প্রায় একমাস হয়ে গেল গুজরাত আর হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছে। দুই রাজ্যে কোথাও কোন প্রকার ভোট পরবর্তী হিংসা বা একটিও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
ওই দুই রাজ্যের মানুষ আমাদের আপামর পশ্চিমবঙ্গবাসীকে এক নতুন শিক্ষা দিয়েছে। গনতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। এই পদ্ধতিতেই ঠিক হয় ভবিষ্যতে শাসন ভার কে পাবে? নির্বাচন অবশ্যই একটা খেলা। কিন্তু সে খেলার নিয়ম কি হবে?
খেলার শেষে বিজয়ী দল বিজিত পক্ষের ছিন্ন মুন্ড নিয়ে ফুটবল খেলবে নাকি খেলার শেষে একে অপরকে মিষ্টি খাওয়াবে?
গুজরাতে বিজেপি জিতেছে। ১৮২টি আসনের মধ্যে ১৫৬ টি আসন পেয়েছে বিজেপি। পরপর চার বার গুজরাতের মানুষ তাদের নির্বাচিত করেছেন। কিন্তু নির্বাচনের আগে বা পরে একজন মানুষেরও প্রাণ যায়নি।
হিমাচল প্রদেশে হেরে গেছে বিজেপি। হিমাচলে বিজেপির সংগঠন পুরনো। ১৯৯০ সালেই সে রাজ্যে বিজেপি সরকার গড়েছিল, মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন সান্তা কুমার। কিন্তু রাজ্যের মানুষ এবার মুখ্যমন্ত্রী জয়রাম ঠাকুরের সরকারকে বদলে দিলেন। কংগ্রেস সরকার গড়েছে। সেখানেও কারো মৃত্যু হয়নি। কোন মহিলার উপর রাজনৈতিক কারণে অত্যাচার হয়নি।
গত বছর পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের ছবিটা আমাদের চোখে ভাসছে। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের থেকে এই মৃত্যু মিছিল শুরু হয়েছে। যার ভয়ানক পরিনাম দেখা গেল ২ মে, ২০২২ বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরে।
. ২ জুন রাতে মানিকতলা থানা এলাকায় তরতাজা যুবক অভিজিৎ সরকারের নির্মম হত্যার মধ্যে দিয়ে এই নরমেধ শুরু হয়। এর পরে সারা রাজ্য জুড়ে চলেছে নারকীয় সন্ত্রাস। মাত্র তিন মাসের মধ্যে ৪২ জন মানুষের প্রাণ গিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে গনধর্ষিতা হয়েছেন বহু মা বোন। আবার সেই খবর প্রকাশ পাওয়ার পরে নির্যাতিতার উপরে চলেছে আরও অত্যাচার। নানুরের ঘটনা ছিল সবচেয়ে মারাত্নক। অভিযোগ ওঠে যে ধর্ষিতাকে দিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করিয়ে অভিযোগ তুলিয়ে নেওয়া হয়। বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খাওয়ানো সেই সব জেলার নেতারা বেহায়া জাতি ফুলিয়ে ঘুরেছেন।
আজকের এই লেখা ওইসব নেতাদের সমালোচনা করা বা গুজরাত কি হিমাচলের রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের জয়গান করার জন্য নয়। বরং প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কাজে যাঁরা কোন ভাবে যুক্ত নয় তাঁদের নিয়েই।
বাংলা তো বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্করের মাটি। তাঁদের উত্তরসূরিরাই আজ শিল্প সাহিত্যের জগতে আছেন। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের “হিন্দু পেট্রিয়ট” ইংরেজ নীলকর সাহেবদের হৃদকম্প ধরিয়ে দিয়েছিলেন। ইংরেজ সরকারের অত্যাচারে মাত্র ৩৭ বছরে মৃত্যু হয় হরিশ্চন্দ্রের। ইংরেজ তাঁর অসহায় বিধবা স্ত্রী মোক্ষদাসুন্দরীর বিরুদ্ধে মামলা করে তাঁদের ছাপাখানা নষ্ট করে দিয়েছিল। আজকের কলকাতা সংবাদ মাধ্যমে তো হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বীরধ্বজ বহন করছে। ভুদেব মুখোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো সরকারি আধিকারিকের উত্তরাধিকার এই বাংলার। ক্ষুদিরাম বসু, উল্লাসকর দত্ত থেকে নেতাজি সুভাষ – নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিকের জন্মভুমি এই বঙ্গদেশ। “ধন্য আমরা যদি এ শিরায়/
রহে যদি তাদের রক্ত লেশ”।
যে সব শিল্পী সাহিত্যিক “আমরা অন্য কোথাও যাবো না” বলে পূর্ববঙ্গ থেকে প্রাণ আর ইজ্জত বাঁচাতে পশ্চিমবঙ্গে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের তাঁদের ন্যায্য অধিকার পেতে দিলেন না। নাগরিত্ব সংশোধনী আইনের রূপায়ণের ব্যার্থতায় চিরকালীন ক্ষতি হয়ে গেল বাঙালি উদ্বাস্তুদের। কিন্তু এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজ ২০২১ সালের ২মে তারিখের পরে যে এত মানুষের মৃত্যু , এত বিভৎস নারী নির্যাতনের পরে একটি কথাও তো বললেন না। কেন বলেন নি? মার খাওয়ানো ভয়ে? নাকি অপ্রাপ্য কিছু পাওয়ার আশায়। বাঙালি হিসাবে কি আমাদের মাথা হেট হয় নি?
পশ্চিমবঙ্গের প্রচারমাধ্যমে একটি বড় অংশ বামপন্থী বা অতিবামপন্থী ভাবনাতেই ডুবে আছেন। তাঁদের অবচেতনে হয়তো এখনো চেয়ারম্যান, চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস ইত্যাদি প্রভৃতি আছে। তাই হয়তো তাঁরা নির্বাচনের পরের বর্বরতাকে অস্বাভাবিক মনে করেন না। তাঁরা বলবেন, চিনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবেও তো অন্ততঃ ত্রিশ লক্ষ মানুষ খুন হয়েছিলেন। কিন্তু এটি ভারতীয় সংবিধানের বিরোধী। মানুষ খুন গনতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলে না। গুজরাতেও না, পশ্চিমবঙ্গেও না।
সবচেয়ে লজ্জাজনক ছিল সরকারি আধিকারিকদের ব্যার্থতা। রাজনৈতিক শক্তি আর প্রশাসন যে এক নয় সেটা পশ্চিমবঙ্গে যেন বোঝাই যায় নি। নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরে প্রায় এক সপ্তাহ অবাধে হত্যা, অত্যাচার বা নারী নির্যাতন চলেছে। কলকাতা হাইকোর্ট বা কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপের আগে পর্যন্ত একেবারে মধ্যযুগীয় অবস্থা তৈরি হয়েছিল।
এই প্রসঙ্গে গুজরাতের কয়েকজন আমলার সাহসের উল্লেখ করা প্রয়োজন। গুজরাতে এত শক্তিশালী রাজনৈতিক দল, অমিত ক্ষমতাশালী ব্যাক্তিত্বের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রশাসনের সতন্ত্র অস্ত্বিত্বের প্রমান দিয়েছেন। তাঁরা বদলি হয়েছেন, কেউ স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন কিন্তু মাথা নত করেন নি। গুজরাতে গিয়ে দেখেছি বিজেপি বা কংগ্রেস নির্বিশেষে মানুষের মনে এইসব অফিসারের উপরে গভীর শ্রদ্ধা আছে।
হিমাচলেও কিন্ত একজন বিজেপি কর্মী খুন হননি, একজন মহিলারও সম্মানহানি হয়নি। হিমাচলের কোন গ্রামে ঘরবাড়ি বিজেপি করার জন্য বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়নি।
এর জন্য দায়ী কংগ্রেসের বা বিজেপির নেতৃত্বের মহানুভবতা, এটি ভাবলে ভুল হবে। ইউরোপের প্রেক্ষাপটে যোশেফ ডি মেইথ বলেছিলেন, ” গনতন্ত্রে জনগণ শেষপর্যন্ত নিজেদের প্রাপ্য সরকার এবং নেতৃত্বই পেয়ে থাকেন।” পশ্চিমবঙ্গের পরিবেশ পরিস্থিতি তো ইউরোপের মত নয়, ভিন্ন, স্বতন্ত্র। তবু যেন মনে হয় আজ হয়তো আমরা হয়ত আমাদের প্রাপ্য সামাজিক নেতৃত্ব, তথাকথিত বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যক পাচ্ছি। অন্যের দিকে আঙুল তুললে তিনটে আঙুল তো নিজের দিকেই থাকে!
জিষ্ণু বসু