কাশ্মীরের ইতিহাস অতি প্রাচীন। কাশ্মীরের কবি কলহন বিভিন্ন রাজবংশের কাহিনী তরঙ্গাহিত করেছেন। যেখানে মানুষ মিহিরকুলের মতো হুন রাজার রাজত্বে কাটিয়েছেন তাঁদের কাছে আর ভীষণ কী হতে পারে? তাই রাজতরঙ্গিনীর বহু অংশ পড়ার সময়ে পাঠকের বুক কেঁপে ওঠে। কিন্তু এত বছরের নিষ্ঠুরতাকেও যেন হার মানিয়েছে বিগত সাত দশকের সঞ্চিত পাপের কাহিনী।

৬ অগস্ট, লোকসভাতেও পাশ হয়ে গেল ৩৭০ ধারা বিলোপের বিল। নরেন্দ্র মোদীর সরকার ধুয়ে দিল এতগুলো দশকের কালির দাগ। এর মধ্যে দুটি পরিবারের স্বার্থ, লোভ আর পাপের কাহিনীও রয়েছে। যার বেশ কিছুটা অংশ স্পষ্ট নয়। আর যদিও এই পারিবারিক কেচ্ছা একটি গোটা রাজ্যের মানুষের দুর্ভোগের জন্য দায়ী ছিল, তবু এই আলোচনা থেকে এখানে বিরত থাকব। এখানে অন্য সবকটি পাপের বিষয়ে আলোকপাতের চেষ্টা করব।

ইংরেজ যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে গেল তখন ৫৬২ টি দেশীয় রাজ্যে ভারত ও পাকিস্তানের অংশ হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভারতের পক্ষ থেকে লৌহমানব সর্দার বল্লভভাই পটেল এই সংযোগের কাজ করেছিলেন। মোট চারটি রাজ্য নিয়ে সমস্যা হয়। যোধপুর, জুনাগড়, হায়দরাবাদ আর কাশ্মীর। হায়দরাবাদের নিজাম আর কাশ্মীরের রাজা হরি সিং স্বাধীন সার্বভৌম রাজত্ব চাইলেন। কিন্তু নিজামের রাজত্বে প্রচুর হিন্দুর বাস। তাই যে কাজ কাশ্মীরের জেহাদিরা ১৯৯০ সালে করেছিল, নিজাম ১৯৪৭ সালেই তা শুরু করেছিলেন, সেটা হল অকাতরে  হত্যা। এই নারকীয় ঘটনার জন্য সুন্দরলাল কমিটি তদন্তে গিয়েছিল। ১৯৪৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর হায়দরাবাদে সেনা পাঠালেন সর্দার পটেল। হায়দরাবাদ ভারতের অন্তর্ভূক্ত হল।

কাশ্মীরে এমন অঘটন যাতে না ঘটে তার জন্য সর্দার পটেল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তদানীন্তন সরসঙ্ঘচালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকারকে অনুরোধ করলেন মহারাজ হরি সিং–কে রাজি করাতে। ১৯৪৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর দিল্লি থেকে গোলওয়ালকর কাশ্মীরে পৌঁছলেন। ১৮ অক্টোবর হরি সিংহের সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়। যুবরাজ করণ সিংহের তখন পা ভেঙেছিল। প্লাস্টার করা অবস্থায় আধ শোওয়া যুবরাজও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। প্রস্তাবে রাজি হলেন রাজা হরি সিং। গোলওয়ালকর দিল্লিতে ফিরে এলেন। এর পরই শুরু হল প্রথম দফার পাপের কাহিনী।

মহারাজা ভারতের পক্ষে যাবেন– পাকিস্তানের কাছে এই খবর পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই এক জঘন্য চক্রান্ত শুরু হল। ২৩ অক্টোবর পাকিস্তানি সেনা পাস্তুন উপজাতির বর্বর বাহিনীকে কাশ্মীরে প্রবেশ করালো। এদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল লুঠ ও ধর্ষণ। লাহোরের তৎকালীন হাই কমিশনার ছিলেন বি সি ডুক। পাকিস্তানের এই নিষ্ঠুর পরিকল্পনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, “কাশ্মীর সব সময়েই দুধ আর মধুর জায়গা। ভারতবর্ষের সীমান্তের পশ্চিম দিকের সরকার ইচ্ছাকৃত ভাবে উপজাতি নেতাদের ভূস্বর্গ লোটার জন্য উস্কে ছিল। আর লোক দেখানো নির্দেশ দিয়েছিল অবদমিত মুসলমানদের রক্ষা করার।”

সর্দার পটেল এরকমই কিছু আন্দাজ করে পাঠানকোটের সীমান্তে ভারী সৈন্যবাহী গাড়ির জন্য রাস্তা বানিয়ে রেখেছিলেন। রাজা হরি সিং ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হলেন। সঙ্গে সঙ্গেই আকাশ পথে এবং পরে স্থল পথে সৈন্য এলো। ভারতীয় সেনারা দুষ্কৃতীদের তাড়া করে ভাগিয়ে দিল।

এর পর একটার পর একটা অভিযানে ভারতের জয় হতে থাকল। অপারেশন বিজয়, অপারেশন ইরেজ, অপারেশন ভীষণ বা অপারেশন ইজি,– একটানা জয় পেয়েছিল ভারতীয় সেনারা। কিন্তু সর্বাত্মক জয়ের মুখে অন্য সিদ্ধান্ত নিলেন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ১৯৪৮ সালে ১৩ অগস্ট তিনিই বিষয়টি রাষ্ট্রসঙ্ঘে নিয়ে গেলেন। আজাদ কাশ্মীরকে পাকিস্তানকে দিয়ে ৫ জানুয়ারি ১৯৪৯ সালে শান্তি চুক্তি হল। এই মহা পাপের ভোগান্তি স্বাধীনতার পর থেকে কাশ্মীর সহ সমগ্র দেশ ভোগ করছে।

সংবিধানের ৩৭০ ধারা সংযোজন ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। যে কোনও বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ বুঝবেন যে হায়দরাবাদ যদি সম্পূর্ণ রূপে ভারতবর্ষে বিলুপ্ত হতে পারে তবে এত রক্তক্ষয়ের পরে পাওয়া কাশ্মীর কেন অন্য দেশি রাজ্যের মতো ভারতভুক্ত হবে না? কেন প্রয়োজন বিশেষ অধিকারের? কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে নেহরু নাছোড়বান্দা ছিলেন।

শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীর উপত্যকার একজন অত্যন্ত ছোটখাটো নেতা ছিলেন। হিন্দু সমাজ তো নয়ই মুসলমান সমাজেরও তাঁর উপরে বিশেষ আস্থা ছিল না। কিন্তু তিনিই পণ্ডিতজির পছন্দের মানুষ। বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকর এই অনাচারের ঘোর বিরোধী ছিলেন। এমন একটা অদ্ভুত বিল সংসদে আনা হচ্ছে সেটা সর্দার পটেলও জানতেন না। নেহরুজি আবদুল্লাহকে গোপালস্বামী আয়ঙ্গারের কাছে পাঠিয়েছিলেন। গোপালস্বামী আয়ঙ্গার নেহরুজিকে খুশি করতে ১৭ অক্টোবর ১৯৪৯ তারিখে সংসদে পাশ করানো এবং রাষ্ট্রপতির আদেশে ৩৭০ ধারাকে যুক্ত করার সব কাজ করেছিলেন।

এই অন্যায়ের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। তাঁর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহ আর পণ্ডিত নেহরু যে পাপ করেছেন তা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে বিরলতম ঘটনা। শ্যামাপ্রসাদ ডাক দিয়েছিলেন, এক দেশে দুই আইন, দু’জন প্রধানমন্ত্রী আর দু’রকম জাতীয় পতাকা তিনি মানবেন না। ১৯৫৩ সালের ৯ মে তিনি আম্বালাতে সে কথা স্পষ্ট করে জানালেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু আর জম্মু কাশ্মীরের তথাকথিত প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ সাহেবকে তাঁর আন্দোলনের কথা জানালেন। তিনি বললেন, পারমিট ছাড়াই কাশ্মীরে ঢুকবেন। কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করার পরে শেখ আবদুল্লাহ শ্যামাপ্রসাদকে এক নরকের জীবন দিয়েছিলেন। মূল শহর থেকে দশ-বারো কিলোমিটার দূরে অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হল দেশের এত বড় নেতাকে। সেই স্যাঁতস্যাঁতে ঠাণ্ডা ঘরে পর্যাপ্ত পোশাক, উপযুক্ত খাবার, প্রয়োজনীয় ওষুধ কোনওটাই দেওয়া হয়নি তাঁকে।

যখন ভারত কেশরী শ্যামাপ্রসাদ এত কষ্ট পাচ্ছেন সেই সময়ে ২৩ মে ১৯৫৩ তারিখে কাশ্মীরে গিয়েছিলেন পণ্ডিত নেহরু। ২৪ মে নেহরুজি, বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিত আর শেখ আবদুল্লাহ ডাল লেকে মজায় দিন কাটালেন। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরে তখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন ভারতবর্ষের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে একজন। যিনি নিজের দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য গজদন্ত মিনারের সুখ ছেড়ে সুদূর কাশ্মীরে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ  কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল করার কথা ঘোষণা করেছেন। সারা দেশে এক তৃপ্তির অনুভূতি। সর্বস্তরের মানুষ স্বাগত জানিয়েছেন সরকারের এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপকে। রাজনৈতিক স্বার্থ ভুলে দেশের স্বার্থে সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে বহু বিরোধী দল। অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি এবং তেলগু দেশম পার্টি একযোগে সরকারের কাশ্মীর নীতিকে সমর্থন করেছে। ওড়িশার বিজু জনতা দল, উত্তরপ্রদেশের বহুজন সমাজ পার্টি, তামিলনাড়ুর এআইএডিএমকে সহ বহুদলই কেন্দ্রীয় সরকারের পাশে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল তো টুইট করে সমর্থন জানিয়ে সবাইকে অবাক করেছেন।–“কাশ্মীরের বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে আমরা সমর্থন করি। আশাকরি এ বার রাজ্যে শান্তি ফিরবে, উন্নয়ন হবে।”

সংবিধানের ৩৭০ ধারা রক্ষা করার জন্য ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের দেওয়া করের অনেকটাই জম্মু কাশ্মীরের জন্য ব্যয় করতে হত। ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের একটি হিসাবে দেখা গিয়েছে যে ভারতবর্ষের মাত্র ১ শতাংশ মানুষ যে জম্মু কাশ্মীরে থাকেন সেই রাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যয় ১০ শতাংশ। কিন্তু এত কিছুর পরেও ভারতের কোনও প্রান্তের নাগরিক জম্মু কাশ্মীরে জমি বা স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারবেন না। কারণ সংবিধানের ৩৫এ ধারা। এই ধারা কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া অন্য কারও ওই রাজ্যে স্থাবর সম্পত্তি কেনার অন্তরায়।

ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বুঝেছিলেন এই ধারা সমগ্র দেশের জন্য কত বড় বিপদ হতে যাচ্ছে। এক দেশে দুই বিধান, দুই প্রধান আর দুই নিশানের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। যখন দিল্লিতে অনেক বড় বড় নেতা সদ্য পাওয়ার ক্ষমতার চিটে গুড়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন তখন ওই মানুষটি সব ছেড়ে দেশের অখণ্ডতার জন্য কাশ্মীরে গেলেন।

১৯৫৩ সালের ২৩ জুন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যু হল। যাতে কেউ না জানতে পারে তাই কলকাতা বিমানবন্দরে মাঝরাতে তাঁর মরদেহ আনা হল। কিন্তু সেই মধ্যরাতেও বিমানবন্দরে উপচে পড়া মানুষের ঢল। পরের দিন অন্ত্যেষ্টির সময় কলকাতার মানুষের রোষ দেখে নেহরুজি প্রমাদ গুণেছিলেন। কিন্তু বাঁচিয়ে দিলেন বামেরা। একমাত্র অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা ছাড়া কেউ বাংলা থেকে সংসদে জানতে চাইল না এই মহাপ্রাণ মানুষটি ঠিক কী ভাবে মারা গেলেন। কেন কাশ্মীরে গিয়ে তদন্ত হবে না। কলকাতার বাম নেতারা তখন অন্য কিছুতে ব্যস্ত। ২৭ জুন সিপিআই পার্টির জ্যোতি বসু, এসইউসি পার্টির সুবোধ ব্যানার্জি, প্রজা সোশালিস্ট পার্টির সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায় আর মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লকের সত্যপ্রিয় ব্যানার্জিকে নিয়ে প্রতিরোধ কমিটি তৈরি হল। এই কমিটি ১ পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির জন্য প্রতিরোধ করবে। প্রতিরোধে ১১টি ট্রাম পুড়ে গেল। ২ জুলাই বাংলা বনধ ডাকা হল।

শ্যামাপ্রসাদকে বাংলার জনমানস থেকে মুছে দেওয়ার সব প্রয়াস করা হয়েছে। যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বকনিষ্ঠ উপাচার্য ছিলেন, যিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে পরাধীন ভারতের প্রথম বাংলাতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে দীক্ষান্ত ভাষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন, দেশের একটির পর একটি বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র যাঁর সহৃদয় পৃষ্ঠপোষকতায় জন্ম নিয়েছে বা বিকশিত হয়েছে, যাঁর অক্লান্ত প্রয়াসে কলকাতা সহ পশ্চিমবঙ্গ আজ পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতের সঙ্গে রয়েছে ,- সেই মহামানবের বিষয়ে ক্লাস ওয়ান থেকে স্নাতকস্তর পর্যন্ত কোথাও একটি লাইনও পড়ানো হয় না। কাশ্মীরের জন্য তাঁর বলিদানের কথা জানাবার কোনও ব্যবস্থাই করা হয়নি। কিন্তু এতকিছুর পরও বাংলার এই মহা বিপ্লবী জিতে গেলেন। ২০১৯ সালের ৫ অগস্ট ভারতের সরকার এই বাঙালি নেতার আত্মত্যাগের যোগ্য সম্মান দিল।

হাজার বছরের বেশি সময় ধরে যে কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ, ভারতের সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত তা ভারতের অন্য সব রাজ্যের মতই সমান সম্মান পাবে।

আজ যখন সারা দেশ তাঁকে এই সম্মান দিচ্ছে তখন বাংলায় উপেক্ষিত এই নায়কের উদ্দেশে রাজ্যবাসীর বলা উচিত, ‘ক্ষমা করো শ্যামাপ্রসাদ।’

মতামত সম্পূর্ণত লেখকের নিজস্ব

লেখকসাহা ইনস্টিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স এ কর্মরত। বাংলায় প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাস লেখেন।

জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.