা পূজনীয় ডাক্তারজী অথাৎ ডাঃ কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারজীও বর্ষপ্রতিপদের পুণ্য লগ্নে (১ এপ্রিল, ১৮৮৯) মহারাষ্ট্রের নাগপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
শ্রীরামচন্দ্র, যুধিষ্ঠির-এর উত্তরসূরী বিক্রমাদিত্য, শালিবাহন কিংবা অঙ্গদদেবের ক্ষাত্ৰতেজ এবং সন্ত ঝুলেলাল, স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর আধ্যাত্মিকতার আলোকে উজ্জ্বল ডাক্তারজীর মধ্যে যেন প্রকাশ পেয়েছিল তাঁদের উত্তরাধিকার তীব্র দেশপ্রেম ও স্বাভিমান বোধ, বিজিগীষু ভাব ও সৌভ্রাতৃত্ববোধ। মূর্ত হয়েছিল সঙ্ঘশক্তির অমোঘ আহ্বান। তাই দেশপ্রেমে আধারিত, হিন্দু চেতনায় উদ্বুদ্ধ, ত্যাগের দীপ্তিতে উজ্জ্বল এবং সংগঠন কুশলতায় নিরূপম ডাক্তারজী অন্তরাত্মার আহ্বানে যে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ দেশমাতার সেবায় তথা ধর্মরক্ষায় দৃঢ়প্রত্যয়ে এগিয়ে চলেছে পরম বৈভবশালিনী ভারতজননীকে জগৎজননী করার প্রতিজ্ঞায়। সঙ্ঘের চেতনার ফলিত রূপ আজ দেশে বিদেশে বহুভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। একটি কাহিনীর উল্লেখ করা যেতে পারে।
সঙ্ঘ চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিদ্যাভারতী সারা দেশে সমাজসেবায় নিবেদিত। তিব্বত সীমান্তের কাছে উত্তরপ্রদেশের পিথোরগড় জেলার একটি ছোট গ্রামে ‘ভোটিয়া’ একটি ছোট গোষ্ঠী। স্বয়ংসেবকরা বর্ষপ্রতিপদের দিন সেই গ্রামে বিদ্যালয় খোলার জন্য গিয়ে হাজির হলেন। বৰ্ষপ্রতিপদ বিক্রমসংবৎ-এর প্রথমদিন হওয়ায় স্বয়ংসেবকরা ভোটিয়াদের নববর্ষের অভিনন্দনের সঙ্গে বিক্রমাদিত্যের একটি ছবিও উপহার দিলেন। ভোটিয়ারা রাগে সেই ছবি ছিঁড়ে ফেললেন। কারণ তাঁরা নিজেদের শকদের বংশধর বলে মনে করেন। বিক্রমাদিত্য শকদের হারিয়ে ভারতছাড়া করেছিলেন। যাই হোক, স্বয়ংসেবকরা তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় সমস্যা ও অসুবিধা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে জানতে পারলেন যে তাঁদের গ্রামের কাছাকাছি কোনও বিদ্যালয় না থাকায় তাঁদের খুবই অসুবিধা। ভোটিয়ারা স্বয়ংসেবকদের কাছে অনুরোধ করলেন একটি বিদ্যালয় করে দেবার জন্য। শিশু মন্দির স্থাপিত হল। কালক্রমে দেখা গেল, যে গ্রাম হিন্দু বিদ্বেষী হয়েছিল, সেখানেই সংস্কৃত শ্লোক, গান ও দেশপ্রেমের প্রার্থনা হচ্ছে। বিভেদ দূর হল এবং তা সম্ভব হল সঙ্ঘ চেতনা তথা আদর্শের ফলিত রূপায়ণে।
বর্ষপ্রতিপদের পুণ্য প্রভাতে সেই রাষ্ট্রতপস্বী ডাক্তারজীর চরণে শতকোটি প্রণাম।
ডাঃ শিবাজী ভট্টাচার্য