ওঁ শ্বেতচম্পকবর্ণাভাং রত্নভূষণ ভূষিতাম্, বহ্নিশুদ্ধাং শুকাসনাং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্। মহাজ্ঞানযুতাঞ্চৈব প্রবরাং জ্ঞানিনাং সত্যম্।
শ্রাবণ সংক্রান্তি , ঘনঘোর বর্ষায় খাল, আল, মাঠ, জঙ্গলে ভারী তো তেনাদের উপদ্রব, দেবী রক্ষায় প্রাণটুকু বেঁচে যাক… সেই আশা নিয়ে পূজিতা হন দেবী মনসা। তিনি শিব দুহিতা,তিনি বাসুকী ভগিনী, তিনি জরৎকারু পত্নী, তিনি আস্তিক মাতা , তিনি মানব ও নাগ উভয়ের রক্ষাকর্ত্রী , তিনি মনসা। তাঁর পুত্র আস্তিক সর্পসত্র যজ্ঞের রোধকারী , তাঁর পূজা প্রচারের তরে একদিন চম্পকনগরী হতে বেহুলা মৃত স্বামীকে নিয়ে ভেলায় চড়ে স্বর্গে গিয়ে ছিন্ন খঞ্জনার মতো নেচে ছিলেন। আচ্ছা এই মনসা কে ? তিনি কি শুধুই বিষহরিণী , আর?
ওঁ অযোনিসম্ভবে মাতর্মহেশ্বরসুতে শুভে ।
পদ্মালয়ে নমস্তুভ্যং রক্ষ মাং বৃজিনার্ণবাত্ ।
আস্তিকস্য মুনের্মাতা ভগিনী বাসুকেস্তথা ।
জরত্কারুমুনেঃ পত্নী মনসাদেবী নমোহস্তু তে ॥
আমি বহু লেখকের লেখায় পড়েছি তিনি কুলীন দেবী নন। সামান্য জনগোষ্ঠী দ্বারা পূজিতা মিশ্র প্রকৃতির দেবী ? জনগোষ্ঠী তাঁর উপর একাধিক ধর্মগুণ আরোপ করেছিলেন। অথচ তাঁর উল্লেখ মহাভারতে আছে, দেবীভাগবতে আছে। তাহলে? আপনারা যাঁরা সব কিছুতে বৌদ্ধ যোগ খোঁজেন তাঁরা কি বলবেন?
তাহলে বলি আজ সে কথা! মনসা যিনি মানসে অবস্থান করেন। মনসা যাঁর সঙ্গে দেবী চণ্ডী ও সরস্বতীর সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। আবার দেবী মনসার ধ্যানমন্ত্রটি লক্ষ্য করুন –
ওঁ দেবীমম্বামহীনাং শশধরবদনাং চারুকান্তিং বদন্যাম্ ।
হংসারূঢ়মুদারামস সুললিতবসনাং সর্বদাং সর্বদৈব ।।
স্মেরাস্যাং মণ্ডিতাঙ্গীং কনকমণিগণৈর্মুক্ তয়া চ ।
প্রবালৈর্বন্দেহ হং সাষ্টনাগামুরুকু চগলাং ভোগিনীং কামরূপাম্ ।।
মন্ত্রে দেবী হংসারূঢ়া। নলিনীকান্ত ভট্টাশালী ভারতীয় জাদুঘরে রক্ষিত একটি সরস্বতী মূর্তির সঙ্গে মনসার গভীর সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন। সেখানে দেবী সরস্বতী সপ্ত সর্প মুকুটে সজ্জিতা। তিনি চতুর্ভুজা। তাঁর বাম দুই হস্তে বেদ এবং অমৃত কলস। ডান দুই হস্তে যথাক্রমে অক্ষসূত্র এবং বরাভয়। দেবীর আসনের নীচে হতে একটি কলস থেকে দুইটি সাপ বেরিয়ে আসছে। আপত দৃষ্টিতে এটি মনসা মূর্তি মনে হয়। কিন্তু নলিনীকান্ত ভট্টশালী বলছেন , দেবীর attribute সবই সরস্বতীর। তিনি লিখছেন –
The image would certainly have been identified as of Saraswati had the Surpenthood over the hea of the Goddess and the pitcher below her sent with Serpents Crawling out been absent.
আবার সূচনায় যে মন্ত্রটি উল্লেখ করেছি সেটি লক্ষ্য করুন। মনসা ও সরস্বতীর কি ভীষণ সাদৃশ্য লক্ষিত হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের এই ধ্যানমন্ত্রে মনসাকে ” সর্ববিদ্যাপ্রদাং শান্তাং সর্পবিদ্যাবিশারদম্ ” বলা হয়েছে। অর্থববেদের একটি মন্ত্রনুসারে দেবী সরস্বতীকে #বিষনাশিনী বলা হয়েছে। জাঙ্গুলী এবং দেবী সরস্বতীর অনুরূপ শক্তি আছে।
The vedic Goddess Saraswati in one of her aspect was a destroyer of snake poison and was often invoked in।that capacity .”
দেবী সরস্বতী এবং মনসার বাহন , বর্ণ এবং বিষনাশের শক্তি দেখে উভয়ের ঐক্যের কথা বলা হয়েছে। সুধীভূষণ ভট্টাচার্য লিখেছেন, মনসামূর্তির আড়ালে এক বিদ্যার দেবী আছেন। তার প্রমাণ সরস্বতীর ন্যায় অষ্টনাগ এবং দেবী মনসা পঞ্চমী তিথিতে পূজিতা হন। দেবী মনসা পদ্মাবতী, তিনি পদ্মপুরাণের কুলদেবী। আশুতোষ ভট্টাচার্য জ্ঞান সম্পর্কিত যোগের নিরিখে বারবার দেবীদ্বয়ের ঐক্যসূত্র খুঁজেছেন। দেবী মহামায়ার সঙ্গে তাঁর কোনো পার্থক্য নেই।
আদ্যাশক্তি মহামায়ার অনন্ত তাঁর রূপ, অনন্ত তাঁর বৈচিত্র্য, অনন্ত তাঁর বৈভব। তাঁর কোন নির্দিষ্ট মূর্তি নেই। সাধকের কল্যাণার্থে বিভিন্ন রূপে তিনি প্রকাশিত হন। যা আধ্যাশক্তির অনন্ত রূপের মধ্যে বঙ্গদেশে খুবই জনপ্রিয় পূজিত বিগ্রহ হলেন দেবী মনসা। যিনি মহাজ্ঞানযুক্তা, জ্ঞানিদের প্রধানা, শ্রেষ্ঠা, সিদ্ধগণের অধিষ্ঠাতৃদেবী, সিদ্ধিস্বরূপিনী এবং সিদ্ধিদায়িণী। পৌরাণিক এবং লৌকিক দুটি উৎসেই অসংখ্য গল্প কাহিনী রচিত হয়েছে দেবীর মাহাত্ম্যকে কেন্দ্র করে। দেবী মনসা যে ব্রহ্মস্বরূপিনী আদ্যাশক্তি; বিষয়টি দেবীভাগবতের নবমস্কন্ধের আটচল্লিশতম অধ্যায়ের শুরুতেই আমরা এর উল্লেখ পাই। সেখানে বিস্তারিত দেবীমাহাত্ম্য বর্ণিত আছে।
শ্বেতচম্পকবর্ণাভাং রত্নভূষণভূষিতাম । বহ্নিশুদ্ধাংশুক াধানাং নাগযজ্ঞোপবীতিনীম্।। মহাজ্ঞানযুতাং তাঞ্চ প্রবরজ্ঞানিনাং বরাম্। সিদ্ধাধিষ্ঠাতৃদ বীঞ্চ সিদ্ধাং সিদ্ধিপ্রদাং ভজে।।
(দেবীভাগবত: নবযস্কন্ধ, ৪৮.২-৩)
“যাঁর দেহের বর্ণ শ্বেতচম্পক ফুলের মত শুভ্র, অঙ্গে বিবিধ প্রকারের রত্নভূষণ শোভা পাচ্ছে, যিনি অগ্নিবর্ণের রক্তিম বস্ত্ৰ পরিধান করে আছেন; যিনি মহাজ্ঞানযুক্তা, জ্ঞানিদের প্রধানা, শ্রেষ্ঠা, সিদ্ধগণের অধিষ্ঠাতৃদেবী, সিদ্ধিস্বরূপিনী এবং সিদ্ধিদায়িনী তাঁর সদা ভজনা করি।” সূচনায় আমি এই মন্ত্রের কিছুটা উল্লেখ করেছি।
স্বয়ং প্রকাশিতা আদ্যাশক্তি দেবী নাগ ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত জীবদের রক্ষার্থে পুরাকালে আবির্ভূত হন। নাগের আক্রমণ হতে রক্ষার জন্যে, কশ্যপ মুনি মানব রক্ষায় যখন চিন্তিত মনে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন, তখন কাশ্যপ মুনির চিন্তিত মনের মাঝেই দেবী প্রকাশিত হন। তাঁর কোন জন্ম নেই, জীবদের রক্ষার্থে তিনি আবির্ভূত হয়ে রক্ষা করেন, লীলা করেন।অনন্ত রূপধারিণী লীলাময়ী তিনি।
চিন্তার অতীত তাঁর স্বরূপ, তিনি যতটা কৃপা করে জানান ; মায়াবদ্ধ জীব ততখানিই তাঁকে জানতে পারে।
পুরা নাগভয়ক্রান্তা বভূবুর্মানবা ডুবি । গতাস্তে শরণং সর্বে কশ্যপং মুনিপুঙ্গবম্ । মন্ত্রংশ্চ সসৃজ্যে ভীতঃ কশ্যপো ব্রহ্মণান্বিতঃ । বেদবীজানুসারেণ চোপদেশেন ব্ৰহ্মণঃ ।। মন্ত্রাধিষ্ঠাতৃদেবীং তাং মনসা সসৃজ্যে তথা । তপসা মনসা তেন বভূব মনসা চ সা ।। (দেবীভাগবত: নবযস্কন্ধ, ৪৮.১১-১৩)
“পুরাকালে পৃথিবীতে নাগের ভয়ে ভীত হয়ে মনুষ্যগণ জীবন রক্ষার্থে মুনিশ্রেষ্ঠ কশ্যপের শরণাপন্ন হন। ভীত মনুষ্যদের বর্ণনা শুনে, কশ্যপ মুনিও ভীত হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। তখন ব্রহ্মার আদেশে কশ্যপ মুনি নাগভয় থেকে মুক্তির জন্য এক বেদোক্ত বীজ অনুসারে জপ-ধ্যান শুরু করলেন। তৎকালে যন্ত্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনসা ধ্যানরত কাশ্যপ মুনির মন হতে আবির্ভূত হলেন; তাই তাঁর নাম হল মনসা। “
দেখুন দেবীভাগবত বলছেন যে, মনসা ঋষি কাশ্যপের মানস কন্যা। তিনি মানসে ধ্যানমগ্না ছিলেন। এবার দেখুন –
শ্রীধরাশ্বমুখৌ পার্শ্বদ্বয়ে বাগীশ্বরী ক্রিয়া ।
কীর্তিরলক্ষ্মীস্তথা সৃষ্টির্বিদ্যা শান্তিশ্চ মাতরঃ।।
তিনিই ব্রহ্মস্বরূপীনি বাগেশ্বরী বীণাপাণি। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে স্পষ্ট করে উল্লিখিত হয়েছে যে বাক্যই সরস্বতী। শতপথ ব্রাহ্মণেও উল্লেখ আছে – বাগ্বৈ সরস্বতী। তিনিই বাক্ শক্তি। তিনি অন্তরীক্ষ এবং অভ্যন্তরের বাক্।
অম্ভৃণ ঋষির কন্যার নামও বাক্ ছিল। তিনিই ব্রহ্মবাদিনী ছিলেন। তিনিই দেবী সুক্ত রচনা করেন। আদিত্য ঋগ্বেদের বাগনভৃণী ঋকে তাঁর ব্রহ্মদর্শনের কথা ব্যক্ত হয়েছে। অম্ভৃণীকে আদিত্য শুক্লযজুর্বেদ শিক্ষা দান করেন। বাক্ অম্ভৃণীর নিকট শিক্ষা লাভ করেন।
অহং রুদ্রেভিরিত্যষ্টর্চ্চস্য সূক্তস্য বাগম্ভৃণী ঋষিঃ সচ্চিদানন্দাত্মকঃ সর্ব্বগতঃ শ্রীআদিশক্তির্দেবতা ত্রিষ্টুপ্ছন্দো দ্বিতীয়া জগতী শ্রীজগদম্বাপ্রীত্যর্থে সপ্তশতীপাঠান্তে জপে বিনিয়োগঃ।
অহং রুদ্রেভি’ ইত্যাদি আট মন্ত্রবিশিষ্ট ঋগ্বেদীয় দেবীসূক্তের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বাক্, যিনি মহর্ষি অম্ভৃণের কন্যা; এই সূক্তের দেবতা পরব্রহ্মময়ী আদ্যাশক্তি; সূক্তের দ্বিতীয় মন্ত্রটি জগতী ছন্দে ও অবশিষ্টাংশ ত্রিষ্টুপ ছন্দে নিবব্ধ। শ্রীজগদম্বার প্রীতির নিমিত্ত সপ্তশতী চণ্ডীগ্রন্থ পাঠান্তে দেবীসূক্তম্ পাঠ করা হয়।
ওঁ অহং রুদ্রেভির্ব্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিনোভা।।
আমি (একাদশ) রুদ্র ও (অষ্ট) বসুরূপে বিচরণ করি; আমি (দ্বাদশ) আদিত্য ও বিশ্বদেবগণের রূপে বিচরণ করি; আমি মিত্র ও বরুণকে ধারণ করছি; আমি ইন্দ্র ও অগ্নিকে ধারণ করছি; আমিই ধারণ করছি অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে।।
বাগ্ বৈ সরস্বতী …. মা ব্রহ্মময়ীই সরস্বতী। তিনিই ব্রহ্ম রূপে আমাদের কন্ঠে, হৃদয়ে, মস্তিকে বিরাজ করেন। সেই জন্যই বলা হয় –
ব্রহ্মার্পণং ব্রহ্ম হবির্ব্রহ্মাগ্নৌ ব্রহ্মণা হুতম্।
ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্রহ্মকর্মসমাধিনা।।’
যে যজ্ঞে অর্পণ (অর্থাৎ যে সকল পাত্র দ্বারা যজ্ঞাদিতে বস্তু অর্পিত হয়) ব্রহ্ম, ঘৃতাদিও ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মরুপ কর্তার দ্বারা ব্রহ্মরূপ অগ্নিতে আহুতি প্রদানরুপ ক্রিয়াও ব্রহ্ম, – এরূপ যজ্ঞকারী যে ব্যক্তির ব্রহ্মেই কর্ম-সমাধি হয়েছে, তাঁর উপযুক্ত কর্মের ফল প্রাপ্তিও ব্রহ্মই হয়। দেবীর কৃপা পেতে হয়ে উদাত্ত কন্ঠে তাঁকে ডাকবেন। সেই বাক্য উচ্চারণই হল দেবীর উপাসনা। বাক্যেরই নামান্তর বাণী , ভারতী , সরস্বতী। তিনি ধেনুর দুগ্ধের ন্যায় অভীষ্ট আলোক দান করেন।
বাচং ধেনুমুপাসীত….
স্বাহাকার , স্বধাকার , বষটকার, হস্তকার এই চারিটির মধ্যে যেটির উপাসনা করা হয় , তদ্রুপ ফল লাভ হয়। দেবী সরস্বতী ইড়াও বটে। তিনি একাদশ আপ্রীদেবতার মধ্যে অন্যতম। তিনি ভরত জাতির কুলদেবী। ভরত জাতি যজ্ঞপরায়ণ জাতি ছিলেন। ঋগ্বেদে বলা হয়েছে –
শ্রেষ্ঠং যবিষ্ঠ ভারতাগ্নে দ্যুমন্তমা ভর।
ভরতরা যজ্ঞশীল ছিলেন তা ঐতরেয় ব্রাহ্মণ, শতপথ ব্রাহ্মণ , তৈত্তিরীয় আরণ্যক ,পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণ তা স্পষ্ট করে বলেছেন। দেবশ্রবা এবং দেববাত নামক দুই রাজাও সরস্বতী , আপয়া, দূষদ্বতীতীরে বাস করতেন। যেহেতু ভরতরা দেবী সরস্বতী নদীর তীরে যঞ্জ করতেন এবং তাঁদের কুলদেবী সরস্বতী ছিলেন তাই দেবী ভারতী নামেও পরিচিতা ছিলেন। অর্থাৎ উভয়ের আমাদের দেহে সুপ্ত ও গুপ্ত হয়ে অবস্থান করছেন। যদি আমরা চাই তবেই তাঁরা আবির্ভুতা হন।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. ঋগ্বেদ্
২. মার্কণ্ডেয় পুরান
৩. শ্রী শ্রী চণ্ডী
৪. সরস্বতী তত্ত্ব
৫. সরস্বতী সভ্যতার ইতিহাস
৬. দেবীভাগবত