ভারতের চন্দ্রযান মিশনের কথা প্রথম ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। ২০০৩ সালে দিল্লীর লালকেলা থেকে স্বাধীনতা দিবসের ভাষণ দেবার সময় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন যে ভারত চাঁদে যান পাঠাবে। বাজপেয়ীজী এই ঘোষণা করার পর স্বাভাবিক ভাবেই দেশবাসী চন্দ্রাভিযানের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দেন। কিন্তু ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সরকারের পতন ঘটে ঠিকই তবে ২০০৮ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং তখন চাঁদে যান পাঠানোর মিশন বাস্তবায়িত হয়েছিল। তবে চন্দ্রযান-১ মিশন ছিল অরবিটাল অর্থাৎ চাঁদের কক্ষপথে একটি স্যাটেলাইটকে প্রতিস্থাপন করা। ল্যান্ডিং-এর কথা তখনও চিন্তা করা হয়নি। আমি আগেই লিখেছি যে অরবিটাল মিশন এবং ল্যান্ডিং মিশনের মধ্যে ফারাক রয়েছে বিস্তর। কারণ সফট ল্যান্ডিং করাটা খুব উন্নতমানের প্রযুক্তি ছাড়া সম্ভব নয়। কারণ একটি খুব দ্রুতগতি সম্পন্ন মহাকাশ যানের গতি বাড়ানোর চাইতে গতি কমানো বেশি কঠিন কাজ। আর গতি না কমাতে পারলে ল্যান্ডিং সম্ভব নয়। তাই ইসরোর প্রথম মিশনে ল্যান্ডিঙের কথা ভাবা হয়নি।

১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের মিটিঙে প্রথম চাঁদে যান পাঠানো নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। এরপর অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি অব ইন্ডিয়া ২০০০ সালে এই মিশন নিয়ে আলোচনা করে। এর পরই ইসরোর কর্মকর্তারা ন্যাশনাল লুনার মিশন টাস্ক ফোর্স গঠন করে চন্দ্রাভিযানের বিষয়ে চিন্তাচর্চা শুরু করে দেন। তাদের দেওয়া আশ্বাস থেকে ২০০৩ সালে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী ইসরোর চন্দ্রাভিযানের কথা দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করেন।

চন্দ্র পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ যার পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ করতে ২৭.৩ পার্থিব দিন সময় লাগে। আবার একটি অমাবস্যা থেকে আরেকটি অমাবস্যা আসতে ২৯.৫ পার্থিব দিন সময় লাগে। পার্থিব দিন বললাম কারণ চাঁদের একদিন আর পৃথিবীর এক দিন সমান নয়। চাঁদ পৃথিবীকে যে সময়ে একবার প্রদক্ষিণ করে এই একই সময়ে নিজের অক্ষের অপর একবার আবর্তন করে। এই কারণে আমরা সব সময়ে চাঁদের একটা দিকই দেখি। এখানে আমি উপমা দিয়ে জিনিসটাকে বুঝাতে চাই। মনে করা যাক একটি নাগরদোলা যখন ঘুরছে তখন তার মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। এই নাগরদোলায় একটা লোক বসে আছে এবং সে উপর নীচে ঘুরছে। আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে একবার লোকটির সামনের দিক দেখতে পাবো আর একবার পেছনের দিক। কারণ লোকটার মধ্যে কোন আবর্তন হচ্ছে না। আবর্তন না হওয়ার কারণে লোকটির মুখ সব সময় একই দিকে থাকছে। তাই লোকটি যখন আমাকে প্রদক্ষিণ করবে তখন আমি পালা করে একবার তার সামনের দিক এবং একবার তার পেছনের দিক দেখতে পাবো। এখন আমি যদি একটি মেরি-গো-রাউন্ডের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াই যেখানে বাচ্চারা ঘোড়ায় চড়ছে সেখানে কিন্তু এদের আমাকে এই প্রদক্ষিণের সময়ে আমি শুধুমাত্র তাদের একটা দিকই দেখতে পাবো। কারণ এখানে এই বাচ্চাদের একবার প্রদক্ষিণের সময় তাদের নিজেদের মধ্যে একবার আবর্তন হয়ে যায়। নাগরদোলায় ঘোরার সময়ে যেমন একটা লোকের দৃষ্টি সব সময়ে একদিকে থাকে এবং এই লোকটা তার পেছন দিকে কি আছে তা দেখতে পায় না কিন্তু মেরি-গো-রাউন্ডে একটা বাচ্চা ঘোরার সময়ে সে তার চারদিকে কি আছে তা দেখতে পায়। তার মানে তার নিজের মধ্যে একটা আবর্তন হয়। তাই চন্দ্রের পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিণ ও নিজের অক্ষের ওপর আবর্তন একই দিকে একই সময়কালে একবার করে হয়ে থাকার কারণে আমরা চাঁদের একটা দিকই সব সময়ে দেখতে পাই। চাঁদের অপর পিঠ আমরা কোন সময় দেখতে পাই না। পৃথিবীতে যখন অমাবস্যা তখন চাঁদের উলটো পিঠে সূর্যের আলো থাকে।

পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব ১,৮৪,৪০০ কিলোমিটার। খুব দ্রুতগতি সম্পন্ন একটি যানের পৃথিবী থেকে চাঁদে পৌঁছাতে চার-পাঁচ দিন সময় লাগার কথা। কিন্তু ভারতীয় মহাকাশ যানের সময় লাগে বেশি কারণ এখানে ইন্ধন বাঁচানোর জন্য অন্য প্রযুক্তির ব্যবহার করে অর্থের সাশ্রয় করা হয়। কম খরচে পৌঁছাতে একটু বেশি সময় লাগলেও পৌঁছানো তো যায়। ধনী ব্যক্তি প্লেনে করে তাড়াতাড়ি পৌঁছান আর গরিব ব্যক্তি ট্রেনে করে দেরিতে পৌঁছান। কিন্তু গন্তব্য তো দুজনেরই এক। এই কম খরচে পৌঁছানোর পদ্ধতিকে বলা হয় স্লিং শটিং পদ্ধতি যা নিয়ে আমি আগে লিখেছি। এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ বলের সাহায্যে আবর্তন ও প্রদক্ষিণ গতিকে কাজে লাগিয়ে মহাকাশ যানের গতি বৃদ্ধি করে তাকে তার ঈপ্সিত লক্ষ্যের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হয়। এতে খরচ বাঁচে এবং পৌঁছায় ঠিকই।

চন্দ্রযান-১ যানটি শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস স্টেশন থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর তারিখে। এই যানটি চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে ওই বছরের ৮ নভেম্বর তারিখে। অর্থাৎ চাঁদে পৌছাতে প্রায় ১৬ দিন সময় লেগেছে। তাহলে এবারে চন্দ্রযান-৩ এর কেন বেশি সময় লাগছে। বলতে গেলে চাঁদের কক্ষপথে এবারেও একই সময়ে পৌঁছেছে তবে সময় লাগছে চাঁদের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে গতি কমাতে। চন্দ্রযান-১ চাঁদের ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় থেকে সেখানের ম্যাপিং সহ অন্য কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিল। বিশেষত চাঁদের রাসায়নিক এবং গর্ভস্থিত খনিজ পদার্থে খোঁজ করাটাও এর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। এই যানের মধ্যে ১১টি বিশেষ ধরণের যন্ত্র ছিল যার কয়েকটি ভারতে নির্মিত হয়েছে এবং বাকিগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও বুলগেরিয়াতে তৈরি করা হয়েছিল। এই যন্ত্রগুলো দিয়ে ম্যাপিং করে ইসরোই প্রথমে চাঁদের মাটিতে জলের সন্ধান পেয়েছিল। ২০০৯ সালের মে মাস পর্যন্ত যানটি ১০০ কিলোমিটার উচ্চতায় থেকে চাঁদকে নিরীক্ষণ করেছে। এরপর যানটিকে ২০০ কিলোমিটার উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং এই উচ্চতায় থেকে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে ফটো পাঠাতে থাকে। ২০০৯ সালের ২৯ আগস্ট তারিখে যানটির সঙ্গে ইসরোর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। পরে যানটি চাঁদের মাটিতে গিয়ে আছড়ে পড়ে। যখন আছড়ে পড়েছিল তখন ভারতে কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় ছিল তাই আছড়ে পড়া স্থানটিকে জহর পয়েন্ট নাম দেওয়া হয়। চন্দ্রযান-১ চাঁদকে মোট ৩৪০০ বার প্রদক্ষিণ করেছে। এই মিশন ছিল পুরোপুরি সফল। তবে ২০১৯ সালের চন্দ্রযান-২ এর মিশন ছিল আংশিক ভাবে সফল। এই নিয়ে পরের পর্বে আলোচনা করব। ধন্যবাদ।

(চলবে)

রজত কান্তি দাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.