কুড়ি ত্রিশ বছর আগেও ভারতের প্রায় সব বেসরকারি হাসপাতালের শীর্ষে থাকতেন চিকিৎসকেরা। আমাদের দেশ তখন বর্তমানের চেয়েও বেশী গরীব দেশ ছিল। কিন্তু চিকিৎসকেরা সাধারণ মানুষের কাছে যথেষ্ট সম্মান পেতেন। অনেকসময়ই মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে হাসপাতালের বিল কমিয়ে দেওয়া হত।
তারপর গত দুতিন দশক ধরে স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের বিনিয়োগকারী ব্যবসায়ীরা বুঝতে পারলেন চিকিৎসকদের দিয়ে সত্যিকারের ব্যবসা হবে না। MBA, MHA(masters in hospital administration) এই সব কোর্স জনপ্রিয়তা পেল। এবং মানুষের জীবন ও যন্ত্রণা সম্বন্ধে কোনও ধারণা না থাকা এনাদেরকে ম্যানেজার করে হাসপাতালের সবার মাথার উপরে বসিয়ে দেওয়া হল।
অনেকক্ষেত্রে এই সব MBA, MHA কোর্স এমনকি ডিস্টান্স বা অনলাইন মোডেও করা যায়। কোনও রোগী, হাসপাতাল বা চিকিৎসকের সাথে সময় কাটানোর প্রয়োজন হয়না। এটা অনেকটা বই পড়ে সাইকেল চালানো শেখার মতো।
এইসব MBA, MHA রা অধিকাংশই চিকিৎসক নন। চিকিৎসকদের মত তাঁদের ষোলো-সতেরো ঘণ্টা করে রোজ পড়াশুনো করতে হয়না। টানা ৩৬ ঘণ্টা থেকে ৪৮ ঘণ্টা ডিউটি করতে হয়না। রোগী বা তাঁর আত্মীয়দের সাথে তাঁদের কোনও রকম আত্মিক যোগাযোগ হয়না।
অসহায় রোগীর আত্মীয়দের চোখের দিকে তাকিয়ে তাঁরা তাই তাঁরা ইতস্তত না করেই বলতে পারেন, ‘তোমার রোগীকে বাঁচাতে হলে আরও টাকার জোগাড় কর।’ তাঁরা শুধু সংখ্যা চেনেন। আর জানেন কিভাবে হাসপাতালের লাভ হবে।
চিকিৎসা শাস্ত্রে শুধু মানুষের জীবন বাঁচানোর পদ্ধতিই শেখানো হয়। চিকিৎসকরা অন্তত ডাক্তারি পড়ার সময় ব্যবসা শেখেন না। অন্যদিকে এই ‘ম্যানেজার’রা তাঁদের সম্পূর্ণ কোর্সে শুধু সংখ্যা আর লাভ করার উপায় গুলিই শেখেন। সেখানে মানবিকতার কোনও স্থান নেই।
ব্রিটিশরা আমাদের দেশে প্রথমে ব্যবসা করতেই এসেছিলো। কিন্তু আস্তে আস্তে তারা পুরো ভারতবর্ষ দখল করেছিল। ম্যানেজাররাও প্রায় তাই করেছেন। ব্রিটিশরা যেভাবে ভারতীয় রাজাদের উপর নানা রকম নিয়মকানুন, ট্যাক্স চালু করেছিল, তাঁদের স্বাধীনতা খর্ব করেছিল; তেমনই ম্যানেজাররাও চিকিৎসকদের উপর নানারকম নিয়ম কানুন চাপিয়ে তাঁদের বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পরাধীন দাস বানিয়ে ছেড়েছেন।
প্রথমে সাধারণ চিকিৎসকদের টার্গেট করা হয়েছে। বেশিরভাগ চিকিৎসকেরাই শান্তশিষ্ট, ভদ্র। তাঁরা সাধারণত নিজের ডিউটির বাইরে অন্য কিছুতে মাথা ঘামাতে চান না। স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা খুব দ্রুত এটা বুঝতে পেরেছেন। পরে নামকরা চিকিৎসকেরাও ছাড় পাননি। আগে হাসপাতালে চিকিৎসকদের স্যার বা ম্যাডাম বলে ডাকা হত। কিন্তু এসমস্ত ম্যানেজাররা অনেকক্ষেত্রেই সরাসরি চিকিৎসকের নাম ধরে ডাকেন। ভাগ্য খুব ভাল হলে সঙ্গে ডাক্তার লাগান। বারবার তাঁদের মনে করিয়ে দেওয়া হয় হাসপাতালে বাকি পাঁচজনের মত তাঁরাও একজন কর্মচারী।
আস্তে আস্তে এটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। সব কিছুই সকলে মেনে নিয়েছে। এমনকি কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকরা এটাও মেনে নিয়েছেন, যে হাসপাতালে তাঁরা কাজ করেন, সেখানেও পার্কিং এরিয়ায় গাড়ি পার্ক করা জন্য তাঁদের পার্কিং চার্জ দিতে হবে।
চিকিৎসকদের অহরহ শুনতে হয়, ‘ কে আপনাকে রোগীকে ছাড় দিতে বলেছে?’
‘ঠিক আছে, আমরা রোগীকে সাহায্য করার জন্য আপনার প্রতিদিনের ১০০০টাকা ফি বাদ দিয়ে দেব। কিন্তু আপনার রোগীকে বাকি দুলক্ষ টাকা দিতে হবে। নাহলে আপনার পরবর্তী ছয় মাসের মাইনে থেকে আমরা সেই টাকা কেটে নেব।’
আর সবচেয়ে অপমান কর কথা, ‘ ডাক্তার, আপনি কিন্তু শেষ তিনমাসের টার্গেট পূরণ করতে পারেননি।’ অর্থাৎ আপনি গভীর বিপদের মধ্যে আছেন।
এই বিপদের সাথে রোগীর প্রতি গাফিলতির কোনও যোগাযোগ নেই। চিকিৎসকের মেধার সাথে কোনও যোগাযোগ নেই। এই বিপদ শুধু হাসপাতালের তহবিলে উপযুক্ত অর্থ তুলে না দিতে পারার জন্য।
এবং আদর্শবাদী ও রোগী-দরদী চিকিৎসকেরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই বিপদের সম্মুখীন হন। বাকি চিকিৎসকেরা আস্তে আস্তে অভিযোজন ঘটিয়ে নিজেদের কর্পোরেটের হাতে টাকা তুলে দেওয়ার মেশিনে পরিণত করেন। এবং তারাই এ ই সমস্ত MBA, MHA দের প্রিয় পাত্র হয়ে ওঠেন ও বিপদ সীমার বাইরে থাকেন।
প্রায় সব চিকিৎসকই পেশার শুরুতে অনেক আদর্শ নিয়ে কাজ করেন। কিন্তু আস্তে আস্তে সরকারি নিয়ম কানুন, সামাজিক নিয়ম কানুন, এবং বেসরকারি হাসপাতালের ম্যানেজারদের নিয়ম কানুন তাঁদের চামড়া মোটা করে দেয়। যারা মেরুদণ্ড সোজা রাখেন, তাঁরা এই ব্যবস্থার অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হন।
সময় এসেছে চিকিৎসক সমাজের গর্জে ওঠার। জোর গলায় বলার, কোনও MBA, MHA নয়, এমনকি আই এস অফিসারও নয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নেতৃত্ব দেবে শুধু চিকিৎসকেরাই। চিকিৎসকদের দেখতে হবে স্বাস্থ্য ব্যবসা অন্য আর পাঁচটা ব্যবসার মতো গলা কাটা ব্যবসা যাতে না হয়ে ওঠে।
সংবাদ পত্র খুললেই এখন বিভিন্ন সুসজ্জিত নার্সিং হোমের কুৎসিত বিজ্ঞাপন। শহরের মুখ ঢেকে গেছে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের বিজ্ঞাপনে। অথচ ত্রিশ বছর আগেও যখন বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চিকিৎসকদের হাতে ছিল, তখন এভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়াটাকে ঘৃণার চোখে দেখা হত।
সকলেরই ভাবার সময় এসেছে শিক্ষা স্বাস্থ্যের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কেন এভাবে ব্যবসা চলবে। সময় এসেছে এসেছে এই সব ম্যানেজারদের অন্য কাজ খুঁজে নিতে বলার। নাহলে রোগী এবং চিকিৎসক উভয়ের দুর্ভোগ বাড়বে।
একজন হতভাগ্য ভারতীয় চিকিৎসক।