কাজে বিরাম নেই চন্দ্রযানের অরবিটারের। দক্ষিণ মেরুর উপর দিয়ে ২৯ দিনে একবার টানা ৬ দিন ধরে পাক খাওয়ার এই সময়কালে একের পর এক চমক দিয়ে যাচ্ছে সে। চাঁদের ধুলো রেগোলিথের (Regolith) হাল-হকিকত আগেই ব্যাখ্যা করেছে অরবিটার। এ বার তার হাই রেজোলিউশন ক্যামেরায় (Orbiter High Resolution Camera -OHRC) ধরা দিয়েছে দক্ষিণ মেরুর ‘ বোগুলস্কি ই-ক্রেটার’ (Boguslawsky E-Crater)। ১৪ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ এবং ৩ কিলোমিটার গভীর এই গহ্বর এতদিন চাঁদের দক্ষিণ পিঠের আঁধারেই ঢাকা ছিল। ইসরো জানিয়েছে, নিঃসন্দেহে ভারতের চন্দ্রযাত্রার অন্যতম বড় সাফল্য অরবিটারের এই পর্যবেক্ষণ।
চাঁদের কক্ষপথে (Lunar Orbit) পাক খাচ্ছে চন্দ্রযানের অরবিটার। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে তার হাই রেজোলিউশন ক্যামেরার স্পেশাল জুমিং (Zooming) রেজোলিউশন দিয়ে ২৫ সেন্টিমিটার দূরত্ব থেকে এই ক্রেটার বা গহ্বরের ছবি তোলা হয়েছে। ইসরো জানিয়েছে অরবিটারের আটটি পে-লোডের মধ্যে লার্জ এরিয়া সফট এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (CLASS) এবং OHRC সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। স্পেকট্রোমিটার যখন চাঁদের ধূলিকণায় খনিজের সন্ধান চালাচ্ছে, হাই রেজোলিউশন ক্যামেরা তখন ফটাফট ক্রেটার বা গহ্বরের ছবি লেন্সবন্দি করছে।
শনিবার ভারতীয় সময় ভোর সাড়ে ৪টে নাগাদ ই-ক্রেটারকে লেন্সবন্দি করে অরবিটারের ক্যামেরা। জার্মান জ্যোতির্বিদ প্যালন এইচ লুডউইগ ভন বোগুলস্কির নামেই এই ক্রেটারের নাম। এরই পাশে ৫ মিটার ব্যাসার্ধের আরও দুটি ছোট গহ্বরের ছবিও তুলেছে ওএইচআরএইচ। “ইসরোর বড় সাফল্য,’ টুইট করে সাধুবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
চাঁদের দক্ষিণ পিঠের খানা-খন্দ, গহ্বর–নিখুঁত ছবি তুলে পাঠাল অরবিটার
অরবিটারের হাই রেজোলিউশন ক্যামেরার মতোই দুরন্ত গতিতে কাজ করে চলেছে অরবিটারের লার্জ এরিয়া সফট এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (CLASS) । এরই মধ্যে দক্ষিণ মেরুর আনাচেকানাচে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে সে। অরবিটারের ডেটা বলছে, বিক্রমের ট্রান্সমিটার অকেজো। অ্যান্টেনা রেডিও সংযোগের ক্ষমতা হারিয়েছে। সোলার প্যানেলকে অ্যাকটিভ করার উপায় নেই, কারণ সূর্যের আলো এখন সরাসরি চাঁদের দক্ষিণ পিঠে পড়ছে না। কাজেই বিক্রম আর রোভারের কাজের বেশ কিছুটা করতে হয়েছে অরবিটারকেই। তার স্পেকট্রোমিটার চাঁদের মাটিতে খনিজের সন্ধান তো পেয়েছেই, তাদের মধ্যে চার্জড পার্টিকলের(প্রোটন-ইলেকট্রন) নিরন্তর বদলও লক্ষ্য করেছে।
অরবিটারের লার্জ এরিয়া সফট এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার (CLASS) দেখেছে, দক্ষিণ পিঠে চাঁদের ধুলো (Lunar Dust) বা রেগোলিথের (Regolith) মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সোডিয়াম, ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকন, টাইটানিয়াম এবং আয়রনের মতো খনিজ মৌল। তাদের অণু-পরমাণুর মধ্যে নিরন্তর ধাক্কাধাক্কি, মারামারি চলছে। উত্তেজিত হয়ে উঠছে ইলেকট্রনেরা। এক্স-রে স্পেকট্রোমিটারের চোখে ধরা পড়েছে, এই ইলেট্রনেরা এতটাই উত্তেজিত, যেন মনে হচ্ছে তারা নেচে নেচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আরও একটা আশ্চর্যের বিষয় হল, এই রেগোলিথের মধ্যেই মেটাল অবজেক্ট (Metal Object) বা ধাতব বস্তুরও চিহ্ন রয়েছে। যার থেকেই অনুমান করা যায় ল্যান্ডার বিক্রম এই এলাকাতেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে রয়েছে।
ইসরোর বিজ্ঞানীরা বলেছেন, মহাজাগতিক রশ্মির বিকিরণে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে চাঁদের ধুলো রেগোলিথ। সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মি বা অন্য কোনও মহাজাগতিক রশ্মি চাঁদের মাটিতে সরাসরি আছড়ে পড়ার সময় এই সূক্ষাতিসূক্ষ ধূলিকণাগুলিকে আঘাত করে। ফলে এগুলির মধ্যে বিদ্যুৎ তরঙ্গ তৈরি হয়। গরম হলে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরার জন্য ধূলিকণাগুলো তড়িৎ ঋণাত্মক কণা বা ইলেকট্রন ছাড়তে থাকে। তাপমাত্রার ফারাক এবং মহাজাগতিক রশ্মির প্রভাবে বিরাট এলাকা জুড়ে ধুলোর ঝড় শুরু হয়। এই ধুলোর ইলেকট্রোস্ট্যাটিক ফোর্স চুম্বকীয় স্তর (Magnetic Field) তৈরি করে। চন্দ্রযানের ল্যান্ডার বিক্রম এখন এই স্তরের মধ্যে আটকে রয়েছে।