এদেশে পরীক্ষামূলক গবেষণার পথিকৃৎ বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু

আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানের পরিসরে যে কয়েকজন বাঙালি দেশের বিজ্ঞান চর্চার উৎকর্ষতাকে মহিমান্বিত করেছেন জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁদের মধ্যে অন্যতম।  ১৮৫৮ সালে ৩০শে নভেম্বর অধুনা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ শহরে মাতুলালয়ে তিনি জন্মগ্রহন করেন। ময়মনসিংহ জেলা স্কুলের চৌকাঠ অতিক্রম করে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। সেখান থেকে বি এ পাশ করে উচ্চ শিক্ষা লাভের অভিপ্রায়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি দেন। ১৮৮৫ সালে কেমব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজ থেকে ন্যাচারাল সায়েন্স-এ ট্রাইপস পাশ করেন, এবং প্রায় একই সময়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। সেই বছরে প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অস্থায়ী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তারপর থেকে সেখানেই শুরু করেন গবেষণার কাজ। নিয়মিত চার ঘন্টা ক্লাস নেওয়ার পর তিনি গবেষণার কাজে আত্মনিয়োগ করতেন। ইতোমধ্যে ১৯৮৭ সালে তিনি ব্রাম্ভ সমাজের সংস্কারক দুর্গা মোহন দাসের কন্যা অবলাদেবীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে অধ্যাপনা করার সময় তাঁর গবেষণালব্ধ ফল লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হতো। সেই সকল গবেষণা পত্রের গুনগতমান বিবেচনাপূর্বক ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডিএসসি ডিগ্রি প্রদান করে। এইভাবে কালক্রমে বিজ্ঞানের জগতে ব্যাতিক্রমী প্রতিভা হয়ে বিকশিত হয়েছেন জ্ঞানতাপস জগদীশ চন্দ্র বসু। তাঁর গবেষণার গুরুত্ব উপলব্ধি করে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন একাধিকবার তাঁকে বক্তৃতা দেবার জন্য ইংল্যান্ডের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত লিভারপুল শহরে আমন্ত্রন জানায়। এভাবেই শুরু হয় জগদীশ চন্দ্র বসুর শিখরাভিমুখে পথ চলা। তাঁর হাত দিয়ে তৈরি হয় সত্যেন্দ্রনাথ বোস, মেঘনাদ সাহা, দেবেন্দ্রনাথ বসু, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ সহ প্রমুখ স্বনামধন্য কৃতিরা।  

জগদীশচন্দ্রের অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ বা মাইক্রোওয়েভ নিয়ে গবেষণা ছিল একটি যুগান্তকারী বিষয়। ১৮৮৭ সালে বিজ্ঞানী হার্জ বিদ্যুৎ তরঙ্গের অস্তিত্ব প্রমান করেন। বিজ্ঞানের জগতে খুলে যায় নতুন দিগন্ত। তবে তাঁর দেহান্তর ঘটে যাওয়ায় এই বিষয় নিয়ে নিবিড় গবেষণা করার সময় তিনি পান নি। বাস্তবে তাঁর অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিয়ে যান জগদীশ চন্দ্র বসু। তিনি পাঁচ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি করেন। দূরদর্শন, র‍্যাডার কিংবা মহাকাশ যোগাযোগ ব্যবস্থায় যার বহুল ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এই মাইক্রোওয়েভ গবেষণার ফসল আজকের রেডিও। পরিতাপের বিষয়, তাঁর গবেষণার পুরো কৃতিত্ব চলে যায় বিজ্ঞানী মার্কনির কাছে। কারণ জগদীশচন্দ্র তাঁর আবিস্কারের কোন পেটেন্ট গ্রহন করেন নি। মার্কনি জগদীশচন্দ্রের কাজের উপর গবেষণা করে গবেষণালব্ধ ফল নিজের নামে পেটেন্ট গ্রহন করেন। ফলে রেডিওর আবিস্কারক হিসেবে মার্কনির নাম খোদাই হয়ে যায়। অবশ্য ১৮৯৬-৯৭ সালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ও রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে বক্তৃতা দেওয়ার সময় জগদীশ চন্দ্র বসু তথ্য সহযোগে প্রমান করার করেন যে মার্কনি নয়, তিনিই প্রথম বেতার তরঙ্গের সাহায্যে সংবাদ প্রেরণের উপায় বের করেন। বস্তুত তিনিই পৃথিবীর প্রথম মাইক্রওয়েভ যন্ত্র আবিস্কার করেন। যা আজ যোগাযোগের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু এবং ব্যাখ্যানের গভীরতা দেশ-বিদেশের বিজ্ঞান জগতে প্রভূত প্রশংসা অর্জন করে। ১৮৯৮ সালে তাঁর আমন্ত্রনমূলক বক্তৃতামালা শেষ করে সস্ত্রীক স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।  
সময়টা ছিল ১৯০০ সালের আগস্ট মাস। প্যারিসে আয়োজিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক পদার্থবিজ্ঞানীদের প্রথম কংগ্রেস। সেই কংগ্রেসে ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমন্ত্রিত হয়েছেন বিজ্ঞানাচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু। সেই  সম্মেলনে জড়বস্তুর সংবেদনশীলতা বিষয়ে তাঁর পরীক্ষালব্ধ ফলাফল ব্যাখ্যা করেন। তাঁর বিষয় ছিল, " On the similarity of effect of electrical stimulus on inorganic and living substance।"  জগদীশচন্দ্রের বক্তব্য যখন সেখানে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের মধ্যে আলোড়ন তুলেছে, তখন সেখানে উপস্থিত ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। একজন ভারতীয় বিজ্ঞানী বিশ্বসভায় বক্তৃতা দিয়ে দেশকে মহিমান্বিত করেছে দেখে  স্বামীজির অন্তরাত্মা উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তিনি তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, "...সে বহু গৌরবর্ণ প্রতিভামন্ডলীর মধ্য হতে বঙ্গভূমির এক যুগ যশস্বী বীর আমাদের মাতৃভূমির নাম ঘোষনা করলেন, সে বীর জগৎপ্রসিদ্ধ বৈজ্ঞানিক ডক্টর জে সি বোস। এক যুবা বাঙালী বৈজ্ঞানিক আজ বিদ্যুৎবেগে পাশ্চাত্যমন্ডলীকে নিজের প্রতিভা মহিমায় মুগ্ধ করলেন। সে বিদ্যুৎসম্ভার মাতৃভূমির মৃতপ্রায় শরীরে নবজীবন-তরঙ্গ সঞ্চার করলে! সমগ্র বিজ্ঞানমন্ডলীর শীর্ষস্থানীয় আজ জগদীশ বসু-ভারতীয় বঙ্গবাসী, ধন্যবীর।" একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, তাঁর তারহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা সংক্রান্ত আবিস্কার উপগ্রহ নির্ভর যোগাযোগের পথকে সুগম করেছিল। সেই অমূল্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ চাঁদের কেন্দ্রস্থল থেকে দূরবর্তী স্থানে ৯১ কিলোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট একটি খাদ (ক্রেটার) বোস ক্রেটার নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেটি ভাবা ক্রেটার এবং ক্রেটার অ্যাডলারের কাছাকাছি স্থানে অবস্থিত। ১৯০১ সালে ৩০শে সেপ্টেম্বরে জগদীশচন্দ্র "বৈদুতিক তরঙ্গ সনাক্তকরণে গ্যালেনা ডিটেক্টর" এই কাজটির ইউএস পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন (পেটেন্ট নম্বরঃ ৭৫৫৮৪০)। ১৯০৪ সালের ২৯শে মার্চ তিনি এই পেটেন্টের স্বত্বাধিকার পান। এটি ছিল পদার্থবিদ্যায় পৃথিবীর মধ্যে সলিড স্টেট ফিজিক্সে প্রথম পেটেন্ট। আইনি কারণে পেটেন্টের অর্ধেক অধিকার দেওয়া হয় বিবেকানন্দের আমেরিকান শিষ্যা সারা বুলকে।  

 একজন বিশ্ববন্দিত বিজ্ঞানী হওয়ার পাশাপাশি জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন সুসাহিত্যিক, দেশপ্রেমিক এবং দার্শনিক। আবার বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। বিজ্ঞান বিষয়ক বাংলায় তাঁর প্রবন্ধসমূহ 'অব্যক্ত' নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। 'পলাতক তুফান'-এর মতো কল্পবিজ্ঞান আজও তাঁর সাহিত্য প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। বিজ্ঞানের পাশাপাশি সাহিত্যের উন্মুক্ত আঙিনায় তাঁর স্বচ্ছন্দ বিচরণ আমাদের নজর কাড়ে। তিনি কিছুকাল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।  ভূগোল ও বিজ্ঞানের জটিল বিষয়কে তিনি তাঁর রচনায় সুসংহত করেছেন, ছন্দোবদ্ধ করেছেন। সুলেখক, জাতীয়তাবাদী নেতা, শিক্ষানুরাগী রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত 'দাসী' পত্রিকায় জগদীশচন্দ্রের লেখা 'ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে' এমনি একটা অনবদ্য সৃষ্টি। ভাগীরথীর উৎপত্তি, তার গতিপথ এবং সাগরে সমাপতনের গতিময় ও অনুপম বর্ননা আজও আমাদেরকে মোহিত করে রাখে। এই লেখাটি প্রকাশিত হলে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়ে যারপরনাই আনন্দিত হন, এবং তিনি জগদীশচন্দ্রকে সাহিত্য চর্চায় উৎসাহিত করেন। বাস্তবে তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল গভীর এবং অকৃত্রিম। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, জগদীশচন্দ্রের কাজের উল্লেখ করে ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ বঙ্গদর্শনে দুটি প্রবন্ধ লেখেন। কবির লেখা 'জড় কি সজীব?' এই প্রবন্ধটি প্রসঙ্গে তিনি জগদীশ চন্দ্র বসুকে লেখেন, 'তোমার নব আবিস্কার সম্বন্ধে আমি একটি প্রবন্ধ লিখিয়াছি,......ভুলচুক থাকিবার সম্ভবনা আছে- দেখিয়া তুমি হয়তো মনে মনে হাসিবে।' এই পত্রের উত্তরে জগদীশচন্দ্র লেখেন, 'তুমি যে গত মাসে আমার কার্যের আভাস বঙ্গদর্শনে লিখিয়াছিলে তাহা অতি সুন্দর হইয়াছে। তুমি যে এত সহজে বৈজ্ঞানিক সত্য স্থির রাখিয়া লিখিতে পারো, ইহাতে আমি আশ্চর্য হইয়াছি।' ১৯১৭ সালে জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর স্বপ্নে লালিত 'বসু বিজ্ঞান মন্দির' প্রতিষ্ঠা করেন। সে প্রসঙ্গে কবিকে বলতে শুনি, -' এ তো তোমার একার সংকল্প নয়, এ আমাদের সমস্ত দেশের সংকল্প, তোমার জীবনের মধ্যে দিয়ে এর বিকাশ হতে চলল।' তাঁদের বন্ধুত্বের মহানুভবতা উপলব্ধি করা যায় যখন দেখি, জগদীশচন্দ্রের গবেষণার কাজে সহায়তা করার জন্য রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য জোগাড় করে দেন। জগদীশচন্দ্রের বারংবার সাফল্যে কবি লেখেন,' তোমার খ্যাতির শঙ্খ আজি বাজে দিকে দিগন্তরে, সমুদ্রের একূলে ওকূলে। আপন দীপ্তিতে বন্ধু তুমি দীপ্যমান।' কর্মজীবনে চলার পথে বিজ্ঞানাচার্য বন্ধু হিসেবে যেমন  রবীন্দ্রনাথকে পেয়েছিলেন তেমনি পেয়েছিলেন ভগিনী নিবেদিতাকে। নিবেদিতা ছিলেন আচার্যের কন্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করার প্রেরণা, যাঁর অকৃত্রিম সেবা, সাহচর্য ও সাহস আচার্যকে দুরূহ জীবনের অভিযাত্রায় দিশা দেখিয়েছে। 
জগদীশচন্দ্রের সামনে ১৯১৫ সালে সপরিবারে আমেরিকা ভ্রমণের সুযোগ আসে। সেই সময় তিনি আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রন পান। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নিউ ইয়র্ক বিজ্ঞান একাডেমি, ব্রুকলিন, ইনস্টিটিউট অফ আর্টস অ্যান্ড সায়েন্স, হাভার্ড, কলম্বিয়া এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়। পরে একসময় ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে তাঁর বক্তৃতার বিষয় ছিল 'অন ইলেকট্রিক ওয়েভস'। এই বিষয়ে পারসন্স ম্যাগাজিনে একটি খবর ছাপা হয়, যাতে বলা হয়, "  বিদেশি আক্রমণে ও অন্তর্দ্বন্দ্বে বহু বছর ধরে ভারতে জ্ঞানের অগ্রগতি ব্যাহত হয়ে চলেছিল, ...প্রবল বাধা বিপত্তির মধ্যে গবেষণা চালিয়ে একজন ভারতীয় অধ্যাপক আধুনিক বিজ্ঞানের বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাজের নজির রেখেছেন। বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিষয়ে তাঁর গবেষণাপত্র ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনে পাঠ করার সময় ইউরোপীয় জ্ঞানী-গুণীমহলে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি করেছে। তাঁর ধৈর্য ও অসাধারণ শক্তির প্রশংসা করতেই হয়, অন্তত যখন ভাবি যে মাত্র আঠারো মাসের মধ্যে বিদ্যুতের মতো অত্যন্ত দুরূহ বিষয়ের ছয়টি উল্লেখযোগ্য গবেষণা শেষ করেছেন।" তখন রয়্যাল ইনস্টিটিউশনে সান্ধ্য বক্তৃতা দেওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল। যেখানে আমন্ত্রিত হতেন প্রথম সারির আবিস্কারক ও দিকপালেরা। জগদীশচন্দ্র সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে দুর্লভ সম্মান লাভ করেন। একবার তাঁর বিষয় ছিল, 'অন দ্য পোলারাইজেশন অফ ইলেকক্ট্রিক রেইস' অর্থাৎ বিদ্যুৎ রশ্মির সমাবর্তন। সেই বক্তৃতা শুনে এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা দেখে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালে বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করেন, 'এমন নির্ভুল পরীক্ষা আগে দেখা যায় নি, এ যেন মায়াজাল।' এই বক্তৃতা দেওয়ার পর থেকে ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে আমন্ত্রণ আসতে থাকে। অচিরেই ডিউয়ার, লে, কর্ন এর মতো বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদের অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। তাঁকে ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সংগঠন 'Societe de Physeque'-এর সদস্য মনোনীত করা হয়। আইনস্টাইন তাঁর সম্বন্ধে বলেছেন, "জগদীশচন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত।" তাঁর কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯১৭ সালে তিনি নাইটহুড উপাধি লাভ করেন। ১৯২০ সালে রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯২৮ সালে ভিয়েনা একাডেমি অফ সাইন্স -এর সদস্যপদ লাভ করেন।    তাঁকে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক বিজ্ঞানে পরীক্ষামূলক গবেষণার জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। 

জগদীশ চন্দ্র বসু একজন প্রথিতযশা পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী ও ভারতের প্রথম সারির কল্পবিজ্ঞানের রচয়িতা। একজন পদার্থবিদ হয়েও তিনি যেভাবে সমস্ত প্রথাগত ধারণা অস্বীকার করে একজন জীব বিজ্ঞানী হিসেবে বিশ্বের দরবারে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন তা আমাদের বিস্মিত করে। পদার্থবিদ্যার জ্ঞানকে সফল ভাবে প্রয়োগ করেছেন জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা প্রশাখায়। তিনি বিশ্বাস করতেন জীবের মতো উদ্ভিদ জগতও  সমান স্পন্দনশীল। তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন যে, গাছেরও অবসাদ হয়, তীব্র আঘাতে বেদনার অনুভূতি জাগে। তিনি দেখান কিভাবে হাতের তুড়ি দিলেই বনচাঁড়াল গাছ নাচতে শুরু করে। এমন অনেক উদাহরণ সহযোগে তিনি গাছের স্পন্দনশীলতার প্রমান রাখেন।  তবে আচার্যকে বেশি মুগ্ধ করেছিল লজ্জাবতী লতা। এই লতার পাতা ও কান্ডের মধ্য দিয়ে উত্তেজনা বা স্পন্দনশীলতা বিভিন্ন ভাবে পরিবাহিত হয়। তাঁর নিজের তৈরি 'ক্রেসকোগ্রাফ' নামক যন্ত্রের সাহায্যে তিনি দেখান টিনের একটি টুকরো, গাছের ডগা এবং ব্যাঙের পেশি সবই বাইরের  উত্তেজনায় সমভাবে স্পন্দিত হয়। এছাড়াও এই যন্ত্রের দ্বারা গাছের বৃদ্ধিও নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা যায়। এরই পাশাপাশি তাঁর আবিস্কৃত 'রেসোনেন্ট রেকর্ডার' যন্ত্রের সাহায্যে তিনি উদ্ভিদের উত্তেজনার তীব্রতা ও চেতনাশক্তিকে ধরতে সমর্থ হন। তাই তিনি বলে ওঠেন; "ঘর হইতে বাহির হইলেই চারিদিক ব্যাপিয়া জীবনের উল্লাস দেখিতে পাই। সেই জীবন একেবারে নিঃশব্দ। শীত ও গ্রীষ্ম, মলয়, সমীর ও ঝটিকা, বৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি, আলো ও আঁধার এই নির্বাক জীবন লইয়া ক্রীড়া করিতেছে।...কি প্রকারে এই অপ্রকাশকে সুপ্রকাশ করিব?" এ যেন এক অনবদ্য অনুভবের অনুপম উন্মেষ! পরিশেষে মনে পড়ে জগদীশচন্দ্রের সেই অমর উক্তি যা আজও মানসপটে ভেসে ওঠে, 'নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? ...মহাদেবের জটা হইতে।' একইভাবে তাঁর সম্বন্ধে বলা যায়, 'আধুনিক বিজ্ঞান তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ? ...বিজ্ঞানাচার্য জগদীশচন্দ্রের হাত ধরে।' সেই জ্ঞানতাপস ১৯৩৭ সালের ২৩শে নভেম্বর ঝাড়খন্ডের গিরিডিতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

ডঃ নিশীথ কুমার দাশ
বিজ্ঞানী ও প্রাবন্ধিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.