১৮৫৮ থেকে ১৮৯১—প্রায় ৩৩ বছর সরকারি চাকরি করেছিলেন বঙ্কিম। দীর্ঘ ২৬ বছর অপেক্ষার পর অবসর নেওয়ার মাত্র সাত বছর আগে প্রথম শ্রেণীর ডেপুটির মর্যাদা পেয়েছিলেন তিনি। ‘চাকরি আমার জীবনের অভিশাপ’ বন্ধু শ্রীশ মজুমদারের কাছে লেখা এই চিঠিতে তাঁর হতাশা লুকিয়ে থাকেনি। দীর্ঘ কর্মজীবনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ক্যাডারের ওপরে অন্য কোনো প্রমোশনের সুযোগ পাননি তিনি, যদিও উপরিওয়ালার কাছ থেকে তাঁর কর্মদক্ষতা, সততা ও সাফল্যের প্রশংসাপূর্ণ প্রতিবেদনের ঘাটতি ছিল না। চাকরিজীবনে মাত্র দুবার তিনি কিছুটা চোখে পড়ার মতো পোস্টিং পেয়েছিলেন, প্রথমবার ১৮৬৭ সালের আমলাদের জন্য গঠিত বেতন কমিশনে নিযুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। আর চাকরিজীবনের প্রায় প্রান্তে ১৮৮১ সালে তাঁকে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের সহকারী সচিব নিয়োগ করা হয়েছিল, কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই ওই পদটি উঠিয়ে এক ঘণ্টার নোটিশে তাঁকে বদলি করা হয়। পদটি আকস্মিকভাবে উঠিয়ে দেওয়া এবং যেভাবে তাঁকে সরানো হয়, তাতে পত্রপত্রিকায় সমালোচনার ঝড় ওঠে।
বঙ্কিম জীবনীকারদের মতে, বদলি ও নিয়োগ নিয়ে তাঁকে বারবার নানা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ১৮৮২ থেকে ১৮৯২-এ অবসর নেওয়া পর্যন্ত সোয়া আট বছরে প্রায় নয়বার তাঁকে বদলি হতে হয়েছিল। ‘এত ঘন ঘন বদলি কোনো কর্মকর্তার প্রতি সরকারের সহানুভূতি বা আস্থার পরিচয় বহন করে না। মনে হয়, তিতিবিরক্ত-হতাশ বঙ্কিম তাই স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছিলেন।’ (লাডলীমোহন রায় চৌধুরী)
বঙ্কিমের চাকরিজীবনের শুরুটা ছিল উজ্জ্বল। তাঁর কর্মদক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা এবং কর্তব্যনিষ্ঠার প্রশংসা করে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন একাধিকবার। কোনো কোনো রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিনি যে রকম কর্মদক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন, তা একমাত্র ইউরোপীয় জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষেই সম্ভব। ১৮৮২-৮৩ সালের প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্টের একটা অংশে লেখা:
১৮৮১-৮৩ সালে বঙ্কিম প্রশংসাসূচক রিপোর্টের ফাঁকে ফাঁকে কিছু তির্যক মন্তব্যের সম্মুখীন হন। ১৮৮১-৮২-তে বর্ধমান বিভাগের প্রশাসনিক রিপোর্টে জেলা প্রশাসক বঙ্কিমের সাহিত্যপ্রতিভার স্বীকৃতি জানিয়েও ‘তার সারবত্তাহীন এবং অগোছালো কাজের ধারা ও বাগাড়ম্বর সম্পর্কে’ কটাক্ষ করেন।
১৮৮৩-৮৪ সালে জেলা কানেক্টর আরও কট্টর মন্তব্য লেখেন। তাঁর মতে, ‘বঙ্কিমকে যথাযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য তাঁকে সব সময়ে নজরে রাখা দরকার এবং তিনি নিশ্চিত খামখেয়ালি ধরনের মানুষ।’ তবে সবচেয়ে নির্দয় মন্তব্য চোখে পড়ে ১৮৮৫-৮৬ সালের রিপোর্টে, ‘তিনি একজন মামুলি ধরনের অফিসার (অ্যান অ্যাভারেজ অফিসার) ছাড়া আর কিছু নন এবং তাঁর অফিসের কাজে আরও আগ্রহ দেখানো উচিত।’বঙ্কিম তাঁর চাকরিজীবনে বহু মামলার বিচার করেছেন। বিচারক হিসেবে খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারেননি তিনি। তাঁর বিচারবিভ্রাটের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত সমসময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিতও হয়েছিল। তবে বিচারকার্যে তাঁর সততা সম্পর্কে কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের বিচারকার্যে এমন কিছু অদ্ভুত খুঁত লক্ষ করা গিয়েছে, যা তাঁর মতো একজন বিদগ্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে কিছুতেই আশা করা যায় না।’ গ্যারেট লিখেছেন, ‘মামলার বিচারকাজে তিনি অনেক সময় নানা রকম অস্বাভাবিক মতামত করতে অভ্যস্ত এবং তাঁর রায়গুলো কিছুটা বাগাড়ম্বরপূর্ণ (ভারবোস) (লাডলীমোহন রায় চৌধুরী)।
চাকরির ক্ষেত্রে তাঁকে হতে হয়েছে অনেক বৈষম্যের মুখোমুখি। বাংলাদেশের কৃষক ও মুচিরাম গুড়ের জীবনীতে ইংরেজের বিচারব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করেছেন। তাঁর লেখায় কোনো কোনো জায়গায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর ঘোর মতবিরোধের দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইলবার্ট বিল নিয়েও তাঁর সমালোচনা অনেক সাহেবের মধ্যে রোষের জন্ম দিয়েছিল। অনেকে মনে করেন, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি সকারের সহানুভূতিহীনতার মূল কারণ তাঁর উপন্যাস আনন্দমঠ। যদিও এই উপন্যাসের দরুন তাঁকে সরাসরিভাবে কোনো অভিযোগ সরকার করেছিল বলে জানা নেই, কিন্তু উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তাঁর চাকরির চরিত্রলিপিতে তিক্ত মন্তব্যের আবির্ভাব হতে থাকে।
১৮৮২ সালে উপন্যাস প্রকাশের সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিদ্বেষের কিছু কিছু নমুনা ছিল বলে অনেকের ধারণা। বিপদের আঁচ পেয়ে বঙ্কিম পরবর্তী সংস্করণে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটান। সরকারের সন্দেহ নিরসনের জন্য আনন্দমঠ-এর বিজ্ঞাপনে এর বিষয়বস্তুর আভাস দিয়ে জানালেন, ‘রাজনীতি নয়, ধর্মকথা বলাই লেখকের উদ্দেশ্য।’ সশস্ত্র বিপ্লব অনেক সময়ই আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী ‘ইংরেজরা বাংলাদেশকে অরাজকতা থেকে উদ্ধার করিয়াছে—এই সকল কথা এই গ্রন্থে বুঝান গেল।’ ইংরেজের ক্রোধ এড়াতে, ‘ইংরেজ’, ‘গোরা’ ‘ব্রিটিশ’ শব্দগুলো ছেঁটে দিলেন। ‘মুসলমান’ ‘নেড়ে’ ‘যবন’ প্রভৃতি শব্দ আমদানি করে বোঝাতে চাইলেন যে ‘সন্তানদের’ বিদ্রোহ ইংরেজের বিরুদ্ধে নয়। কারণ ‘ইংরেজমিত্র রাজা। তাঁদের রাজ্যে প্রজা সুখী হইবে।’ বিদ্রোহী ঝাঁসির রানিকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা তাঁর ছিল। কিন্তু আনন্দমঠ-এর প্রতি ইংরেজের মনোভাব জানতে পেরে তিনি আর এগোননি। সন্দেহ নেই, চাকরি বঙ্কিমের শিল্পীসত্তার টুঁটি চেপে ধরেছিল নিষ্ঠুরভাবে।
চাকরিজীবনের বৈষম্যের শিকার হয়ে ব্যক্তিজীবনে বঙ্কিম ছিলেন নিখাদ রাজভক্ত। ‘লর্ড রিপনের উৎসবের জমা খরচ’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন—‘রাজভক্তি বড়ো বাঞ্ছনীয়।’ ইংরেজ চরিত্রে তাঁর আস্থা কখনোই টোল খায়নি। সরকারও তাঁকে রায়বাহাদুর ও সিআইই খেতাব দিতে কার্পণ্য করেনি। তবে এই খেতাব তিনি পেয়েছিলেন ‘রাজ সরকারের চাকরি অপেক্ষা বিদ্ব্যৎমণ্ডলীতে তাঁর খ্যাতির জন্য’, (জীবন মুখোপাধ্যায়) প্রাদেশিক সরকারের একজন প্রখ্যাত কর্মকর্তা হিসেবে নয়।