জগজিৎ সিং চৌহান শিখেদের জোকারের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন

সন ১৬৭৪, দিল্লির চাঁদনী চকে নবম শিখ গুরু তেগবাহাদুরের শিরশ্ছেদ করার আদেশ দেয় আওরঙ্গজেব। এরপর মাত্র দশবছর বয়সে দশম গুরু হিসেবে শপথ নেন গোবিন্দ সিংহ। ইনি ধর্মশিক্ষার সাথে শিখদের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলেন। ১৬৯৯ সালে বৈশাখী পূর্ণিমার দিন তিনি এক সশস্ত্র ধর্মযোদ্ধা বাহিনী গড়ে তোলেন, নাম দেন খালসা মানে বিশুদ্ধ। প্রবর্তন করেন শিখদের সিংহ পদবী ও পঞ্চ ‘ক’ পরিধান। কেশ, কাঙ্গী, কড়া, কচ্ছ ও কৃপাণ। লড়াইয়ে নামেন মোগল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, মারাও যান যুদ্ধক্ষেত্রে। তারপর থেকে শিখরা পবিত্র ধর্মপুস্তক গ্রন্থসাহেবকেই গুরু বলে মানে। বেশিরভাগ শিখ এই আকালি সম্প্রদায় ভুক্ত, অবশ্য নিরঙ্কারী সম্প্রদায়ের শিখও আছে, যাদের এখনও গুরু বর্তমান।
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে শিখদের রয়েছে এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। গদর পার্টি তৈরী হয় ১৯১৩ সালে, সানফ্রান্সিসকোতে, মার্কিন প্রবাসী শিখদের নিয়ে। কোমাগাতামারু জাহাজের ঘটনাটিতেও কিন্তু বেশিরভাগ প্রবাসী শিখ জড়িত ছিলেন। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় নেতাজীর আগমনের আগেই আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করেছিলেন একজন শিখ, মোহন সিং। পরবর্তী সময়ে গুরবক্স সিং ধীলোঁ ছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের একজন কমান্ডার।


সত্তরের দশকের শেষ দিকে ইংল্যান্ড এবং আমেরিকার প্রবাসী শিখদের কাছে খলিস্তান আন্দোলনের ভাইরাস যিনি ছড়িয়ে দেন, তিনি হলেন জগজিৎ সিং চৌহান। ইনি ছিলেন পাঞ্জাবে ১৯৬৭ সালে আকালি দলের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয়, তার ডেপুটি স্পিকার, পরে পাঞ্জাবের অর্থমন্ত্রীর হন। ১৯৭১ সালে ইংল‍্যান্ডে চলে যান, এরপর শিখেদের “হোমরুল আন্দোলনে” যোগ দেন। অনেকের মতে এই আন্দোলন‌ই একসময় খলিস্তান আন্দোলনে পরিণত হয়।


১৯৭১ এ পূর্ব পাকিস্তানে তান্ডব নৃত্য চালাচ্ছিল পাকিস্তান। ইয়াহিয়া খান আর তাঁর গুরু রিচার্ড নিক্সনের তখন অন‍্যতম শিরঃপীড়া কিভাবে দুনিয়ার নজর সেইদিক থেকে ঘোরানো যায়। শিখেদের এই হোমরুল আন্দোলনে দুই মহাপ্রভু একটা আশার আলো দেখতে পান। ইংল‍্যান্ডে জগজিৎ সিংয়ের পায়ের ধুলো পড়তেই ইন্দিরা গান্ধীকে ব‍্যাতিব‍্যস্ত করার এই সুযোগ ইয়াহিয়া লুফে নিলেন। জগজিৎ সিংকে জামাই আদরে পাকিস্তানে গুরু নানকের জন্মস্থান নানকানা সাহিবে পাঠানো হল। সেখানে তাঁকে শিখ গুরুদের ব‍্যবহৃত কিছু পবিত্র বস্তু দেওয়া হল, যা দেখিয়ে তিনি প্রবাসী শিখদের কাছে নিজেকে নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। যদিও ভারতীয় শিখেদের মধ্যে জগজিৎ সিংয়ের কোন প্রভাব‌ই ছিল না।
ইতিমধ্যে ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা “র” -এর প্রচেষ্টায় আমেরিকায় পূর্ব পাকিস্তানে নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন শুরু হয়েছে। সেটাকে প্রতিহত করার জন্য আইএস‌আই আর CIA এর বোড়ে জগজিৎ সিংকে আমেরিকায় পাঠানো হল, রিপাবলিকান পার্টির আমন্ত্রণে। তবে এই পরিকল্পনার পিছনে নিক্সনের মন্ত্রণাদাতা হেনরি কিসিঞ্জারের অবদান উপেক্ষা করা যায় না।


নিউ ইয়র্কের, ‘ইউ এস ন‍্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল সেক্রেটারিয়েট’ -এর উদ্যোগে (এর সভাপতি ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার ) চৌহান স্থানীয় মিডিয়াকে খলিস্তান আন্দোলনের সম্পর্কে জানান। ১৯৭১ সালের তেরোই অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমসে এক পাতা জোড়া একটি বিজ্ঞাপন ছাপা হয়, যেখানে বলা হয়েছে শিখেরা তাদের আলাদা হোমল‍্যান্ড ‘খলিস্তানের’ দাবি করছে। পরবর্তী সময়ে “র” এর এক তদন্তে জানা যায় এই বিজ্ঞাপনের জন্য টাকা ঢেলেছিল ওয়াশিংটনের পাকিস্তান এম্ব‍্যাসী।
কিন্তু সত্তরের দশকের শুরুতে পাঞ্জাব এবং প্রবাসী শিখদের মধ্যে খলিস্তান আন্দোলনের তেমন কোনও প্রভাব ছিল না, আই এস আই এবং সি আই এ -র সবরকম চেষ্টা সত্ত্বেও। তবে জৈল সিংয়ের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এবং আকালি দলের বিচ্ছিন্নতাবাদী “আনন্দপুর সাহিব রেজল্যুশন” সত্তরের দশকের শেষে ছবিটা অনেকটাই বদলে দিয়েছিল।


১৯৭৭ -এর সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধীর পতন হয়। ততদিনে সি আই এ -র কাছে প্রবীণ জগজিৎ সিং চৌহানের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে এসেছে। আমেরিকা, কানাডা আর ইংল্যান্ডের কয়েকজন প্রবাসী শিখ যুবক তৈরী করেছে ‘ইন্টারন‍্যাশনাল শিখ ইউথ ফেডারেশন’, যারা যোগাযোগ রেখে চলেছিল ভারতীয় সংগঠন ‘দল খালসা’ এর সঙ্গে। উল্লেখ্য, এটি জৈল সিংয়ের বদান‍্যতায় তৈরী হয় এবং এরা ভিন্দ্রান‌ওয়ালেকে নিজেদের ‘আইডল’ বলে ঘোষণা করে।


নিজের গুরুত্ব ফিরিয়ে নিয়ে আসার উদ্দেশ‍্যে ১৯৭৯ সালে জগজিৎ সিং চৌহান আবার ভারতে আসে। ঐবছর ১২ই নভেম্বর চৌহান অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে একটি ছোট রেডিও ট্রান্সমিটার বসান, যার মাধ্যমে গ্রন্থসাহেবের থেকে আবৃত্তি প্রচার করা হত। কিন্তু এর আসল উদ্দেশ্য ছিল অন্য। ১৯৮০ -র মার্চে আনন্দপুরের গুরুদোয়ারা কেশগড় সাহিবে চৌহান, খলিস্তানের পতাকা উত্তোলন করেন। ইন্দিরা গান্ধী ইতিমধ্যে দিল্লির দরবার পুনরায় নিজের দখলে নিয়ে এসেছেন, গৃহমন্ত্রীর পদে বসেছেন জৈল সিং।
১৯৭৯ সালে এই চৌহানই ইংল্যান্ডে ‘খলিস্তান ন‍্যাশনাল কাউন্সিল’ গঠন করেন। চৌহানের বন্ধু, বলবীর সিং সান্ধুকে ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ খলিস্তানের সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত করা হয় এবং স্বর্ণমন্দির থেকে স্বাধীন খলিস্তানের দাবিতে বার্তা প্রচার করা শুরু হয়। সান্ধুর উদ্যোগে খলিস্তানের পাসপোর্ট, স্ট্যাম্প, এমনকি কারেন্সিও প্রকাশ করা হয়।


১৯৮০ -র ৮ -ই জুন এক প্রেস মিটিংয়ে সান্ধু জানান ১৬ ই জুন স্বাধীন খালিস্তান সরকার গঠনের ঘোষণা করা হবে, আর চৌহান বিদেশ থেকে এর ক্যাবিনেটে কারা থাকবেন তা জানিয়ে দেবেন। সান্ধু সব ‘স্বাধীনতাকামী’ দেশকে খালিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে আসতে বলেন। ১৬ ই জুন, লন্ডন শহরে চৌহান নিজেকে খালিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা করেন।


তিনি আরও ঘোষণা করেন খুব তাড়াতাড়ি লন্ডন আর ইওরোপের অন্যান্য দেশে খলিস্তানের দূতাবাস খোলা হবে। ইতিমধ্যে আমেরিকার সঙ্গে দশহাজার সেনাবাহিনীর ট্রেনিংয়ের ব্যাপারে কথা হয়ে গিয়েছে আর আমেরিকাতে প্রবাসী খলিস্তান সরকার গঠন করা হবে। বিখ্যাত সাংবাদিক খুশবন্ত সিং অবশ্য ওনার সমালোচনা করে লিখেছেন, জগজিৎ সিং চৌহান শিখেদের জোকারের পর্যায়ে নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন।

লেখকঃ ইতিহাস বিষয়ক কলাম লেখক ও প্রাবন্ধিক  স্বপন সেন
হালিশহর , কলকাতা।

https://ganosorja.com/wp-content/uploads/2020/04/Logo-1.png

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.