হিরের দ্যুতি সেইমুখমণ্ডলে। সাধারণ একান্নবর্তী পরিবারের জননী। ভারতজননী বলতে সাধ হয়। এরকম যাঁর অপার্থিব হাসি, তাকে অন্য কোন নাম দেব? আর ওই মাধুর্যের প্রতিমূর্তি যশোদা! নাগরিক উন্নাসিক আধুনিক দৃষ্টিতে তাঁকে পুরুষ শাসিত সমাজের অত্যাচার-ক্লিষ্ট একটি বেদনাদীর্ণ নারী বলে আঁকা সম্ভব। সত্যি তো, বিবাহ রাত্রে যাঁকে তাঁর সদ্য বিবাহিত স্বামী পরিত্যাগ করে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘে যুক্ত হবার কথা জানিয়ে চলে গেছেন জীবনের বৃহত্তর ডাকে—তার মতো নারী-দ্বেষী আর কে ? প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, এই যদি ইচ্ছা ছিল— তবে বিয়ে করার কী প্রয়োজন ছিল? পরিবারের চাপ অস্বীকার করতে পানেনি— শুধুমাত্র এই অজুহাত কতটা গ্রাহ্য বলতে পারব না। জগতে এমন আশ্চর্য ঘটে। মহারাজ শুদ্ধোধন তার শাক্য রাজ্যে উত্তরাধিকারীকে তো এই ভাবেই বিবাহবন্ধনে সংসারবৃত্তে আবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্যদেবও তো দ্বিতীয় স্ত্রী বিষ্ণুপ্রিয়াকে ত্যাগ করে চলে গেলেন গঙ্গার ওপারে কণ্টকনগর। উপেক্ষিতা যশোধরা আর বিষ্ণুপ্রিয়ার মতো কিছু চমক্কার আমাদের আধ্যাত্মিক গরিমায় মহোজ্জ্বল মাতৃভূমিতে আছে। তবে আজকের প্রসঙ্গ যশোদাবেনের নিরম্বু উপবাস। স্বামীর সাফল্য কামনায় এই ব্রত উদ্যাপন এক অন্য ভারতবর্ষকে চিনিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এ সেই ভারতবর্ষ, যা নৃপতিরে শিখায়েছে’ ‘ত্যাজিতে মুকুট দণ্ড সিংহাসন ভূমি, ধরিতে দরিদ্র বেশ।অন্যদিকে ওই যশোদা বেন, সেমিনার জটলায় বেরিয়ে পড়েননি— ভাঙার চেয়ে রক্ষা বেহুলার মতো, সাবিত্রীর মতো তার যাত্রা, তাও কি নয় অন্য ভারতবর্ষের ছবি! দ্বিতীয়বার বিপুল জনসমর্থন নিয়ে ভারতের শাসনভার যাঁর হাতে এল— তিনি এই নতুন আদর্শকে তুলে আনলেন প্রতীকের মতো।
এবছর লোকসভায় মাতৃশক্তির উপস্থিতি উল্লেখযোগ্য। তারা প্রমাণ করেছেন, অধিকার পেতে নেতিবাচক সংখ্যা নয়—ইতিবাচক সংকল্প জরুরি। ঘৃণা, লোভ, হিংস্রতম অপশব্দও আমরা শুনেছি। কত যে কালনেমির রাজ্য ভাগ হলো। কেউ সারি সারি হাতি আর নিজের মূর্তির সামনে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সহাস্য নারী-নার্সিসাস হয়ে আবির্ভূত হলেন। দিকে দিকে ফ্লেক্স শোভিত সততার প্রতীক এল গেল। সকলের ভাষা শুনে মনে হলো নর্দমায় হয়তো দুর্গন্ধ একটু হলেও কম। এরাও নারী। তবে এরা কোন ভাঙনের পথে এসেছেন তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে বিচিত্র সব রাজনৈতিক ভাষ্য আমরা শুনেছি। বহুজন সমাজ নাকি দেশের ৮৫ শতাংশ। ব্রাহ্মণের উপবীত, ক্ষত্রিয়ের তরবারি আর বেনিয়ার তুলাদণ্ড হঠিয়ে আসুক ‘শূদ্রযুগ। সেটাই তো কাম্য। স্বামী বিবেকানন্দ তাই চেয়েছিলেন নাকি? কিন্তু বহুজন সমাজের নামে টাকার মালাপরা হাস্যময়ী মহামায়া কি সেই আদর্শ মানেন? এক কথায় বলছি—না। ছিল সমাজবাদের যাদব-মুসলিম ঐক্যের ভাষ্য, রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের মতে‘মাইইকুয়েশন’। একই অঙ্ক ছিল বিহারে। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারির প্রমাণিত অপরাধীরা যখন নরেন্দ্র দামোদর মোদীকে চুরির অভিযোগে অভিযুক্ত করে তখন বিধাতাপুরুষ নিশ্চয় আড়ালে হাসেন। কালিদাস একেই ত্র্যম্বকের হাসি বলে থাকবেন। কংগ্রেস ছিল KHAM অর্থাৎ ক্ষত্রিয়-হরিজন-আহির-মুসলমান ঐক্যের অঙ্ক। ছিল পরিবারতন্ত্রের বিচিত্র অহংকার। বুয়া-বাবুয়া’র বিচিত্র ঐক্যও ছিল। ১৯ জানুয়ারির ব্রিগেড ময়দানে ‘ডিভাত-সমাবেশ ছিল। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, পঞ্জাব থেকে অসম— এক বহুরূপী সমাবেশ থেকে নানা ভাষায় কী যে হলো, দানা বাঁধলো না। আসলে নেতারা একত্র হয়ে হাতে হাত জড়ো করলেই জনতা এক হয় ? না। নতুন এক ভারত উঠে আসছে। তারা জাতপাতে বিশ্বাস করে না। জীবনকে দেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে । এই সব খণ্ড-বিখণ্ড, টুকরো-ছিন্ন করার অঙ্ক তারা ব্যর্থ করে দিল। নতুন ভারতের এই নতুন প্রজন্ম নেতা-নেত্রীদের মঞ্চ নাটক অপছন্দ করেছে। জাতপাতের পাটিগণিত নয়, নতুন প্রজন্ম আমাদের দিশা দেখাচ্ছে অভিনব এক রসায়নে। এই রসায়ন আধুনিকতা আর চিরাচরিতকে মিশিয়ে নতুন ভারত নির্মাণ করেছে। আমরা ভাগ্যবান, নতুন ভারতকে নতুন মহাযুগের দিকে যাত্রাপথের সাক্ষী হবার সৌভাগ্য আমাদের হলো।
সবাই সংশয় ত্যাগ করতে পারেনি। অনেক অপপ্রচার হয়েছে। বিশেষত ভারতের সর্বত্র একটি প্রচার বিক্রীত গণমাধ্যম আর বিকৃত রাজনীতি ছড়িয়ে দিয়েছে। প্রচারটির দুটি দিক— দুধারী তলোয়ার বলা যায়। একদিকে বলা হলো নতুন রাজনৈতিক দলটি ভয়ংকর। তারা ভারতকে ‘হিন্দুরাষ্ট্র তৈরি করবে। সমস্ত দলিতদের অপর (Out Caste ) করবে তারা। আর এই নব্য ব্রাহ্মণ্যবাদের অন্তঃসার হবে মনুসংহিতার মতো প্রাচীন রক্ষণশীল স্মৃতি ও শাস্ত্র। একথা কীভাবে বোঝা গেল ? পশ্চিমে রিপাব্লিক পার্টির নেতা রামদাস আঠোয়ালে তো ড. বি আর আম্বেদকরের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী। তাকে সসম্মানে স্থান দিয়েছে এনডিএ। বিহারে তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর নেতা রামবিলাস পাসোয়ান, অনগ্রসর সমাজের নেতা নীতীশ কুমার কি এই নতুন ভারতের যৌথযাত্রায় কিছুমাত্র অপর? পশ্চিমবঙ্গের কথা ধরুন। উত্তরবঙ্গে রাজবংশী-গোখা-তামাং-লিম্বু-ভুইমালী-কোচমেচ-রাভা-মদেশিয়া-দেশি-ধানুকী-গণেশতি; পশ্চিমবঙ্গে বাউড়ি-বাগদি-গোপ-মাহাতোবনবাসীদের ঐক্য না ঘটলে বিজেপির এই ফল হতো না। একই কথা মতুয়া-নমশূদ্রপৌণ্ড্র সমাজের পক্ষেও। এই বিপুল তথাকথিত নীচু সম্প্রদায় কেন রাজ্যের শাসক দলকে পরিত্যাগ করলেন? সারা দেশেও একই ঘটনার কথা আগেই বলেছি। কারণ একটাই—ভারত এখন নতুন মহাযুগে দুটি জাতিতে পরিণত হয়ে আসছে। এক যারা উন্নয়নের সুফল পায়নি আর দুই—যারা অন্য অংশকে টেনে আনার দায় গ্রহণ করতে চায়। সরকারের কাছে বিপুল আশা। আশা করি এই সমন্বয় সাধন তারা করতে পারবেন। হিন্দু কাউকে অপর করে না— সবার হস্তে পবিত্র হয় মাতৃ-অভিষেকের তীর্থবারি।
মিথ্যা প্রচারের চরম হয়েছে দেশের দ্বিতীয় সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের আশঙ্কায়। বিজেপিনাকি মুসলমান বিরোধী। ভাবাটা অমূলক নয়। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে। কী ছিল তখনকার পাকিস্তান আন্দোলনের দাবি দ্বিজাতিতত্ত্ব। জিন্না -ইকবাল -ফজলুল হকদের প্রস্তাব ছিল ভারতীয় মুসলমানরা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি জাতি। তাই তাদের আলাদা দেশ চাই। এই চুক্তি আমরা মানিনি। হিন্দু মহাসভার বীর সাভারকর বলেছেন, মুসলমানরা পৃথক থাকতে চাইলে থাকুন। পাকিস্তান হোক, কিন্তু আলাদা রাষ্ট্র যেন না হয়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী র্যামজে ম্যাকডোনাল্ডের দেওয়া বিশেষ অরিরিক্ত ভোট নয়—সকলের জন্য এক ভোট থাকুক। ম্যাকডোনাল্ড প্রদত্ত অ্যাওয়ার্ডের সুযোগ স্বেচ্ছায় অস্বীকার করে হিন্দু সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসেন ড. আম্বেদকর। তফশিলি জাতিকে হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চাননি বলেই তিনি পুনা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। দেশবিভাগ নিয়ে তার থটস্ অন পাকিস্তান’ গ্রন্থে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। মুসলমানদের দাবি মেনে পাকিস্তান হোক— সমস্যর স্থায়ী সমাধানের জন্য সাত শতাংশ জনবিনিময় হোক।
দেশবিভাগ হয়েছে, কিন্তু বীর সাভারকর বা ড. আম্বেদকরের প্রস্তাব মানা হয়নি। উপরন্তু ‘নেহরু-লিয়াকত চুক্তি’-র মতো অসার চুক্তি হয়েছে। ফলে পাকিস্তান, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাস্তুহারা অ-মুসলমান জনতার আগমন ঘটেছে। ভারতে। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সেই চুক্তির প্রতিবাদে নেহরু মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করেন। আজকে মুসলমান সমাজকে নিছক ‘ভোটব্যাঙ্ক হিসেবে ব্যবহার করার সময় আদর্শহীন ভোটসর্বস্ব দলগুলি সেই মিথ্যা কাহিনি এবারকার নির্বাচনেও ব্যবহার করে মুসলমানদের মোদী-বিরোধী অন্ধতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী হবার প্রাক্কালে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএ)-এর নেতা নির্বাচিত হবার পরবর্তী ভাষণে নরেন্দ্র মোদী যা বলেছেন, তাতে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। মুসলমান সমাজের অধিকাংশকে ধর্মনির্ভর কুম্ভীপাকে ফেললেও বিগত শাসকবর্গ তো তাদের আধুনিক শিক্ষা ও আর্থিক উন্নতির জন্য পরিকাঠামো তৈরি করেনি। আজও যদি তারা এদেশে থেকে পাকিস্তানে বৃষ্টি পড়লে মাথায় ছাতা ধরে তাহলে মুশকিল। জাতীয় সংগীত গাইব না, বন্দে মাতরম্ বলব না, ভারতমাতার জয় বলতে জিভ শুকিয়ে আসবে— এমন হলে তো চলবে না!
উত্তর প্রদেশে এক মুসলমান মহিলা গত ২৩ মে তার সন্তানের নাম রেখেছেন নরেন্দ্র মোদী। উদ্দেশ্য হলো, সৎ ও চরিত্রবান হোক তার সন্তান। নতুন যুগ এসেছে ভারতবর্ষে। ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ ঘটিয়ে নতুন সরকার চাইছে ‘সবকা বিশ্বাস। ভীতি-অবিশ্বাসের গলি থেকে বের হয়ে আসুন ভারতের মুসলমান সমাজ। না হলে নতুন ভারত গড়া অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আর তা না হলে কিন্তু ট্রেন ফেল করতে হবে। দ্বিতীয় পথ নেই।
ড. অচিন্ত্য বিশ্বাস
2019-05-31