Indian Space Research Organization কে সংক্ষেপে বলা হয় ISRO যা বাংলায় আমরা লেখি ইসরো। বলতে দ্বিধা নেই যে ইসরো ভারতের গর্ব। এখন কংগ্রেসের সঙ্গে গাঠবন্ধন হওয়ার পর কেজরিওয়াল সেদিন বলেছেন ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা নাকি জহরলাল নেহরু। অথচ আমরা জানি যে বিক্রম সরাভাই। চাঁদে যে বিশাল বিশাল গর্ত আছে এর প্রত্যেকটার নাম দিয়েছে আন্তর্জাতিক স্পেস সংস্থা। এর মধ্যে একটির নাম বিক্রম কারণ তিনি ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা। অবশ্য আরো কয়েকজন ভারতীয় বিজ্ঞানীর নামে অন্য কিছু গর্তের নামকরণ হয়েছে। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি। জহরলাল নেহরুর প্রতি আমার শ্রদ্ধা রেখেই বলছি যে ইসরোর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৬৯ সালে যখন নেহরু জীবিত ছিলেন না। নেহরুর জীবনাবসান হয়েছিল ১৯৬৪ সালে তাই মৃত অবস্থায় তিনি তো ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা হতে পারেন না। তবে নেহরুর জীবদ্দশায় ১৯৬২ সালে বিক্রম সরাভাইয়ের স্বপ্ন নিয়ে একটি সংস্থার জন্ম হয়েছিল বটে যার কারণে নেহরুর নাম জুড়ে গেছে। কিন্তু নেহরুকে কোথাও ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়নি। অতএব কেজরিওয়ালের বকওয়াজ অবশ্যই রাজনৈতিক কারণে এটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হয় না। দিল্লী সার্ভিস বিল পাশ করানো আটকাতে রাহুল গান্ধীকে খুশি করার কারণে একটু মিথ্যে কথা বলে ফেলেছেন বটে তবে সার্ভিস বিল পাশ হয়ে গেছে। তাই কেজরিওয়ালের মুখ ভরলেও পেট ভরেনি। চাঁদে যে ল্যান্ডারের আজ ল্যান্ড করার কথা এর নাম দেওয়া হয়েছে বিক্রম সরাভাইয়ের নামে। আজ সন্ধ্যে ৬টা নাগাদ বিক্রম যদি সফল ভাবে ল্যান্ড করতে পারে তাহলে আমাদের আনন্দ যে কতটা হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে এর লাইভ টেলিকাস্ট শুরু হবে যার ইন্টারনেট লিঙ্ক আমি আমার পাঠকদের জন্য যথা সময়ে পোস্ট করব। এছাড়া আজই আমি কয়েকটি পোস্ট করব ইসরো সম্পর্কে।

এখন অন্য একটা প্রসঙ্গে আসি। আমরা সব সময়ই ইসরোর কৃতিত্ব বিজ্ঞানীদের দিয়েছি। এর মধ্যে কেউ হয়ত বা বলতে পারেন যে নরেন্দ্র মোদীর কিছুটা কৃতিত্ব আছে কারণ তিনি যোগ্য ব্যক্তিদের হাতে এই দায়িত্ব দিয়েছেন এবং এর কারণে যা কিছু অর্থের প্রয়োজন হয় তা দিতে কার্পণ্য করেননি। এতে গোসা করার বেশি কিছু নেই। রাষ্ট্রনেতাদের যে কৃতিত্ব দেওয়া হয় এটা স্বাভাবিক। যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে এযাবৎ বিজ্ঞানীদের কথাই বলেছি। বালাকোট স্ট্রাইকের পর আমার এক বন্ধু আমাকে ফোন করে বলেছিল মোদীকে কেন সবাই ক্রেডিট দিচ্ছে। এয়ারস্ট্রাইক তো করেছে পাইলটরা। সমস্ত কৃতিত্ব তো তাদের। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম “আচ্ছা তাজমহল কে বানিয়েছে?”। বলল “কেন শাহজাহান বানিয়েছেন, এটা তো সবাই জানে”। আমি বললাম “ও, আমি তো ভেবেছিলাম মিস্ত্রিরা বানিয়েছে”। এখানে এই ক্রেডিট দেওয়ার ব্যাপারে একটা কথা আছে। একজন নেতা সেই কাজই করতে পারেন যা তার দেশের মানুষ করতে সক্ষম। আজ থেকে চার-পাঁচশ বছর আগে সৌদি আরব কিংবা আফগানিস্তানে বসে কেউ তাজমহল বানানোর কথা ভাবতে পারতেন না। কারণ সেখানে এই ধরণের স্ট্রাকচার বানানোর লোক ছিল না, আজো নেই। ভারতে তাজমহল বানানোর হাজার বছর আগে থেকেই বিশাল বিশাল সব স্ট্রাকচার তৈরি হয়ে গিয়েছিল। অত্যাশ্চর্য সব স্ট্রাকচার দেখার পর একজন সম্রাট তাজমহল বানানোর কথা চিন্তা করতে পারেন যখন ওনার হাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকাকড়ি থাকবে। সৌদি আরবে বসে তাজমহল বানানোর কথা কল্পনাতেও আসবে না। তাই বলব যে নরেন্দ্র মোদী যদি চাঁদে ল্যান্ডিঙের কথা চিন্তা করতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে যে এদেশে বিজ্ঞান শিক্ষার একটি ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। এর জন্য নেহরুকে কিছুটা কৃতিত্ব দেওয়া যেতে পারে। আমার তাতে কোন আপত্তি নেই। তবে নেহরুকে ইসরোর প্রতিষ্ঠাতা বললে পরে আমার আপত্তি আছে।

বিগত দশ বছরে ইসরো যে সমস্ত কৃতিত্ব হাসিল করেছে এর মধ্যে রয়েছে মঙ্গলযানকে সফলভাবে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করা। ২০১৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে মঙ্গলযান মঙ্গলগ্রহের কক্ষপথে প্রবেশ করে সেখান থেকে এই গ্রহটির সম্পর্কে নানান তথ্য পাঠাতে থাকে। মঙ্গলযানকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল ৫ নভেম্বর ২০১৩ সালে। অর্থাৎ মঙ্গলযানের উৎক্ষেপণের সময় দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন সিং আর যানটি যখন মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে প্রতিস্থাপন হয়েছে তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এখন কাকে ক্রেডিট দেওয়া হবে। আমার মতে বিজ্ঞানীদের কারণ তারাই এই অসাধ্য সাধন করেছেন। অসাধ্য বললাম এই কারণে যে ইসরোই বিশ্বের একমাত্র সংস্থা যে পৃথিবী থেকে একটি রকেট পাঠিয়ে মঙ্গল গ্রহের কক্ষপথে একটি কৃত্রিম উপগ্রহকে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছে প্রথমবারের চেষ্টায়। এর আগে অন্য কোন সংস্থা প্রথমবারের চেষ্টায় এই কাজে সফল হয়নি। আর মঙ্গল গ্রহে একটি যান পাঠানো যে কতটা দুরূহ কাজ তা বলতে গেলে অনেক কথাই বলতে হয় কারণ এটা মহাকাশ প্রযুক্তিতে খুব বড় মাপের একটি চ্যালেঞ্জ যা নিয়ে ইসরোর বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের চেষ্টায় সফল হয়েছেন।

২০১৭ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে ইসরো আরেকটি অসাধ্য সাধন করেছে যা এর আগে কেউ কল্পনা করতে পারেনি। এখন প্রশ্ন হলো যে কী সেই কাজ যা ইতিহাস রচনা করেছে। এই দিনটিতে ইসরো অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীহরিকোটায় স্থিত সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে ৫১০ কিলোগ্রাম ওজনের একটি কার্টোসেট-২ সিরিজের পোলার স্যাটেলাইটকে সফলভাবে এর কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করেছে। কিন্তু যে রকেটের সাহায্যে এই কাজটি করেছে সেই একই রকেটে করে এই স্যাটেলাইটের সঙ্গে আরো ১০৩টি কৃত্রিম উপগ্রহকে এদের নিজ নিজ কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করে দিয়েছে। অর্থাৎ একই রকেটে করে মোট ১০৪টি স্যাটেলাইটকে এদের কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করে এক নতুন রেকর্ড কায়েম করেছে যা আজ অব্ধি কেউ ভাঙতে পারেনি। কাজেই ইসরোর বিজ্ঞানীদের বলতে হয় ‘হ্যাসটস অফ’। আমিও আমার টুপি খোলে তাদের অভিনন্দন জানাই। তবে এটা জানার পর যদি কোন মোদীভক্ত বলে দেন যে ‘মোদী হ্যাঁয় তো মুমকিন হ্যাঁয়’ তাহলে অন্যদের এত গোসা করার দরকার নেই। তবে আমি এর কৃতিত্ব বিজ্ঞানীদেরই দেই। আর নরেন্দ্র মোদী তার কোন ভাষণে এর কৃতিত্ব নেবার চেষ্টা করেছেন বলে শুনিনি। ১০৪টি উপগ্রহকে একই রকেটে করে প্রত্যেকটির জন্য নির্ধারিত কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করাটা সহজ কাজ তো ছিল না। এই অসম্ভব মিশনের একশ শতাংশ সাফল্যকে এক মাইলস্টোন হিসেবে দেখা যেতে পারে। এতে করে প্রত্যেকটি রকেট পাঠানোর খরচ কমে যায়। এছাড়া রকেট পাঠানোর কাজে যে পরিবেশে দূষণ হয় তাও কমে যায়। অর্থের সাশ্রয় ও পরিবেশ রক্ষার কাজে এই ধরণের মিশন এর এগে রাশিয়া করেছিল বটে তবে এতগুলি স্যাটেলাইটকে এক সঙ্গে পাঠাতে পেরেছে কেবল মাত্র ইসরো। এই সব সাফল্যের অন্য একটি দিক আছে যা হলো বৈদেশিক পুঁজির বিনিয়োগ। কারণ বিদেশী কোম্পানি যখন কোন দেশে বিনিয়োগ করতে যায় তখন দেখে যে উন্নতমানের প্রযুক্তিগত বিনিয়োগ করতে হলে সেই দেশের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের ওপর কতটা নির্ভর করা যেতে পারে। ইসরোর একেকটি সাফল্য এই ক্ষেত্রে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মাতে সাহায্য করে যে এই দেশের বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা সক্ষম। ইসরোর সাফল্য ভারতীয় বিজ্ঞানীদের সক্ষমতাকে প্রচার করে। বিনিয়োগকারীদের ভরসা যোগায়।

২০১৭ সালে একসঙ্গে পাঠানো ১০৪টি স্যাটেলাইটের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল বিদেশের যেগুলিকে কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করতে ইসরো টাকা নিয়েছে। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি স্যাটেলাইট ছিল ভারতের। ইসরো যে খুব বেশি সংখ্যায় স্যাটেলাইট পাঠায় এর বেশির ভাগই বিদেশের। ইসরো টাকা নিয়ে অন্যান্য দেশের স্যাটেলাইটকে কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করে। এর থেকে ইসরো ভালো টাকা আয় করে যা এই প্রতিষ্ঠানটি গবেষণার কাজে ব্যয় করে। বর্তমানে ইসরো বিশ্বের সবচাইতে সস্তায় উপগ্রহকে কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করা সংস্থা। যার কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি প্রাইভেট কোম্পানির ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে কারণ ইসরো সস্তায় এই পরিসেবা দিয়ে তাদের কাস্টমারদের ভাঙিয়ে নিচ্ছে। এই বিষয়টি নিয়ে মার্কিন সেনেটে আলোচনা হয়েছে ২০১৭ সালে ইসরোর ১০৪টি স্যাটেলাইট পাঠানোর পর। এখন এই মার্কিন কোম্পানিগুলো তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে ইসরোতে ফান্ডিং করবে কি না তা তো জানা নেই। তবে ইসরোর এই সস্তায় অন্য দেশের উপগ্রহ পাঠানোর ব্যাপারে এই কোম্পানিগুলো আশঙ্কা ব্যক্ত করেছে। কারণ এতে করে তাদের ব্যবসায় ভাটা পড়েছে। এই নিয়ে আজ আর আলোচনা করছি না। ২০১৭ সালে একটিমাত্র রকেটে করে ১০৪টি উপগ্রহকে সাফল্যের সঙ্গে এদের নিজ নিজ কক্ষপথে প্রতিস্থাপন করে ইসরো যে ইতিহাস গড়েছিল তার পর দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ট্যুইট করে লিখেছিলেন “This remarkable feat by @isro is yet another proud moment for our space scientific community and the nation. India salutes our scientists.”। ইংরেজিতে feat শব্দের অর্থ হলো দুরূহ কাজ।

(চলবে)
????️ রজত কান্তি দাশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.