জার্মানির ইহুদী ও পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের রাজনৈতিক জীবনের এতখানি মিল আছে দেখে অদ্ভূত লাগল! এগুলো বুঝতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস খানিকটা জানা জরুরী। প্রখম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি অপমানকর পরাজয় এবং মিত্রপক্ষের কাছে ‘ভারসাই’ চুক্তি করতে বাধ্য হয়। এই চুক্তিতে লেখা ছিলো, জার্মানি তার উপনিবেশগুলি মিত্র পক্ষের কাছে ফিরিয়ে দিবে। সে লক্ষ্যে ফ্রান্সকে তার জায়গা ফিরিয়ে দিতে হয়। জার্মানি থেকে অস্ট্রিয়াকে আলাদা করা হয়। পাপুয়া নিউগিনি পড়ল অস্ট্রিলিয়ার হাতে। প্রুশিয়ান এলাকাগুলো ফিরিয়ে দিতে হলো পোল্যান্ডকে। এছাড়া বেলজিয়াম, ইংলেন্ড নেদারল্যান্ডও তাদের জায়গা ফেরত পেলো। ভারসাই চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি তার সেনা বাহিনী বর্ধিত করতে পারবে না। যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ তাকে দিতে হবে ১৩২ বিলিয়ন জার্মান মার্ক। এটার প্রথম কিস্তি দিতে গিয়েই জার্মানি দেওলিয়া হয়ে পড়ে। ফলত জার্মানিতে দুর্বিক্ষ নেমে আসে। রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। এমনিতে রাজা কাইজার প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিবেচিত হয় মিত্রপক্ষের কাছে।… এইরকম সময়ে জার্মানির ইহুীদের প্রতি সাধারণ জার্মানিদের একটা বিরূপ মনোভাব জেগে উঠে। এমনিতেও ধর্মীয়ভাবে খিস্টানদের ইহুদী বৈরী মনোভাব ছিলোই। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিরোধী ছিলো ইহুদীরা। তারা যুদ্ধ চায়নি। তারা জার্মান সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে ছিলো না। আমেরিকারর প্রতি ইহুদী অনুরাগের সন্দেহ করত জার্মানরা। যুদ্ধে আমেরিকা যোগ দিলে ইহুদীরা খুশি হয়েছিলো বলে জার্মানরা ধারণা করে। যুদ্ধ শেষে ভঙ্গুর অর্থনীতিতে ইহুদীদের হাতে সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য দেখে জার্মানিরা আরো বেশি করে ইহুদী বিরোধী হতে থাকে। এই সময়ে রাজতন্ত্রের পতনে জার্মানিতে গণতন্ত্র চালু হলে সমাজতান্ত্রিক হিটলার নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় চলে আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয়ের ১৫ বছরের মাথায়। হিটলার মনে করতেন জার্মানির লজ্জাকর পরজয়ের জন্য ইহুদীদের হাত ছিলো। জার্মানিতে ইহুদীদের কোন ঠাই হবে না। জার্মান আর্য বিশুদ্ধ রক্ত ও জাতিচেতনা কখনোই প্রতিষ্ঠা পাবে না যদি না ইহুদীদের নিশ্চিহ্ন না করা যায়। হিটলার শুরুতে তার দেশে ইহুদীদের হত্যাযজ্ঞ শুরু করে ক্রামান্বয়ে অস্ট্রিয়া, পোলেন্ড, বেলজিয়াম…। সোভিয়েত রাশিয়া আক্রমন করে হিটলার ৫ লাখ সোভিয়েত ইহুদীকে হত্যা করে। হিটলারের এই নির্মম ইহুদী প্রতিশোধ জার্মান ইহুদীদের কথিত বিশ্বাসঘাতকতার কারণ হলে ভিন্ন দেশীয় ইহুদীদের উপর কেন আক্রমণ করতে যাবে?
বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীদের ধরে এনে পোল্যান্ডে জরো করা হয়। ১৯৪৫ সালেই কনসান্ট্রেশন ক্যাম্পে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ইহুদী মারা যায়। ইহুদী সম্প্রদায় গোটা ইউরোপ জুড়ে মৃত প্রায় ও অস্তিত্বহীন একটি সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের বাস্তবতার আয়নায় দেখতে পায়। ফলত নিজেদের একটি রাষ্ট্র ও নিজেদের আত্মপরিচয়কে বিলিন না করতে ধর্মীয় একটি মিথকে পুঁজি করে ‘ইজরাইল’ রাষ্ট্র চিন্তা ইহুদীদের মনে বাসা বাধে। তাই বিধস্থ একটি সম্প্রদায় ১৯৪৮ সালে তাদের ধর্মীয় তীর্থস্থানে ‘ইজরাইল’ নামের একটি রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।
পৃথিবীতে এগিয়ে থাকাও একটি বড় ধরণের অযোগ্যতা যখন চারপাশে অযোগ্যরা সংখ্যায় বেশি হবে। অযোগ্যরা সংখ্যায় কম হলে যোগ্যদের থেকে সুরক্ষা দাবী করবে। কিন্তু সংখ্যালঘুরা বেশিমাত্রায় যোগ্য হলে সংখ্যাগুরু অযোগ্যদের চোখ টাটাবে। জার্মানিতে ৫ লাখ ইহুদী প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির মোট জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশ ছিলো। তাদের হাতেই ব্যবসা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য চলে গেছে দেখে হিটলারের মন অবিকল পাকিস্তানের ‘মুসলিম জাতি’ রক্ষায় নিয়াজীদের মত প্রতিশোধ প্ররায়ণ হয়ে উঠেছিলো। জার্মানিতে ‘ইহদী গণহত্যা’ নিয়ে কখনোই গোপন করার চেষ্টা হয় না। ইহুদী নিধন কেউ অস্বীকার করলে বরং জেলে যেতে হবে। বাংলাদেশে ঠিক উল্টো। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্রে, পাকিস্তানীদের সমরনীতির দলিলপত্রে, জেনারেলদের আত্মজীবনীতে আলাদা করে ‘হিন্দু গণহত্যা’ পরিস্কার করে থাকলেও আশ্চর্যজনকভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজনই এখন এই স্বীকৃতির বিরোধীতা করতে এগিয়ে আসছে! বলছে এটা নাকি মুক্তিযুদ্ধকে হিন্দু মুসলমান ভাবে বিভক্ত করা হবে! কি যুক্তি দেখুন! পাকিস্তানীরা যে হিন্দু মুসলমানভাবে বিভক্ত করেছিলো তাহলে নতুন প্রজন্ম ইতিহাস পড়ে কি করে সেটা জানবে? পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকে থাকবে না যদি হিন্দুদের এদেশ থেকে বের করে দেয়া না যায়, তারা হিন্দুয়ানী বাঙালী সংস্কৃতি দিয়ে বাঙালী মুসলমানদের একটি অভিন্ন বাঙালী জাতি চেতনায় আবদ্ধ করবে যেটা ‘মুসলমান’ জাতি চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী। তাই ৬৪-৬৫ সালে হিন্দুদের মধ্যে শেষ ব্যবসা, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও শিক্ষায় ৯৯ ভাগ ধরে রাখা হিন্দুদের টার্গেট করে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়। জার্মানিতে ইহুদীরা যেমন অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি, সাহিত্য, সামাজিক অবস্থানে এগিয়ে ছিলো, ঠিক পূর্ব বাংলায় হিন্দুদের ছিল সেই পরিস্থিতি। হিন্দু ব্রাহ্মণ শ্রেণীর হাতে এই ক্ষমতায়ন কেড়ে নিতেই পাকিস্তানের জন্ম হয়। তবু পাকিস্তান আমলে একটি স্কুলের শিক্ষকদের প্রতি দশ জনের মাত্র একজন মুসলমান শিক্ষক দেখা যেত। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৮৫ ভাগই হত হিন্দু। সংস্কৃতি সাহিত্য অঙ্গনের তখনো মুসলমানদের অবস্থান ছিলো দুর্বল। উদিচি, ছায়ানট যাদের মাথা থেকে বের হলো, এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন ষাটের দশকে পাকিস্তান যে ধর্মীয় চেতনা ও জাতি বিশ্বাসের ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে তাকে দুর্বল করে দিবে এরকম ভয় ছিলো পাকিস্তানের চিন্তানায়কদের। এই সংস্কৃতি সংগঠনগুলো গড়ে তুলেছিলো হিন্দুরা। হিটলারের মত আইউয়ুব খান বুঝলেন বাঙালী মুসলমান থেকে হিন্দুদের দূরে রাখতে হবে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু দ্বিতীয় দফায় তাদের সম্পদ ফেলে ভারতে স্থায়ী হতে বাধ্য হলো। ঠিক ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় এসে জার্মানিতে ইহুদী ধরপাকড় শুরু করলে ইহুদীরা জার্মানি থেকে পোলেন্ড অস্ট্রিয়া পালিয়ে গিয়েছিলো। তাদের সম্পত্তিগুলো তখন হিটলার জার্মানিদের মালিকানা দিয়ে দেয়। পূর্ব পাকিস্তানেরও হিন্দুদের সম্পত্তি ‘এনিমি প্রোপার্টি’ হিসেবে মুসলমানদের মধ্যে লিজ দিয়ে দেয়া হয়।
৪৭ সালে তীব্র ট্রমার মধ্যে যে দেশভাগ হিন্দু সম্প্রদায়ের শুরু সেটা মোটা দাগে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে সম্পূর্ণতা পায়। ৪৭ সালের দাঙ্গা ঘটেছিলো ভারতের্ষর বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু মুসলমানের মধ্যে। কিন্তু পূর্ববঙ্গে একটিও দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি। নোয়াখালীতে যেটা ঘটেছিলো তা শুধুই হিন্দু গণহত্যা। এরকম গণহত্যাকে ‘দাঙ্গা’ বলাটা মানে আপনি নাজি বাহিনীর হাতে ইহুদী নিধনকে অস্বীকার করছেন। যদি বলেন জার্মানিতে হিটলার ইহুদীদের উপর দাঙ্গা বাধিয়ে ছিলো তাহলে মনে করা হবে জার্মান ও ইহুদীরা দুপক্ষ রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছিলো। তদ্রুপ যদি আপনি মোটা দাগে বলেন পশ্চিম পাকিস্তানীরা ১৯৭১ সালে ‘বাঙালী গণহত্যা’ করছে তাহলে আপনি দুটি সত্যকে অস্বীকার করছেন। একটি সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু জেনোসাইড, দ্বিতীয়ত আদিবাসী পরিচয়ে আমাদের দেশ পাহাড় ও সমতলের যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, পাকিস্তানীদের হাতে হত হয়েছিলেন তাদের কথাও অস্বীকার করলেন। হিটলার কি শুধু ইহুদীদের মেরেছিলো? ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় এসে যখন সে নিজেকে সর্বসেরা ঘোষণা করল তখন জার্মানির ভিন্নমতালম্বীদের সে প্রথম কনসান্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে। মিত্র পক্ষের দেশগুলিতে গিয়ে হিটলার কি বেছে বেছে ইহুদী মেরেছিলো শুধু? তাই মুক্তিযুদ্ধে ‘বাঙালী জাতিকে নিশ্চিহ্ন’ করে দেয়ার ঐতিহাসিক স্বীকৃতির মত অবশ্যই ‘হিন্দু গণহত্যা’ স্বীকৃতি দরকার ইতিহাসের দায় স্বীকার করতেই।
এই লেখা পড়ে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের’ অনেকেই মনে হতে পারে ইহুদীদের মতই বুঝি তাদের একটি ‘ইজরাইল’ রাষ্ট্র গঠন করা উচিত ছিলো। ইজরাইল রাষ্ট্র গঠন করাকে রবীন্দ্রনাথ ভুল বলেছিলেন এবং ইহুদীদের বিভিন্ন্ জাতির মধ্যে মিশে যাওয়াকে তাদের জন্য মঙ্গল বলেছিলেন। দেশত্যাগী হিন্দুরা ভারতে গিয়ে কট্টর হিন্দুত্ববাদী না হলে ভারতের সেক্যুলার কন্ঠস্বর হয়েছিলেন এবং আছেন। অপর পক্ষে ইহুদীরা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ইজরাইল রাষ্ট্র গঠন করে। ইজরাইল গঠন করে ইহুদীদের বিন্দু পরিমাণ লাভ হয়নি। পৃথিবীর মেধার ৯৫ ভাগ যে সম্প্রদায়ের তাদের প্রতি শ্রদ্ধা এমনিতেই আসবে। আমি জানি বহু শতাব্দী ধরে ইহুদী পরিচয়ে তাদের অত্যাচারিত হওয়া দেখে তারা আর বিশ্বাস করতে পারছিলো না তাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের পরিণতি কি হবে। বাংলাদেশের হিন্দুরা যেমন কয়েক প্রজন্মের পরিণতি দেখে এদেশে সম্পদ করতে ভীত হয় সেরকম চিন্তা থেকেই ইজরাইল রাষ্ট্রে জন্ম। আমি এখনো মনে করি রবীন্ত্রনাথ ঠিক ছিলেন। সম্প্রদায়গত বিবেচনায় নির্যাতিত হলেও সম্প্রদায়গতভাবে জাতি পরিচয় সত্যি হয়ে উঠে না। হিন্দু যেমন কোন জাতি নয়, তেমনি ইহুদীও কোন জাতি নয়। খিস্টান, বৌদ্ধ মুসলমান এগুলি কোনটাই জাতি নয়- স্রেফ ধর্মীয় সম্প্রদায়গত পরিচয়।