চৈতালী চক্রবর্তী
চাঁদের দক্ষিণ মেরুতেই ল্যান্ড করেছে বিক্রম, এটা নিশ্চিত করেছে ইসরো। বিক্রমের শরীরের ভিতর রোভার প্রজ্ঞান রয়েছে এতেও কোনও ভুল নেই। এখন দক্ষিণ মেরুর ঠিক কোথায় বিক্রম ল্যান্ড করেছে বা সে অক্ষত অবস্থায় রয়েছে কি না, সেই বিষয়ে কোনও রকম তথ্য ইসরোর তরফে জানানো হয়নি। শুধু বলা হয়েছে, চাঁদের দক্ষিণ পিঠে ‘হার্ড ল্যান্ড’ (Hard Landing) করেছে বিক্রম। চন্দ্রযান ২-এর অরবিটারে তোলা তাপচিত্র বা থার্মাল ইমেজে (Thermal Image) দক্ষিণ মেরুর একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ধাতব বস্তুর খোঁজ মিলেছে, যার থেকেই অনুমান করা হচ্ছে বিক্রম সেখানে থাকলেও থাকতে পারে। বিক্রমের অ্যান্টেনার সঙ্গে রেডিও যোগাযোগের চেষ্টা চালাচ্ছে অরবিটার।
সন্দীপ চক্রবর্তী
গত ১০ তারিখে ইসরোর অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেলে ফের পোস্ট করে বলা হয়েছে, ক্রমাগত অরবিটার থেকে সিগন্যাল পাঠিয়ে জাগানোর চেষ্টা চলছে বিক্রমকে। তবে এখনও অবধি সেই ডাকে সাড়া দেয়নি বিক্রম। কেন বার্তা পাঠানোর ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল বিক্রম? ৬ সেপ্টেম্বর রাতে ঠিক কী ঘটেছিল? বর্তমানেই বা বিক্রমের অবস্থা ঠিক কী হতে পারে, তার সম্ভাব্য একটা ধারণা দ্য ওয়ালকে দিলেন কলকাতার ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্সের ডিরেক্টর, বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী। ডায়াগ্রাম এঁকে তিনি বোঝালেন ৬ সেপ্টেম্বর রাত ১টা ৫৩ মিনিটের আগে ও পরে ঠিক কী কী ঘটে থাকতে পারে।
“ইসরো সরাসরি না বললেও তার টুইটের মধ্যেই অনেক রহস্য লুকিয়ে রয়েছে। তিনটে শব্দ ইসরো ব্যবহার করেছে, ‘হার্ড ল্যান্ডিং,’’থার্মাল ইমেজ’এবং ‘যোগাযোগের চেষ্টা, ”সন্দীপ বাবুর কথায়, প্রথমত, হার্ড ল্যান্ড মানেই ক্র্যাশ ল্যান্ড করেছে বিক্রম। দ্বিতীয়ত, ইসরো একবারও দাবি করেনি বিক্রমকে খুঁজে পাওয়া গেছে। বরং বলা হয়েছে থার্মাল ইমেজে তার সম্ভাব্য অবস্থানের আন্দাজ পাওয়া গেছে। আর তৃতীয়ত, যোগাযোগের চেষ্টা তখনই হয়, যখন কোনও যানের নিজস্ব অ্যান্টেনা তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এখন দেখতে হবে কতটা প্রতিকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যাতে লক্ষ্যের মুখে গিয়েও লক্ষ্যচ্যুত হতে হয়েছে বিক্রমকে।
প্রথমে সোজা পথে (Horizontal), পরে মুখ ঘুরিয়ে (Vertical) নামার কথা ছিল, হয়েছে ঠিক তার উল্টো..
চাঁদের চারপাশে উপবৃত্তাকার কক্ষপথ ধরে ঘুরতে ঘুরতে দূরত্ব কমিয়েছিল বিক্রম। পৌঁছেছিল চাঁদের একদম কাছাকাছি। ৬ সেপ্টেম্বর রাতে অবতরণের প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর, ৩৫*১০১ কিলোমিটার কক্ষপথ ধরে সোজা চাঁদের মাটিতে নেমে আসার কথা ছিল ল্যান্ডার বিক্রমের। এই ৩৫ কিলোমিটার দূরত্ব পার করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোগ্রামিং ল্যান্ডারের মধ্যে করে রেখেছিলেন বিজ্ঞানীরা। সোজা নামতে নামতে শেষ ৫ কিলোমিটারে মুখ ৯০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে (Vertical) চাঁদের পিঠে নামার কথা ছিল বিক্রমের। এই পর্যায়ে গতি এমন ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার কথা যাতে ভার্টিকালি ঘুরে গিয়ে পালকের মতো চাঁদের মাটিতে নামতে পারে ল্যান্ডার। যাকে বলে সফট ল্যান্ডিং (Soft Landing)। এই ৯০ ডিগ্রি রোটেশন হয়নি। বরং ২.১ কিলোমিটার থেকে পুরোপুরি উল্টে গিয়ে সজোরে চাঁদের মাটিতে ধাক্কা খেয়েছে সে।
সফট ল্যান্ডিং-এর আগে ঠিক কী কী হয়েছিল, রেখাচিত্র এঁকে বুঝিয়েছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তী
ওলটপালট হয়ে গেছে সেন্ট্রাল থ্রাস্টার (Central Thruster), তাই ডিগবাজি খেয়ে উল্টে গেছে বিক্রম
বিক্রমের চার পাশে চারটি থ্রাস্টার ঠিক ভাবে কাজ করতে পারেনি সেটাও একটা বড় কারণ। গণ্ডগোল হয় মাঝের অর্থাৎ সেন্ট্রাল থ্রাস্টার চালু করার সময়তেও। গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল তারই। ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে ল্যান্ডারকে চাঁদের মাটিতে পৌঁছে দেওয়া। প্রোগ্রামিং ছিল ঠিক এই ভাবে—৩৫ কিলোমিটার উচ্চতায় ৫৬০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগ নিয়ে বিক্রম নামতে শুরু করে। শেষ সাড়ে সাত কিলোমিটারে তার বেগ হওয়া উচিত ছিল ৫৫০ কিলোমিটার/ঘণ্টা। ক্রমশ কমতে কমতে ৫ কিলোমিটারে এসে প্রায় ১০০ কিলোমিটার/ঘণ্টা। আর ঠিক যে দূরত্ব থেকে বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়েছে সেই ২.১ কিলোমিটারে এসে গতি অনেকটা কমে হওয়া উচিত ছিল ১ মিটার/সেকেন্ডেরও কম অর্থাৎ ঘণ্টায় ৩.৬ কিলোমিটারের কম। সেটা হয়নি। দেখা গেছে, হরাইজন্টালে তার বেগ ছিল ৪৯ মিটার/সেকেন্ড এবং ভার্টিকালি ৫৯ মিটার/সেকেন্ড।
কেন? জ্যোতির্বিজ্ঞানী সন্দীপ চক্রবর্তীর কথায়, ওই শেষ ৫ কিলোমিটারে এসে কোনও ভাবে ল্যান্ডারের সেন্ট্রাল থ্রাস্টারে ‘টর্ক’(Torque) তৈরি হয়। সোজা ভাষায় যন্ত্রে এমন গোল বাঁধে যে ব্রেক কষার বদলে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে আরও জোরে ছুটতে শুরু করে। ফলে ওলটপালট হয়ে যায় ভিতরের সব কলকব্জা। ৯০ ডিগ্রি ঘোরার বদলে, মাথা পুরোপুরি উল্টে সজোরে গোঁত্তা খায় সে। সন্দীপ বাবুর কথায়, আরও একটা সমস্যা দেখা দেয় ল্যান্ডারের জ্বালানীতে। থ্রাস্ট্রারগুলোর ফাংশন ফেল করার ফলে, ভিতরে জ্বালানী বা Fuel Distribution ঠিকঠাক ভাবে হয়নি। কোনও কারণে জ্বালানী লিক করতেও শুরু করে। যার কারণে শুধু থ্রাস্টার নয়, ল্যান্ডারের ভিতরের বাকি কলকব্জাও বিকল হতে শুরু করে।
বিজ্ঞানীর কথায়, “বাগানে হোস পাইপে জল দেওয়ার সময় ট্যাপ কল যদি আচমকাই সজোরে খুলে দেওয়া হয়, তাহলে জলের তোড়ে পাইপ এলোপাথাড়ি দৌড়োদৌড়ি শুরু করে। গতিবিদ্যার ভাষায় একে বলে Hose Pipe Indtability। ঠিক এমনই কিছু হয়েছে বিক্রমের সঙ্গেও। থ্রাস্টার বিকল হওয়ায় গতি কমার বদলে আচমকা বেড়ে গিয়ে তার সিস্টেম প্রোগ্রামিং নষ্ট হয়ে যায়। যার কারণেই এই হার্ড ল্যান্ডিং বা Crash Landing।”
উল্টে গেছে অ্যান্টেনা, তাই সিগন্যাল মিলছে না?
রোডিও যোগাযোগ তৈরির জন্য একটি অ্যান্টেনা বিক্রমের মাথায় বসানো ছিল উল্টানো গামলার মতো। যাতে সে কাজ করতে পারে ১৮০ ডিগ্রি ব্যাসার্ধে ঘুরে ঘুরে (1800 Open Antenna)। অর্থাৎ অরবিটার যে প্রান্তেই থাকুক না কেন (মাথার উপরে হোক বা পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে)তার সঙ্গে ঠিক যোগাযোগ তৈরি হয়। এই থ্রাস্ট্রারে গণ্ডগোলের কারণে বিক্রমের মাথা উল্টে যাওয়ায় অ্যান্টেনার মুখও ঘুরে যায়। ফলে অরবিটারের সঙ্গে তার আর বার্তা আদানপ্রদান হয়ে ওঠে না। সন্দীপ বাবুর মতে, বিক্রমের চারটে পা যদি খাড়া থাকত তাহলে এই সিগন্যাল পাঠানো সম্ভব হত। হয়নি, তার একটাই কারণ দুরন্ত গতিতে ছুটে গিয়ে গোঁত্তা খেয়ে এই অ্যান্টেনার দিক বদলে গেছে বা চাঁদের মাটিতে সেটা গেঁথে গেছে।
বেঙ্গালুরুর বিয়ালালুতে ইসরোর ৩২ মিটারের ডিপ স্পেস নেটওয়ার্ক অ্যান্টেনা থেকে ক্রমাগত সিগন্যাল পাঠানো হচ্ছে বিক্রমকে। অন্যদিকে, নাসার জেট প্রোপালসন ল্যাবোরেটরির (JPL-Jet Propulsion Laboratory) ৭০ মিটারের অ্যান্টেনা থেকেও রেডিও যোগাযোগের চেষ্টা চলছে। তবে সব আশাই ব্যর্থ হচ্ছে।
ল্যান্ডারের প্রচণ্ড গতি চাঁদের ধুলোকে (Lunar Dust) তাতিয়ে দেয়, থার্মাল ইমেজে ধরা দিয়েছে সেটাই
সন্দীপ বাবু জানিয়েছেন, আগে মনে করা হচ্ছিল চাঁদের ধুলো বা রেগোলিথ বিক্রমের ট্রান্সমিটারকে বিকল করে দিয়েছে। তবে আমার ধারণা, বিক্রমের ক্র্যাশ ল্যান্ডিং-এর কারণে চাঁদের বুকে গর্ত তৈরি হয়েছে। প্রচণ্ড বেগে অবতরণের ফলে চারপাশের মাটি তেতে জ্বলে-পুড়ে গেছে। থার্মাল ইমেজে সেটাই ধরা পড়েছে।
“অরবিটার এখন রয়েছে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে। এর হাইট-রেজোলিউশন ০.৩ মিটার মানে ১ ফুট। এই উচ্চতা থেকে ১ ফুট/১ ফুট হিসেবে ৯টি পিক্সেল তৈরি হবে। যার মধ্যে অন্তত ৩টি পিক্সেল জ্বলে কালো দেখাবে, বাকিগুলো ধূসর দেখাবে। বিক্রমের হার্ড ল্যান্ডিং-এর ফলে মাটি এতটাই তেতে গেছে, যে তাপচিত্র বা থার্মাল ইমেজে সেটাই ধরা পড়েছে।” আর যদি বিক্রমে ভেঙেচুরে গিয়ে থাকে, তাহলে এই পিক্সেলগুলোও টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে। একটা বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে জ্বলে-পুড়ে যাওয়া ছবি অরবিটারের তাপচিত্রে ধরা দেবে। এখন সেটা জানার জন্য অরবিটারের পরবর্তী ছবির জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
ছবি সৌজন্যে: সন্দীপ চক্রবর্তী ও ইসরো
দ্য ওয়াল