সুপার সাইক্লোন ফণী কিছুদিন আগেই আছড়ে পড়েছিল উড়িষ্যার উপকূলবর্তী অঞ্চলে। এই সংকটময় পরিস্থিতিতে উড়িষ্যাবাসীকে সাহায্য করতে সবার প্রথমে এগিয়ে এসেছে আর এস এস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগাম সতর্কতা থাকার কারণে আর এস এস – এর সেবা বিভাগ উৎকল বিপন্ন সহায়তা সমিতি বা ইউ বি এস এস, অনিশ্চিত ও অতর্কিত এই দুর্যোগের হাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে সব রকম ভাবে প্রস্তুত ছিল এবং ফণী পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কালীন পরিস্থিতিতে সব রকমের সাহায্য প্রদান করেছিল।
সাইক্লোন পূর্ববর্তী কার্যক্রমঃ– সাইক্লোন পূর্ববর্তী সময়ে ২রা মে, মাঞ্চেশ্বর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটে সংস্থার হেড কোয়ার্টারে একটি কোর কমিটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকে দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে কিভাবে মানুষকে উদ্ধার করা হবে এবং তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা কী করা হবে তা নিয়ে আলোচনা হয় এবং উদ্ধারকার্য কিভাবে সফল হয়ে উঠবে তার একটি ব্লু-প্রিন্ট নির্মাণ করা হয়।
সাইক্লোন পরবর্তী কার্যক্রমঃ– সাইক্লোন পরবর্তী সময়ে ইউ বি এস এস এবং তার সমমনস্ক উদ্ধারকারী দলগুলি দ্রুত দুর্যোগ কবলিত মানুষকে উদ্ধারের কাজে হাত লাগায় এবং ত্রান পৌঁছে দিতে শুরু করে।
ইউ বি এস এস – এর সেচ্ছা সেবকরা দ্রুত হাত লাগিয়ে রাস্তার ওপর থেকে ভেঙ্গে পড়া গাছ কেটে ফেলে রাস্তা পরিষ্কার করে দেয়। এর ফলে যান বাহন চলাচল এবং ত্রান সামগ্রী আসার পথ খুলে যায়।
দুর্যোগের দিন অর্থাৎ ৩রা মে ২০১৯ এ প্রায় ৪০০ মানুষকে দিনে এবং রাতে রান্না করা খাবার দেওয়া হয় এবং মাঞ্চেশ্বর ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট এ অবস্থিত সংস্থার হেড কোয়ার্টারে অসহায় মানুষদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। পুরী ও কটকের অধিক ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা গুলোতে ( নিমাপদ, ব্রহ্মগিরি, সাক্ষীগোপাল, অলাতপুর), রান্না করা খাবার বিলি করা হয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে পনেরোটি উদ্ধারকারী ক্যাম্প থেকে প্রায় লক্ষাধিক মানুষকে রান্না করা খাবার দেওয়া সম্ভবপর হয়ে ওঠে। শিশুদের জন্য বেবি ফুডেরও ব্যবস্থা করা হয়। ১৭ই মে পর্যন্ত ৪৩৪ বস্তা চাল অর্থাৎ ১০৮.৫ কুইন্টাল চাল, ৭০ বস্তা ডাল অর্থাৎ ২৪.৫ কুইন্টাল, আলু ১০১ বস্তা, ৪০ টিন সর্ষের তেল এবং ১৮ বস্তা নুন ত্রান উদ্ধার কেন্দ্রে পাঠানো হয়, রান্না করা খাবার বিলি করার জন্য।
সমিতি তিনটি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জেলায় পনেরোটি উদ্ধার কেন্দ্র খোলে। পুরীর ঘোরাবাজার, ডান্ডামুকুন্দপুর , কানাস, খেলার, নিমাপদ, সোনারা , ব্রহ্মগিরি এবং খুরদা জেলার জত্নি, ভুবনেশ্বর এছাড়া কটক জেলার অলাতপুর এবং মহানন্দিবিহার এই গুলি হল সব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা। ২০০০ এরও বেশি সংখ্যক ইউ বি এস এস সেচ্ছা সেবক প্যাকেটজাত খাদ্যদ্রব্য যেমন – বিস্কুট , চিড়েভাজা, চিড়ে-গুড় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী যেমন – ৫০ কার্টুন মশা তাড়ানোর কয়েল, ৩৪৬ কার্টুন মোমবাতি, ১০২ কার্টুন দেশলাই বাক্স, ৩১৫০ টি শাড়ি , ২৪৯৫১ পিস তারপলিন, ৭৬৯৭৪পিস পলিথিন, ১৭৯২৮টি জলের বোতল, ৪লাখ ১৮ হাজার পাউচ পানীয় জল সরবরাহ করেছে। সমিতি এই উদ্ধার কেন্দ্র গুলি থেকে তার সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বমোট ১লাখ ১ হাজার ৯২৫ টি পলিথিন সরবরাহ করেছে। ইউ বি এস এস সরাসরি উদ্ধার কেন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ কার্যপ্রণালী পরিচালনা করেছে।
১৪ টি ভ্রাম্যমান মেডিকেল ইউনিট ২২২ টি জেলায় পৌঁছে গিয়ে অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। এই ব্যবস্থায় প্রায় ১৮৫৫৬ জন রোগী চিকিৎসা লাভের সুযোগ পেয়েছেন। পুনর্বাসনের কাজ এখনো চলছে। স্বয়ংসেবকদের লক্ষ্য হল সমস্ত দুর্যোগগ্রস্ত মানুষকে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। স্বেচ্ছাসেবকরা এই কাজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাই তাদের মধ্যে ক্লান্তির কোন আভাস দেখতে পাওয়া যায় না। পুনর্বাসন একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া, তবে এই মুহূর্তে অব্যবহিত প্রয়োজনীয় ত্রানগুলির ক্ষেত্রে স্বয়ংসেবকরা কি কি কাজ করেছেন তা দেখে নেওয়া যাক।
সৌর আলো বণ্টন – প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় এবং পুরী জেলার প্রান্তিক অঞ্চল গুলিতে যে আগামী দুই মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছবে না তা প্রায় নিশ্চিত । সেই কারণে সৌর আলো এবং তারপউলিন বণ্টন করা হয় এছাড়া পুরুষ ও মহিলাদের বস্ত্র, পরবর্তী কৃষি মরসুমের জন্য বীজ ও চারা, গবাদি পশুর খাদ্য এবং শিশুদের জন্য পড়াশোনার উপকরণ বণ্টন করা হয়।
বস্ত্র বিতরন – ইউ বি বি এস বস্ত্র বিতরণের ক্ষেত্রে এক একটি ‘কিট’ এর ব্যবস্থা করে। এর মাধ্যমে শাড়ি, লুঙ্গি, তোয়ালে , বিছানার চাদর, মশারি, ইত্যাদি প্রদান করা হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে এই গুলো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী । ১৩৫০ টি শাড়ি , ৭৫০ টি লুঙ্গি, ৭৫০ টি বিছানার চাদর, ৭৫০ গামছা বা তোয়ালে বিতরণ করা হয়, পানের বরজের চাষিদের সাহায্য প্রদান – পানের বরজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করা কৃষকরা এই দুর্যোগে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ইউ বি বি এস কর্মীরা মুখ থুবরে পড়া এই সমস্ত চাষিদের পুনরায় ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্দেশে প্রত্যেককে ২০০০০ টাকা করে আর্থিক সাহায্য দেয় । মোট ৬০০ জন পান চাষি এই সাহায্য পেয়েছেন। চাষের প্রয়োজনীয় বাঁশ ও অন্যান্য সামগ্রী কেনার জন্য তাদের এই সাহায্য দেওয়া হয়।
নারকেল ও সুপারি চাষিদের সাহায্য প্রদান – নারকেল চাষিরাও এই দুর্যোগে একেবারে ভেঙ্গে পড়েন । ইউ বি এস এস এক্ষেত্রে একটি পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ১লাখ নারকেল গাছের চারা এবং ১০ হাজার সুপারি গাছের চারা চাষিদের মধ্যে বণ্টন করা হয়। নারকেল গাছের প্রতি চারার মূল্য ৫০ টাকা এবং সুপারি গাছের প্রতি চারার মূল্য ৩০ টাকা ।
মৎস্যজীবীদের মাছ ধরা জাল এবং নৌকা প্রদান – মৎস্যজীবীদের মাছ ধরার জাল এবং নৌকা গুলি ঝড়ে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এর ফলে তাদের জীবন ও জীবিকায় ঘোর সঙ্কটের ছায়া নেমে আসে । এক্ষেত্রে সঙ্ঘ ২৫ টি নতুন নৌকা কিনে দেবার এবং ১০০ টি নৌকা মেরামত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নৌকা মেরামতের জন্য নৌকা পিছু ১,০০,০০০/৫০,০০০ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ইউ বি এস এস এর লক্ষ্য হল সমস্ত মৎস্যজীবী পরিবারকে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথে ফিরিয়ে আনা।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মেরামতি – শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ , তাই শিশুদের শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াটি ব্যাহত হলে চলবে না। সমিতি এক্ষেত্রে ১৩ টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ১০ লাখ টাকা করে সাহায্য প্রদান করবে মেরামতির জন্য।
তাই বলা যায় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ সর্বদাই মানুষের পাশে, মানুষের সেবায় সদা নিয়োজিত ।