জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির আদিকথা – প্রাক কথোপকথন

প্রদীপ জ্বালানোর আগে সলতে পাকাতে হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নামক প্রদীপটির সলতে হল ঠাকুর পরিবার। তাই রবীন্দ্রনাথকে জানার আগে ঠাকুর পরিবারকে জানতেই হয়।রবীন্দ্রনাথের জন্মের আগে থেকেই বাংলার আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের সঙ্গে ঠাকুর পরিবারের নাম ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলন বা প্রিন্স দ্বারকানাথের ব্যবসা উদ্যোগের ইতিবৃত্ত অনেকেরই জানা। কিন্তু ঠাকুর পরিবারের ইতিহাস আরও পুরনো। কৃষ্ণ কৃপালনী তাঁর “দ্বারকানাথ ঠাকুর: বিস্মৃত পথিকৃত” গ্রন্থে ঠাকুর পরিবারের আদি ইতিহাসের যে চিত্র এঁকেছেন তা রীতিমতো বিস্ময়কর।মনে করা হয়, ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ ছিলেন শাণ্ডিল্য গোত্রীয় বেদজ্ঞ পণ্ডিত ভট্টনারায়ণ। সংস্কৃত সাহিত্যে তাঁর প্রসিদ্ধি “বেণীসংহার” নাটকের রচয়িতা রূপে। ভট্টনারায়ণের সঠিক সময়কাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও, মোটামুটিভাবে তিনি খ্রিষ্টীয় সপ্তম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যবর্তী কোনো এক সময়ে বর্তমান ছিলেন।ভট্টনারায়ণের বংশধর ধরণীধর ছিলেন “মনু সংহিতা”-র টীকাকার। ধরণীধরের পৌত্র ধনঞ্জয় ছিলেন বল্লালসেনের রাজ্যের একজন ন্যায়াধীশ এবং বৈদিক শব্দের ‘নির্ঘণ্ট’-এর সংকলক। তাঁর বংশধর হলায়ুধ লক্ষ্মণসেনের প্রধানমন্ত্রী হন। তিনিও অনেক সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করেছেন। এই সকল কিংবদন্তীর ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে নানা মত থাকলেও, একথা সকলেই মনে করেন যে ভট্টনারায়ণের বংশধরেরা অনেকেই বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হন।নগেন্দ্রনাথ বসু ও ব্যোমকেশ মুস্তাফি “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস” গ্রন্থে ঠাকুর পরিবারকে ভট্টনারায়ণের চতুর্দশ পুত্র দীনের সাক্ষাৎ বংশধর বলে উল্লেখ করেছেন। মহারাজ ক্ষিতিশূর দীনকে বর্ধমানের নিকটবর্তী কুশ নামক একটি গ্রাম দান করেছিলেন। এই গ্রামের নামানুসারে দীন ও তাঁর বংশধরেরা ‘কুশারী’ পদবীতে ভূষিত হন। পরবর্তীকালে কুশারীরা বর্ধমান থেকে চলে আসেন যশোহর-খুলনা অঞ্চলে।মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ পারিবারিক শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানে উর্ধ্বতন দশ পুরুষের যে নামাবলি আবৃত্তি করতেন, তাতে প্রথমেই থাকত পুরুষোত্তম অর্থাৎ পুরুষোত্তম বিদ্যাবাগীশের নাম। তিনি ছিলেন ভট্টনারায়ণের অধস্তন পঞ্চবিংশতিতম (২৫) পুরুষ। পুরুষোত্তমের সময়েই ঠাকুর পরিবারের পারিবারিক কৌলিন্য বিনষ্ট হয়। পুরুষোত্তম অথবা তাঁর পিতা পিঠাভোগের জমিদার জগন্নাথ কুশারী যশোহরের চেঙুটিয়ার পিরালি ব্রাহ্মণ শুকদেবের কন্যাকে বিবাহ করে পিরালী থাকভুক্ত হন।পুরুষোত্তমের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ ছিলেন দুই ভাই মহেশ্বর ও শুকদেব। এঁরা যশোহরেই বাস করতেন। পারিবারিক বিবাদের কারণে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে মহেশ্বরের পুত্র পঞ্চানন কাকা শুকদেবকে নিয়ে চলে আসেন গঙ্গাতীরে গোবিন্দপুর গ্রামে (অধুনা কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম ও ময়দান অঞ্চল)। এই পঞ্চানন কুশারীই হলেন ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসসিদ্ধ আদিপুরুষ।পঞ্চানন কুশারী ছিলেন বিষয়বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। জাতসংস্কার তাঁর মনে ছিল। কলকাতায় এসে জাহাজওয়ালাদের মাল সরবরাহের কাজ শুরু করলেন। বসতি স্থাপন করলেন জেলেদের পাড়ায়। এই পাড়ায় ইতিপূর্বে কোনো ব্রাহ্মণের আগমন হয়নি। তাই মহা আনন্দে তারা অভ্যর্থনা জানালেন পঞ্চাননকে। তাঁদের মুখে পঞ্চানন কুশারী হলেন ‘ঠাকুরমশাই’। ইংরেজরাও তাঁকে ‘ঠাকুর’ নামেই ডাকতে শুরু করল; কেবল নামটি তাদের মুখে বিকৃত হয়ে দাঁড়াল ‘টেগোর’। এরপর কুশারী পদবী উঠে গেল – তাঁরা নিজেরাও ঠাকুর পদবী ব্যবহার শুরু করলেন।
১৭০৭ সালে রালফ সেলডন কলকাতার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত হলে কোম্পানির উপর নিজ প্রভাব খাটালেন পঞ্চানন। সেলডন তাঁর দুই পুত্র জয়রাম ও সন্তোষরামকে বহাল করলেন আমিন পদে। এরপর জরিপ, জমিজমা কেনাবেচা ও গৃহনির্মাণে দালালি করে দুজনেই বেশ দুপয়সা কামালেন। ধর্মতলা অঞ্চলে নিজস্ব বসতবাটী তুললেন জয়রাম। ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ ও মারাঠা খাত (যার বর্তমান রূপ আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোড-আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড) নামক পরিখা খননের তদারকিও করেছিলেন জয়রাম।জয়রামের চার ছেলের মধ্যে নীলমণি ঠাকুর ও দর্পনারায়ণ ঠাকুর ছিলেন যথাক্রমে জোড়াসাঁকো ও পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুর পরিবারের আদিপুরুষ। ১৭৬৫ সালে কোম্পানি বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করলে, উড়িষ্যার কালেক্টর হন নীলমণি। দর্পনারায়ণ কলকাতায় বসেই নানা উপায়ে অর্থ উপার্জন করে ধনী হয়ে ওঠেন। দুই ভাই মিলে সুতানুটির পাথুরিয়াঘাটায় নির্মাণ করলেন বিরাট বসতবাটী। পরে পারিবারিক বিবাদের ফলে পাথুরিয়াঘাটার বাড়ি ও কিছু ভূসম্পত্তি দর্পনারায়ণকে দিয়ে গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনকে সঙ্গে নিয়ে পাথুরিয়াঘাটার বাস ওঠালেন নীলমণি। চিৎপুর রোডের পূর্বে মেছোবাজারে জমি কিনে তুললেন নিজের আলাদা বসতবাটী। এই মেছোবাজারই পরে পরিচিত হয় জোড়াসাঁকো নামে। আর নীলমণি ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত এই বাড়িটিই হল আজকের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি।নীলমণি ঠাকুর ছিলেন গোঁড়া বৈষ্ণব ও ধর্মভীরু মানুষ। সে সংস্কার তাঁর পুত্র রামলোচন ঠাকুরের মনে কিছুমাত্র ছিল না। মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় রাজধানী স্থানান্তরিত হলে বহু অভিজাত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি সেখানকার বাস উঠিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে আসেন তাঁর পৃষ্ঠপোষতাপুষ্ট বহু গাইয়ে, বাজিয়ে, বাইজি ও বারাঙ্গণা। এঁরা আশ্রয় নেন জোড়াসাঁকোর উপকণ্ঠে চিৎপুর পাড়ায়। এইসব গাইয়ে-নাচিয়েদের একজন সমঝদার পৃষ্ঠপোষক হয়ে ওঠেন রামলোচন।
নীলমণি ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র রামমণি ঠাকুরের দ্বিতীয় পুত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঠাকুরদাদা দ্বারকানাথ ঠাকুর। অপুত্রক রামলোচন দ্বারকানাথকে দত্তক নেন। ১৮৩৪ সালে উইলিয়াম কার নামে এক ইংরেজ অংশীদারকে নিয়ে তিনি স্থাপন করেন কার-টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি। ক্রমে দ্বারকানাথের হাত ধরে ঠাকুর পরিবারের আর্থিক সমৃদ্ধি চরমে ওঠে। দ্বারকানাথ পরিচিত প্রিন্স দ্বারকানাথ নামে। বাঙালি থেকে ইংরেজ সমাজ – সর্বত্রই ছিল তাঁর অবাধ প্রতিপত্তি। উপার্জন করতেন যেমন, দুহাতে ব্যয় ও অপব্যয়ও করতেন তেমনই। বাড়িতে নিয়মিত ভোজসভা ও নৃত্যগীতের আসর বসত। এইসব ভোজসভায় সামাজিকতার খাতিরে মদ্যমাংসও পরিবেশিত হত। দ্বারকানাথ নিজে সে সব কখনও গ্রহণ না করলেও, এই নিয়ে তাঁর গৃহে পারিবারিক অশান্তি উপস্থিত। তাঁর ধর্মপ্রাণা নিষ্ঠাবতী স্ত্রী দিগম্বরী দেবী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ-সম্পর্ক পরিত্যাগ করেন। স্ত্রীর বিশ্বাসে হস্তক্ষেপ না করে দ্বারকানাথ বাড়ির বৈঠকখানার একটি অংশে বসবাস শুরু করেন এবং বেলগাছিয়ায় একটি বাগানবাড়ি ক্রয় করে সেখানেই ভোজসভা ও নৃত্যগীতের আসর বসাতে শুরু করেন। রাজা রামমোহন রায় ছিলেন তাঁর বন্ধু। কিন্তু দ্বারকানাথ নিজে সনাতন হিন্দু সংস্কার ত্যাগ করেননি, আবার বন্ধুর ধর্মসংস্কারের বিরোধিতাও করেননি। বরং সতীদাহ নিবারণে রামমোহনকে সর্বতোভাবে সাহায্য করেছিলেন দ্বারকানাথ। রামমোহনের মৃত্যুর পর যে ব্রাহ্মসভার অবলুপ্তি ঘটেনি, তার কারণ দ্বারকানাথের অর্থসাহায্য। রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, “সুবিধার জন্য লোকাচার মানতেন, আবার সুবিধার জন্য সাহেবিয়ানাও করতেন, কিন্তু সাহেবি পোষাক পরিচ্ছদ কখনও পরেননি।”১৮৪৩ সালে দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ পিতার অসম্মতি সত্ত্বেও ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করলেন। এরপর দ্বারকানাথের মৃত্যু হলে পিতার ব্যবসার কাজকর্ম নিজে হাতে গ্রহণ করলেন দেবেন্দ্রনাথ। তাঁর ছত্রছায়ায় একেশ্বরবাদ ও নব্য চিন্তাকে পাথেয় করে সমাজের বিপরীত স্রোতে শুরু হল ঠাকুর পরিবারের নতুন এক যাত্রা। এই যাত্রার সূচনাপর্বেই জন্ম রবীন্দ্রনাথের।

ঋণস্বীকার:
১. “দ্বারকানাথ ঠাকুর: বিস্মৃত পথিকৃত”, কৃষ্ণ কৃপালনি (অনুবাদ: ক্ষিতীশ রায়), ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, নতুন দিল্লি, ১৯৮৪
২. “রবীন্দ্রজীবনকথা”, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৮৮ সং, কলকাতা
৩. “রবিজীবনী”, প্রথম খণ্ড, প্রশান্তকুমার পাল, ভূর্জপত্র, কলকাতা, ১৩৮৯

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.