বর্তমান প্রজন্ম যদি তারা স্বামী বিবেকানন্দের লেখাগুলি এবং বক্তৃতা গুলি অনুসরণ করে‚ তবে এটি দারুণ ফল দেবে : জওহরলাল নেহেরু

জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বামী বিবেকানন্দের মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে!এই প্রসঙ্গে তাদের এবং আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে নেহেরুর চিন্তাভাবনা জানা উচিৎ।

১৯৮৯ সালের ২০ শে মার্চ, নয়াদিল্লির রামকৃষ্ণ মিশনে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের ১১৪ তম জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ‚ তার কিছু অংশ এখানে তুলে দেওয়া হলো।

আমি জানিনা এই নতুন প্রজন্মের কতজন স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা এবং লেখমালা পড়ে।

কিন্তু আমি তোমাদের বলতে পারি যে আমার প্রজন্মের অনেকেই তাঁর দ্বারা খুব বেশী করে প্রভাবিত হয়েছিল এবং আমি মনে করি যে এটি বর্তমান প্রজন্মের পক্ষে অত্যন্ত মঙ্গলজনক হবে যদি তারা স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ও বক্তৃতাগুলি নিয়ে পড়াশোনা করে। তারা এগুলোর থেকে অনেক কিছু শিখবে।

সম্ভবত, আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সেই আগুনের একটি ফুলকি পেতে সক্ষম হয়েছিল ‚যা স্বামী বিবেকানন্দের মন এবং হৃদয়ে ছড়িয়ে ছিল এবং যা তাকে শেষ পর্যন্ত অতি অল্প বয়সে গ্রাস করে । কারণ তার অন্তরে আগুন ছিল – একটি দুর্দান্ত ব্যক্তিত্বের আগুন যা অলঙ্কারপূর্ণ এবং মনোহর ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল – এটি কোনও ফাঁকা বুলি ছিলোনা। তিনি যা বলতেন তা তিনি নিজে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।

সুতরাং একজন মহান বক্তা হিসাবে তিনি শুধু বক্তৃতার ফুলঝুড়ি ছোটাতেন না ‚ বরং দৃঢ় প্রত্যয় এবং আন্তরিকতার সাথে চেতনায় ধারণ করতেন। ফলে তিনি শক্তিশালীভাবে ভারতে অনেকের মনকে প্রভাবিত করেছিলেন এবং দুই থেকে তিনটি প্রজন্মের যুবক-যুবতীরা নিঃসন্দেহে তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

এদেশে আর একজন খুব বড় মানুষ এসেছিলেন – গান্ধীজি, যিনি পুরো ভারতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন – ভারতের মুনি ঋষিদের বহু পুরনো ধারাবাহিকয় একজন আরেকজন মহামানব। এর মধ্যর অনেক কিছু ঘটে গেছে ‚ যা সম্ভবত তাদের কিছুজনকে ভুলিয়ে দিয়েছে যারা পূর্বে এসেছিল এবং যারা সেই প্রথম দিকের কঠিন দিনগুলিতে ভারতকে প্রস্তুত ও রূপদান করেছিল। আপনি যদি স্বামী বিবেকানন্দের লেখা এবং বক্তৃতাগুলি পড়েন তবে আপনি যে অদ্ভুত বিষয়টি খুঁজে পাবেন তা হ’ল সেগুলোকে কখনোই পুরনো মনে হবেনা।

এটি আজ থেকে ৫৬ বছর আগে বলা হয়েছিল, এবং সেগুলি আজও তরতাজা কারণ তিনি যা লিখেছিলেন বা যা বলেছিলেন ত আমাদের বা বিশ্বের সমস্যাগুলির মৌলিক বিষয় এবং দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন। তাই সেগুলো কখনোই পুরনো হবেনা। এমনকি আপনি এখন এগুলি পড়লেও তা তরতাজা লাগবে।

তিনি আমাদের এমন কিছু দিয়েছেন যা ঠিকভাবে বললে হয় আমাদের উত্তরাধিকারের জন্য গর্ববিশেষ। তিনি আমাদের ছাড় দেয়নি। তিনি আমাদের দুর্বলতা এবং আমাদের ব্যর্থতা সম্পর্কে কথা বলেছেন। তিনি কিছুই আড়াল করতে চাননি । আসলে তার তা উচিতও নয়। কারণ আমাদের সেই ব্যর্থতাগুলি সংশোধন করতে হবে।

তিনি এই ব্যর্থতাগুলি নিয়েও কথা বলেছেন। কখনও কখনও তিনি আমাদের উপর কঠোর আঘাত করেন, তবে কখনও কখনও যে অসাধারণ জিনিসগুলির জন্য ভারত দাঁড়িয়েছিলো এবং যা ভারতের পতনের সময়েও কিছুটা হলেও তাকে মহান বানিয়ে চলেছে তাও দেখিয়ে দেন।

সুতরাং স্বামীজি যা লিখেছেন এবং বলেছেন তা আমাদের আগ্রহের বিষয় এবং তা আমাদের অবশ্যই আগ্রহী করে তোলে এবং সম্ভবত আমাদের দীর্ঘকাল প্রভাবিত করতে পারে।

তিনি সাধারণ অর্থে কোনও রাজনীতিবিদ ছিলেন না এবং তবুও আমি মনে করি, তিনি ছিলেন একজন অন্যতম মহান প্রতিষ্ঠাতা – যদি আপনি চান তবে আপনি অন্য যেকোন শব্দ ব্যবহার করতেই পারেন – ভারতের জাতীয় আন্দোলন এবং প্রচুর মানুষ যারা এই আন্দোলনে কমবেশি সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন তারা স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তিনি আজকের ভারতকে প্রভাবিত করেছেন। এবং আমি মনে করি যে আমাদের তরুণ প্রজন্ম স্বামী বিবেকানন্দের থেকে প্রবাহিত জ্ঞান ‚ আত্মা এবং অগ্নির ঝর্ণাটি গ্রহণ করবে।

এখন আমি যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে ফিরে আসি। শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস ‚ স্বামী বিবেকানন্দ এবং মহাত্মা গান্ধীর মতো পুরুষরা মহান ঐক্যবদ্ধ শক্তি, তারা যে বিশেষ শিক্ষা দিয়েছিল তা কেবল বিশ্বের মহান গঠনমূলক প্রতিভা নয়, বিশ্বজগত সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং সচেতন ও অচেতন প্রভাব এটি আমাদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আপনি মহাত্মাজীর অর্থনৈতিক বা অন্যান্য কিছু বিশেষ পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন না আবার নাও করতে পারেন ‚ তবে তাঁর জীবন সম্পর্কে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি, ভারতের বিভিন্ন সমস্যার ক্ষেত্রে তাঁর গঠনমূলক একত্রীকরণ পদ্ধতির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ

যদি আপনি তা মেনে না নেন, তবে আপনি সত্যই ধ্বংস এবং বিঘ্নের পক্ষে। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি – তিনি যে বিশেষ পরামর্শ দিয়েছিলেন তা থেকে আলাদা – তাঁর পদ্ধতির মূলত ছিল ভারতবর্ষ, ভারতীয় মন এবং ভারতীয় প্রতিভা সম্পর্কে। ”(উচ্চস্বরে আনন্দধ্বনি )

যদিও শ্রী রামকৃষ্ণ ঈশ্বর এবং ধর্মের একজন মানুষ ছিলেন এবং রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই বলেননি ‚ তবে এটিই তাঁর মৌলিক প্রচেষ্টা বলে গণ্য হয় । এবং, আমি রাজনীতির একজন মানুষ, আধ্যাত্মিক এবং এই জাতীয় অন্যান্য বিষয়ে খুব বেশি কথা বলছি না, তবুও, আমি মনে করি যে আমাদের জনসাধারণের বিষয়গুলি এবং সাধারণভাবে আমাদের জীবন,গুনগত মানের দিক থেকে আরও দরিদ্র হয়ে উঠবে, যদি আধ্যাত্মিক উপাদান এবং নৈতিক মানের অভাব ঘটে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশ হিসাবে ভারত এই কঠিন সমস্যা ও প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছে এবং ব্যক্তি, সম্প্রদায়, গোষ্ঠী বা জাতি হিসাবে আমাদের সকলকেই অত্যন্ত গুরুতর পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে।

যেহেতু আমার ভারতবর্ষের উপর বিশ্বাস আছে, আমি বিশ্বাস করি যে ভারত শুধু এই সব পরীক্ষাতে টিকবে না তাইনা , ভাল ফলও করবে: কারণ, আমার ধারণা, আমাদের দুর্বলতা সত্ত্বেও মৌলিক জীবনীশক্তি রয়েছে যা শত সহস্রাব্দ বছর ধরে একে চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে এবং এটি এখন আরও বেশি কার্যকর ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছে। আমার সেই বিশ্বাস আছে; কিন্তু বিশ্বাস যথেষ্ট নয়। আমাদের এটির জন্য কাজ করতে হবে, এবং আমাদের শুধু কাজ করলেই হবে না, বরং আমাদের সামনে সুস্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে কাজ করা উচিত। সেই দৃষ্টিভঙ্গি আমরা ভারতে প্রয়োগ করতে পারি, তবে এটি মূলত বিশ্বে প্রয়োগ করার জন্য আরও বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি নয়ে মূলত বিশ্বের উপর প্রয়োগ করা উচিৎ।

এটি কোনো সংকীর্ণ দৃষ্টি নয়। আমাদের জাতীয়তাবাদ অবশ্যই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ নয়। স্বামী বিবেকানন্দ একজন মহান জাতীয়তাবাদী হলেও তিনি কখনোই তেমন প্রচার করেন নি। তাঁর একধরনের জাতীয়তাবাদ ছিল যা স্বয়ংক্রিয়ভাবে
আন্তর্জাতিকতার অংশ ভারতীয় জাতীয়তাবাদে প্রবেশ করে যায়।

সুতরাং, এই বিস্তৃত পদ্ধতিটি হ’ল যে আমাদের অবশ্যই সেই মহান ব্যক্তিদের কাছ থেকে শিখতে হবে এবং যদি আমরা তা শিখি এবং আমাদের যথাসাধ্য দক্ষতার সাথে কাজ করি, তবেই আমরা তাদের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে পারবো এবং আমরা কিছুটা সুবিধা নিয়েই আমাদের দেশের এবং সম্ভবতঃ অবশ্যই মানবতার সেবা করবো। জয় হিন্দ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.