আবার রক্তাক্ত হলো কাশ্মীর। গত অর্ধদশকের মধ্যে সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ সে প্রত্যক্ষ করলো ১৪ ফেব্রুয়ারি রাতে। জঙ্গি বোমা বিস্ফোরণে শহিদ হলেন ৪০ জন ভারতীয় জওয়ান। গোটা দেশ শোকস্তব্ধ। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকারী জঙ্গিদের নিখুঁত পরিকল্পিত আক্রমণ সকলকেই বিস্মিত করেছে, কিন্তু তার সঙ্গে আরেকটি প্রশ্নও অনুসন্ধিৎসু মনে। মাঝে মাঝে উদিত হচ্ছে, সন্ত্রাসবাদীরা এত অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ক্রয় ও ব্যবহার করার মতো অর্থ পাচ্ছে কোথা থেকে? সন্ত্রাসবাদকে যারা আদর্শ মনে করে শুধুমাত্র তাদের ব্যক্তিগত দানের ওপর নির্ভর করে তো এই বিপুল পরিমাণ অর্থের সংস্থান করা সম্ভব নয়। এছাড়াও অন্য অর্থের নিয়মিত সংস্থান নিশ্চয়ই আছে তাদের। অর্থ সংস্থানের সেই আলাদা উৎসটি কী?

অর্থনীতির স্বাভাবিক নিয়মানুসারে কোনও কাজের জন্য প্রধানত, দু’রকম পদ্ধতিতে অর্থ সংগৃহীত হয়। প্রথমত, দান। হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ। দ্বিতীয়ত, বিনিয়োগ হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ। দান হিসেবে প্রাপ্ত অর্থ এই বহুধাবিস্তৃত সন্ত্রাসবাদী চক্র চালানোর পক্ষে যথেষ্টনয়। তাহলে প্রয়োজনীয় অর্থের বাকি অংশ আসে বিনিয়োগ হিসেবে। জিজ্ঞাসু মন এখানেও থমকে দাঁড়ায়। বিনিয়োগ সাধারণত করা হয় লাভের আশায়, সন্ত্রাসবাদ একটি দেশের ক্ষতি করতে পারে ঠিকই কিন্তু অন্য কারও অর্থনৈতিক উপকার করতে পারে কি? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গেলে ভারতের সন্ত্রাসদীর্ণ অঞ্চলগুলির আর্থ-সামাজিক পটভূমিকে বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে দেখতে হবে।

ভারতের সর্বাপেক্ষা সন্ত্রাসদীর্ণ এলাকা কাশ্মীর। প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তান ও পরোক্ষভাবে চীনের সমর্থনে পুষ্ট এখানকার জেহাদি জঙ্গিরা ভারতকে আঘাত করে আসছে। কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তান ও চীনের লালসাজর্জর দৃষ্টিনিক্ষেপ আজকের কথা নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই মধ্য এশিয়ার সঙ্গে ভারতের স্থলপথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম কাশ্মীরকে ভারতের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। কাশ্মীরের ওপর পাকিস্তান ও চীনের এত আকর্ষণ থাকার বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত, কাশ্মীরের প্রকৃতি যেন ঈশ্বরের কাছ থেকে বিশেষ আশীর্বাদপ্রাপ্ত, তুলনারহিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অধিকারী কাশ্মীর যেন আক্ষরিক অর্থেই ভূস্বর্গ। স্মরণাতীত কাল থেকেই পর্যটকদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে এসেছে কাশ্মীর। কাশ্মীরের প্রতি পর্যটকদের এই আকর্ষণকে কেন্দ্র করে পর্যটন শিল্পে কাশ্মীরকে অনেক উন্নত করে তোলা যেত এবং প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা যেত। সেই বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ কত দেখা যাক। ১৯৬০ সালে সুইজারল্যান্ডের পর্যটন খাতে আয় ছিল মাত্র ৯৫.২ লক্ষ ডলার বা ৪ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা। ২০১৪ সালে সুইজারল্যান্ডের পর্যটন খাতে আয় ছিল ৭০৯১৮ কোটি ডলার বা ৪৪২০৩১৮ কোটি টাকা। ১৯৬০ সালে কাশ্মীরের পর্যটন খাতে আয় ছিল ৩৭ কোটি ডলার বা ১৭৬ কোটি ১২ লক্ষ টাকা, ২০১৪ সালে কাশ্মীরের পর্যটন খাতে আয় ছিল মাত্র ২৫০০ কোটি ডলার বা ১৫৫৮২৫ কোটি টাকা। উপরোক্ত পরিসংখ্যান থেকে দেখা গেল ১৯৬০ সালে কাশ্মীরের পর্যটন খাতে আয় সুইজারল্যান্ডের পর্যটন খাতে আয়ের ৩৯ গুণ ছিল। ১৯৬০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত এই ৫৪ বছরে সুইজারল্যান্ডের আয়বৃদ্ধি হয়েছে ৭৪৫০০ গুণ। একই সময়কালে কাশ্মীরের আয় বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ৭০ গুণ। এই সময়কালে কাশ্মীরের আয় বৃদ্ধি যদি সুইজারল্যান্ডের আয় বৃদ্ধির সমহারে হতো তাহলে ২০১৪ সালে কাশ্মীরের পর্যটন খাতে আয় হতো ২৭৫৬২৭০ কোটি ডলার বা ১৭১৭৯৮১১০ কোটি টাকা যা গোটা ভারতের মোট জিডিপি-র ৮ গুণ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীর ও সুইজারল্যান্ডের আয় বৃদ্ধির এই বিপরীতমুখী অবস্থানের একটাই কারণ, সুইজারল্যান্ড পর্যটন শিল্পে যত উন্নতি করতে পেরেছে কাশ্মীর তা করতে পারেনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক দিয়ে কাশ্মীরের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকা সুইজারল্যান্ড পর্যটন শিল্পে এত বেশি উন্নতি করলো অথচ কাশ্মীর গহন তিমিরে তলিয়ে গেল। এর একটাই কারণ কাশ্মীরে উগ্রপন্থার জন্য পর্যটকদের স্বাভাবিক ভীতি। এই ভীতি সৃষ্টি করেছে পাকিস্তান চীনের সাহায্যে। তাদের লক্ষ্য একটাই। উগ্রপন্থার ক্রমবর্ধমান চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ভারত যদি কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাতে তুলে দেয় তাহলে পর্যটন শিল্পে কাশ্মীরের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান ও চীন নিজেদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি করবে। ভবিষ্যতের এই লাভের আশায় চীন এবং চীনপ্রদত্ত বলে বলীয়ান পাকিস্তান কাশ্মীরের উগ্রপন্থীদের অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য করে যাচ্ছে বিনিয়োগ হিসেবে। সন্ত্রাসবাদ না থাকলে শুধু কাশ্মীরের পর্যটন শিল্পের সাহায্যেই ভারত আজ বছরে উপরোক্ত পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারতো যা ভারতের অর্থনীতিকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারতো এবং পর্যটন শিল্পে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানও হতে পারতো।

কাশ্মীরের পরে ভারতের দ্বিতীয় সন্ত্রাসদীর্ণ এলাকা হলো মাওবাদী সন্ত্রাসের আতঙ্কে তটস্থ ভারতের প্রায় আশিটি জেলা। জেলাগুলি মূলত মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের কিছু অংশে অবস্থিত। অনুর্বর মৃত্তিকাবিশিষ্ট জেলাগুলি কৃষিতে অত্যন্ত পশ্চাদপদ হলেও বিভিন্ন খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে ভারতের এই আশিটি জেলায় মাটির নীচে প্রায় ৮০ লক্ষ কোটির (যা ভারতের সাত বছরের বাজেটের সমান) খনিজ পদার্থ সঞ্চিত আছে। এই খনিজ পদার্থের সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব হলে ভারতশিল্পে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশে পরিণত হত। কিন্তু ভারত শিল্পে স্বয়ম্ভর হলে শিল্পনির্ভর অর্থনীতির ক্ষেত্রে এশিয়ার আরেক উদীয়মান শক্তি চীনের বাজার নষ্ট হবে। চীন তার উৎপাদিত পণ্য ভারতে রপ্তানি করতে পারবে না, আবার অন্য দেশে রপ্তানি করার সময় ভারতীয় পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পড়বে তাই ভারতের শিল্পক্ষেত্রের এই বিপুল সম্ভাবনাকে নষ্ট করার জন্য এই জেলাগুলিতে মাওবাদী নামক উগ্রপন্থীদের অর্থ এবং অস্ত্রদ্বারা সাহায্য করছে চীন। এই অর্থব্যয় এশিয়ার অর্থনীতিতে নিজের প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য চীনের এক প্রকার বিনিয়োগ। চীন প্রদত্ত অর্থবলে এবং অস্ত্রবলে বলীয়ান মাওবাদীরা এই সমস্ত এলাকায় এমন অশান্তির পরিবেশ তৈরি করেছে যে এখানে ন্যূনতম পরিকাঠামো তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে দেশের শাসনব্যবস্থা। ফলে ভারতের শিল্পে উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা বাস্তবায়িত হচ্ছে না।

এছাড়াও ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে (অর্থাৎ অসম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, ত্রিপুরা এই সাতটি রাজ্য যারা একত্রে সাত বোন নামে পরিচিত) সন্ত্রাসবাদের অশুভ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রসঙ্গত বলা যায়, অরুণাচল প্রদেশ-সহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতও কৃষিতে অত্যন্ত পশ্চাদপদ। এখানকার ভূপ্রকৃতি পাহাড়ি ঢালবিশিষ্ট হওয়ায় কৃষিতে এই অঞ্চল খুব পিছিয়ে। কিন্তু উত্তর-পূর্ব ভারতের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। হিমালয়ের ঠিক প্রান্তদেশে অবস্থিত এই অঞ্চলটি বরফগলা জলে সমৃদ্ধ থাকে সারাবছর। এছাড়াও মৌসুমি বায়ু প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয় এই অঞ্চলেই ফলে বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টি এই অঞ্চলেই হয়। পাহাড়ি ঢাল বরাবর সেই জল প্রচণ্ড গতিতে নিম্নমুখী হয়। ফলে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে অরুণাচল প্রদেশ-সহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত সোনার খনিসদৃশ। বিশেষজ্ঞদের মতে শুধুমাত্র অরণাচল প্রদেশেই বছরে এক লক্ষ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হতে পারে। সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারত মিলিয়ে পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে। আজ ক্রমক্ষয়িষ্ণু খনিজ তেলের ভাণ্ডারের ওপর এবং ক্রমক্ষয়িষ্ণু খনিজ কয়লাজাত তাপবিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল গোটা বিশ্বের শিল্প ও পরিষেবা ক্ষেত্র যখন বিকল্প শক্তির সন্ধানরত তখন এই বিপুল পরিমাণ জলবিদ্যুৎ ভারতীয় অর্থনীতির এক চিরস্থায়ী সম্পদে পরিণত হতে পারে। কিন্তু বিকল্প শক্তির বলে বলীয়ান ভারত শিল্পোন্নয়নশীল চীনের মাথাব্যথার কারণও হতে পারে। আবার ভারত বিকল্প শক্তির বলে বলীয়ান হলে পেট্রোলিয়ামের আমদানি কমিয়ে দিতে পারে, যা মধ্য এশিয়ার পেট্রোডলারের বলে বলীয়ান ওপেক দেশসমূহের কপালে ভাঁজ ফেলতে পারে। তাই চীন এবং মধ্য প্রাচ্যের দেশসমূহ উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক উগ্রপন্থী সংস্থাকে অর্থ দ্বারা সাহায্য করছে। এই সাহায্যও তাদের কাছে বিনিয়োগের সমান। এক সময়ে নিজেদের পৃথক জাতিসত্তা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে সৃষ্ট এখানকার উগ্রপন্থী সংস্থাগুলি এখন চীন ও মধ্যপ্রাচ্যের সাহায্যের লোভে নিজেদের আদি উদ্দেশ্য বিসর্জন দিয়ে বিদেশি শক্তির হাতের পুতুল হয়ে গেছে। তাদের সৃষ্ট অশান্ত পরিবেশ এখানে সরকারকে উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে দিচ্ছে না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই উগ্রপন্থী সংস্থাগুলি নিজেদের ঘোষিত উদ্দেশ্য অনুযায়ী অনেক সময়ই পরস্পরবিরোধী হলেও নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এবং ভারত বিরোধিতা করার জন্য পরস্পর ঐক্যবদ্ধ হতে দ্বিধা করে না। অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে ভূমিপুত্রদের অধিকার রক্ষায় গঠিত উগ্রপন্থী সংস্থা অনুপ্রবেশের মদতদাতা উগ্রপন্থীদের সহায়তা করতে পিছু পা হয় না। সন্ত্রাসের অর্থনীতি পারস্পরিক নীতিগত বৈসাদৃশ্য ভুলিয়ে তাদের এক করে দেয়।

সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থনে যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী কথা বলেন তাদের এক যুক্তি হলো দারিদ্র্য থেকেই সন্ত্রাস সৃষ্টি হয়। কথাটা সর্বাংশে ভুল। কারণ যে জায়গাগুলি অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সম্ভাবনাপূর্ণ সেই জায়গা ছাড়া অন্য কোনও জায়গায় (সেই জায়গা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে দুর্বলতর হলেও) সন্ত্রাস হয় না আর সন্ত্রাস যেখানে হয় সেখানকার বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক ক্ষতিই বেশি হয়। কারণ সন্ত্রাসের অর্থনীতি ব্যস্তানুপাতিক পরিণতিতে অর্থনীতিতেও সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে। কাশ্মীরের তুষারশুভ্র পর্বতমালাই হোক বা মাওবাদী অধ্যুষিত খনিজ সম্পদপূর্ণ মালভূমি বা ঢেউ খেলানো উপত্যকাবহুল উত্তর-পূর্ব ভারত-সন্ত্রাস বন্ধ হলে অর্থনীতির স্বাভাবিক পথচলায় সর্বাপেক্ষা উপকৃত হতেন সেখানকার বাসিন্দারাই।

অম্লান কুসুম ঘোষ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.