তীর্থ হোক বা শখের ভ্রমণ, বেড়ানোর শেষে ফেরার পথে বাঙালির থলে ভরে ওঠে নানারকম উপহারে। আত্মীয়প্রীতি অনেকটা তলানিতে ঠেকলেও প্রিয়জনের জন্য যে জায়গায় গেছিলেন সেখানকার এটা ওটা টুকিটাকি হাতে করে নিয়ে আসতে এখনও ভোলে না বাঙালি। আজ থেকে একশ বছর আগে বাঙালি তীর্থভ্রমণই করত বেশি, ফলে সেখানেও তীর্থক্ষেত্রের প্রসাদ বা শুকনো ফুলমালা বয়ে আনার পাশাপাশি ওই তীর্থস্থান সংক্রান্ত নানা জিনিসে ভরে উঠত তাদের বাক্সপ্যাঁটরা। এইভাবেই কালীঘাট মন্দিরে পুজো দিতে আসা দর্শনার্থীদের দাক্ষিণ্যে চাহিদা বেড়েছিল কালীঘাটের স্মারক চিহ্নমূলক কালীঘাট চিত্রকলার। ১৯২৫ সাল নাগাদ কালীঘাট মন্দিরের আশেপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই তরুণ ছবি আঁকিয়ে যামিনী রায়ের চোখ পড়ে এমনই পটচিত্রগুলোর উপর। নিপুণ হাতে আঁকা উজ্জ্বল রঙের এই পট সেই শিল্পীর এতদিনকার শেখা বিদ্যায় জোর ধাক্কা দিল। এই পটচিত্র মুগ্ধ করল তাঁকে, বিস্ময়াবিষ্ট হলেন তিনি। ছবি আঁকার মধ্যে এতদিন ধরে যা তিনি খুঁজছিলেন, অবশেষে যেন খুঁজে পেলেন। এই খোঁজের শুরু কোথায় তা বুঝতে আরও অনেকগুলো দিন পিছিয়ে যেতে হয়।
যামিনী রায়ের পূর্বপুরুষ যশোরের প্রতাপাদিত্য রায়ের বংশজ। এঁরাই কপালের ফেরে ভিটেমাটি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বাঁকুড়ার মল্লরাজের রাজ্যে। কিন্তু এখানেও ভাগ্যবিপর্যয়। তাই সেখান থেকে সোজা বেলিয়াতোড়। যামিনী রায়ের নিজের স্মৃতিচারণায় তাঁর বাবা রামতারণ সরকারি চাকরি করতেন একসময়, তারপর সব ছেড়ে গ্রামে ফিরে চাষবাস শুরু করেন। নিজের হাতে সুতো তৈরি করে গ্রামের মানুষকে শিখিয়েছিলেন তাঁত বুনতে। সচ্ছলতার পরিসর থেকে দারিদ্র্যের চৌকাঠে এসে পড়লেও যামিনী’র মা নগেন্দ্রবালা মানিয়ে নিয়েছিলেন সব। মাটির কাছাকাছি নয়, মাটির প্রত্যক্ষ সংযোগেই বড়ো হচ্ছিলেন যামিনী।
গ্রামের কুমোরদের হাতের কাজ, মা ঠাকুমাদের কাঁথার বুনন, পালাপার্বণে দেওয়া উঠোন ভর্তি আলপনা দেখতে দেখতে তাঁর শিকড়ের টান পোক্ত হচ্ছিল ভালোভাবেই। এরপর এই প্রতিভা জেলা-প্রশাসকের সুনজরে পড়তেই, তাঁর ব্যবস্থাতে ষোল বছরের যামিনী ভর্তি হলেন কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে। দরিদ্র পরিবারে সেসময় এ এক বিরাট সাহসী পদক্ষেপ। আর্ট স্কুলের খরচ জোগাতে নানারকম কাজ করতে শুরু করলেন যামিনী রায়। আর এই প্রত্যেকটা কাজই তাঁর শিল্পীসত্তাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করল। যেমন, অর্ডারি কার্ড আঁকা, ছবির বর্ডার রং করা, ‘সীতা’ নাটকে স্টেজের সিন আঁকা, শ্যামবাজারে কাপড়ের দোকানে কাজ করা প্রভৃতি। শাড়ি কেনাবেচা করতে করতেই যামিনী অনুভব করেছিলেন ব্যক্তিবিশেষে রঙের পছন্দ অপছন্দ। আবার এর পাশাপাশি নিবিষ্ট মনে তিনি বুঝে গেছেন আর্ট স্কুলে শেখা ইউরোপীয় শিল্পরীতির রকমফের। ভাইস প্রিন্সিপাল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্য এই ছাত্র পোট্রের্ট, ক্ল্যাসিকাল ন্যুড তেলরং দিয়ে এঁকেছেন নিপুণভাবে। কিন্তু এসবের মাঝে নিজের দেশ, নিজের সংস্কৃতিকে খুঁজে পেতেন না, যা পেলেন প্রথম ওই কালীঘাটের পটচিত্রে। একইসঙ্গে মনে রয়ে গেল আর্ট কলেজে দেখা শিল্পী সেজান, গগ্যাঁ, ভ্যান গঘের ছবির প্রভাব। ফলত প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মিশেলে এরপর যামিনী রায়ের হাতে তৈরি হল ভারতীয় চিত্রশিল্পের সম্পূর্ণ মৌলিক এক আঙ্গিক।
যামিনী রায়ের নিজস্ব ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হল বাংলার লোকসংস্কৃতি, লোকশিল্প, লোকপুরাণ, লোকজ ছন্দ অর্থাৎ আদ্যোপান্ত সাধারণ মানুষ। পটুয়া পাড়া, কালীঘাট, নিজের জন্মস্থান বেলিয়াতোড়ের জীবন এমনকি বিষ্ণুপুরী টেরাকোটার কাহিনি তাঁর ছবিতে ধরা পড়ল জীবন্ত হয়ে। বৈষ্ণব অনুরাগ, রামায়ণ, মহাভারতের কথা, মঙ্গলকাব্যের সুর নতুনভাবে যেন রূপ পেল যামিনী রায়ের আঁকায়। প্রাণী ও উদ্ভিদের বিভিন্ন মোটিফ এঁকে তাতে সম্পূর্ণ ভেষজ রং ব্যবহার করতেন তিনি। তাঁর জীবনের সারল্য ধরা পড়েছে বারবার আঁকায়। ভুষোকালি, গাছগাছালির পাতা বেটে তৈরি রং, সাধারণ খড়ি, তেঁতুলের আঠা, ডিমের সাদা অংশ কিংবা নদীর পলিমাটি তুলে এনে তা দিয়ে ছেঁড়া চট, কাপড়, চাটাই অথবা তালপাতায় ছবি আঁকতেন যামিনী রায়। মূলত লাল, হলুদ, কালো আর নীল রঙে তাঁর ছবি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মৌখিক পরম্পরায় তৈরি পটচিত্রের কাহিনিতে যামিনী রায় তাঁর নিজস্ব শিক্ষা, রুচি যোগ করার পাশাপাশি গোষ্ঠীভিত্তিক হেঁয়ালি প্রবাদকেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর ছবির বিষয় হতে পেরেছিল বাঁকুড়ার দিগন্ত জোড়া ঊষার মাঠ, সাঁওতাল মা ও তার সন্তান, ধানখেতের লাঙল ধরা চাষি, মাদল বাজানো সাঁওতালি পুরুষ, বাদলাদিনে দল বেঁধে মেয়েদের ধানরোপণ কিংবা যিশু, রাধাকৃষ্ণ-সহ আরও কত কি। নিজের উদ্ভাবিত এ শিল্পরীতির নাম যামিনী রায় দিয়েছিলেন ‘ফ্ল্যাট টেকনিক’। ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটে তাঁর প্রথম ছবির প্রদর্শনী হয়। সেই প্রথম সর্বসমক্ষে স্বীকৃতি পায় যামিনী রায়ের কাজ। একে তো উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার তার সঙ্গে চোখ আঁকার এক বিশেষ কৌশলে তাঁর ছবি সবার থেকে আলাদা হয়ে যায়। মোটা দাগে আঁকা সপ্রতিভ চোখ তাঁর সব ছবিকেই খুব জীবন্ত করে তুলেছিল। দেশের সাধারণ মানুষ যাতে দেশের শিল্পের কদর করতে পারেন তাই খুবই স্বল্প মূল্য নির্ধারিত ছিল যামিনী রায়ের আঁকার। আর এ কারণেই বুঝি তাঁর আঁকা আজও বিয়ের কার্ডে, পুজোর প্যান্ডেলে, মধ্যবিত্তের ড্রয়িং রুমে শোভা পায়। রাজনীতির তত্ত্ব তালাশে মশগুল বাঙালি ছবি আঁকার তত্ত্ব বুঝুক না বুঝুক, যামিনী রায়ের আঁকা ছবিতে ঘর সাজিয়ে নিজেকে রুচিশীল পরিচয় দিতে আজও সমান উৎসাহী।সারা বিশ্বে সমাদৃত এই মানুষটি তাঁর শিল্পকর্মের জন্য ‘ভাইসরয়’, ‘পদ্মভূষণ’, রবীন্দ্রভারতী’র দেওয়া ‘ডি-লিট’ ডিগ্রি, আমাদের দেশে চারুশিল্পের সর্বোচ্চ সম্মান ‘ললিতকলা একাডেমি পুরস্কার’-সহ একাধিক সম্মান পেয়েছেন। তবু যেন বাঙালিয়ানায় ভরপুর যামিনী রায়ের ছবিকে সঠিকভাবে বোঝার মতো লোকসংখ্যা এদেশে সীমিতই রয়ে গেছে। শিল্পের কোনো শর্টকাট নেই, যা অনুভব করা যায় তাই-ই ফুটিয়ে তুলতে হবে রং, তুলি আর হাতের আঙুলে; আজীবন এই বিশ্বাসে ছবি এঁকেছিলেন যে মানুষটি, তাঁর কাছে বাঙালি ঋণী ভীষণভাবে। ছবি আঁকার তত্ত্ব না জানলেও হয়তো ক্ষতি হয় না ততটা, যতটা ক্ষতি হয় নিজেকে খুঁজে চলা, নিজের দেশ, নিজের শিকড়কে খুঁজে চলা মানুষ যামিনী রায়কে উপলব্ধি না করলে। আজ, কিছুটা হলেও সেই শিকড় খোঁজার দিন, তাঁর শিল্পে ভারতবর্ষের প্রত্যক্ষ প্রাণস্পন্দন খুঁজে নিয়েছিলেন যে মানুষটি, সেই মানুষটির জীবনছন্দ অনুভব করার দিন। কারণ, আজ আধুনিক ভারতীয় চিত্রকলার প্রবাদপ্রতিম শিল্পী যামিনী রায়ের জন্মদিন। বহুমুখী প্রতিভার নিরিখে যাঁকে বিষ্ণু দে তুলনা করেছিলেন পিকাসোর সঙ্গে। শিল্পের কাছে আজীবন যিনি ছিলেন এক সত্যিকারের পরিশ্রমী এবং সৎ তপস্বী।