আমাদের দেশে সৃষ্টি তথা উৎপাদনশীলতার দেবতা হিসেবে শিবকে আদিদেব মান্য করা হয়। আবার উত্তরবঙ্গের মধ্যে দিয়েই যে হেতু আর্য সংস্কৃতি তথা কৃষি সভ্যতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিল বঙ্গদেশে, তাই অনেকে মনে করেন উৎপাদনশীলতা তথা কৃষিদেবতা হিসেবে এই উত্তরবঙ্গেই প্রথম শিব পূজার প্রচলন হয়। ভিন্ন মতও আছে। তবে শিব যে বাঙালির একটি জনপ্রিয় দেবতা তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গে শিব পুজোকে কেন্দ্র করে মূলত তিনটি উৎসব হয়, ফাল্গুন মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে শিবরাত্রি, চৈত্র সংক্রান্তিতে গাজন ও শ্রাবণী পূর্ণিমায় ছড়িযাত্রা। শিবরাত্রি মূলত মেয়েদের উৎসব বলেই পরিচিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রীতিনীতি অনেক পাল্টে গেলেও পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থানে এখনও মহাসমারোহে শিবরাত্রি পালিত হয়। বলাই বাহুল্য বেশ কিছু মেলাও বসে এই উপলক্ষে।


জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি থেকে আরও ৭-৮ কিলোমিটার দূরে জরদা নদীর ধারে একান্ন পীঠের অন্যতম জল্পেশ মন্দিরের অবস্থান। এখানে ভৈরব জল্পীশ তথা জল্পেশ এবং ভৈরবী ভ্রমরী। পুরাণ মতে এই তীর্থ হাজার বছরেরও প্রাচীন। প্রাগজ্যোতিশপুরের (অসম) রাজা জল্পেশ এই মন্দির তৈরি করান বলে, মন্দির ও দেবতার নামও জল্পেশ। যদিও পাথুরে প্রমাণে তার সাক্ষ্য মেলে না। ঐতিহাসিকদের মতে কোচবিহারের রাজারা সপ্তদশ শতকে এই মন্দির তৈরি করান। মন্দিরের মতো মন্দিরের শিবমূর্তিটিও রহস্যাবৃত। ঈষৎ সবজেটে বা সাদা শিবলিঙ্গের খুব অল্প অংশই দেখা যায়। মসৃণ নয়, খাঁজযুক্ত। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এটি উল্কাপিণ্ড।
মনে করা হয় সপ্তদশ শতকে মন্দির তৈরির পর থেকেই মেলার সূচনা। সেই দিক থেকে মেলাটি গোটা রাজ্যেরই প্রাচীন মেলাগুলির অন্যতম। এক সময় মন্দিরের আয়ের অন্যতম পথ ছিল জল্পেশ মেলা। ডুয়ার্স যখন ভূটানের অংশ ছিল, তখন ময়নাগুড়িকে কেন্দ্র করেই পাহাড় ও সমতলের ব্যবসা হত। ফলে এই মেলার বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল অসীম।


বর্তমানেও মেলার গুরুত্ব যথেষ্ট। উদ্বোধনে উপস্থিত থাকেন মন্ত্রী ও জনপ্রতিনিধিরা। মেলায় থাকে বিভিন্ন সরকারি দফতরের প্রদর্শনী। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তুলে ধরা হয় উত্তরবঙ্গের লোকসংস্কৃতি। বর্তমানে এই মেলার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে কৃষি মেলা। ১২-১৫ টাকা হাত হিসেবে প্রায় পাঁচ-ছশো দোকান বসে মেলায়। আগের মতো দূরের ব্যবসায়ীদের জায়গা এখন আর মেলে না, স্থানীয়রা সেগুলি দখল করে নিয়েছে। কিন্তু কেনাকাটা চলে পুরোদমে। উল্লেখযোগ্য পণ্যসামগ্রীর মধ্যে লোহা, কাঠ, কাঁসা, পিতল, পাথর আর মাটির তৈরি জিনিসপত্রই বেশি। এ ছাড়া বেত-বাঁশের সামগ্রী তো আছেই। আর আছে খাবারের দোকান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.