মূলস্রোতের ইতিহাসকারদের লেখা পাঠ্যবইয়ে ইচ্ছা করেই চেপে যাওয়া হয়েছে বহু তথ্য। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ছবিটি আমাদের খাওয়াতে তাঁরা সদাই সচেষ্ট, যদিও তা মোটেই মধ্যযুগীয় ভারতের প্রকৃত চিত্র নয়।
ভারতের মার্ক্সীয় ঐতিহাসিকরা আমাদের বারবার বলে এসেছেন যে ভারত বিজেতা ইসলামি শাসকরা কেবল সম্পদের লোভেই হিন্দু মন্দিরগুলি দখল করেছিল। এই অভিযানগুলোর পেছনে ইসলামি সাম্প্রদায়িকতার ইন্ধন কিন্তু তাঁরা বেশ যত্ন নিয়েই এড়িয়ে গেছেন।
সুতরাং, এই মন্দিরগুলির মালিকানা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা কোনো বিবাদ সৃষ্টির স্বার্থে একেবারেই নয়। দ্বন্দ্বের উদ্রেক তখনই হয়, যখন আমি অপরের সম্পদে নজর দিই। তাই, অযোধ্যার রাম জন্মভূমির মালিকানা দাবি করলেই হিন্দুরা লোভী কিংবা সাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না।
অধিকাংশ ধর্মনিরপেক্ষ ভাষ্যকার বিভ্রান্তিকর এক নৈতিক সাম্যবোধের দ্বারা চালিত। ঘটনাটি যে যুগেই ঘটে থাকুক না কেন, এক পক্ষের আগ্রাসন আর অপর পক্ষের আত্মসম্মানের মধ্যে কোনো তুলনা আসেই না।
অযোধ্যা মন্দির চত্বরে ইসলামি অধিকার অস্বীকার করার কারণটি কখনোই জাতীয়তাবাদ বা ধর্মমত নয়, যেমনটা হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করে থাকেন। কারণটি অতি অবশ্যই বৌদ্ধিক।
প্রতিশোধ বনাম পুনরুদ্ধার
রাশিয়ার গির্জাগুলো ধ্বংস করে কমিউনিস্টরা সেখানে সুইমিং পুল তৈরি করেছিল। “ধর্ম হল জনসাধারণের কাছে আফিম” – এই আদর্শ মেনেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় ওগুলোকে। ১৯৯০-৯১ নাগাদ তাদের পতনের পরবর্তী ১০ বছরে ওইসব জায়গায় আগের চেয়েও জমকালো বহু গির্জা তৈরি করে রুশজাতি। এই প্রক্রিয়াকে কেউ কখনো ধর্মান্ধতা বলে দাগিয়ে দেয় নি কিন্তু। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড মুছে ফেলতে যদি ধর্মস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে অযোধ্যায় একটি সুমহান রাম মন্দির হতে কোনো বৌদ্ধিক বাধা থাকবে কেন?
“মূর্তিপূজা ইসলাম বিরোধী, তাই এর বিনাশ চাই” – এই গোঁড়ামির বশে ইসলামি আক্রমণকারীরা ভারতে হাজার হাজার মন্দির ধূলিসাৎ করে। এই মতবাদের যোগ্য উত্তরাধিকারী আজকের তালিবান আর ইসলামিক স্টেট। অথচ, শোষিত, নিপীড়িত জনগোষ্ঠী সব ভুলে, সব মেনে এগিয়ে যাবে, তা কি আশা করা ঠিক?
প্রতিশোধ আর পুনর্বাসনের মৌলিক পার্থক্য আছে। ভারতের উদারবাদী ভাষ্যকারগণ এইসব সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি দেখতে পান না বলেই হিন্দুদের প্রতি মুসলিমদের বন্ধুভাব আনতে তাঁরা ব্যর্থ। উল্টে তাঁদের যাবতীয় যুক্তি – তর্ক মুসলিমদের আরোই আপোসবিমুখ করতে ব্যস্ত।
অযোধ্যার সংগ্রাম থেকে শিক্ষা
অযোধ্যার সংগ্রাম থেকে বহু কিছু শেখার আছে। কৌশলী মুসলিম পক্ষ তাদের অবস্থান বদলেছে বারেবারে। কখনো তারা ভূগর্ভে মন্দিরের উপস্থিতির প্রমাণ চেয়েছে, কখনো আদালতের হস্তক্ষেপ চেয়েছে, আবার পরে তারাই দাবি করেছে যে ১৬শ শতকের এক বৈধ সার্বভৌম রাষ্ট্রের কার্যকলাপ সংশোধন করার এক্তিয়ার আদালতের নেই। মোট কথা, কোনো অবস্থাতেই তারা ওই জমির মালিকানা হিন্দুদের ছাড়তে রাজি নয়। অথচ, ১৯৪৯ থেকেই বাবরি মসজিদ পরিত্যক্ত এবং মুসলিমদের কাছে সেটির কোনো গুরুত্বই ছিল না।
উল্টোদিকে, জায়গাটি হিন্দুদের এক পবিত্র তীর্থ, হাজার হাজার বছর ধরে। কিন্তু তবুও মুসলিমদের শুভবুদ্ধির ওপর আস্থা রেখে তারা বিফলই হয়েছে। অথচ, এমনই শত শত মন্দিরের ওপর দাবি স্বেচ্ছায় ত্যাগ করেই তিনটি মাত্র সর্বোচ্চ তীর্থস্থান তারা ফেরত চেয়েছিল।
অযোধ্যা বিবাদটিকে কেবল জমিজমার মামলা হিসেবে দেখা হিন্দুদের আর উচিত হবে না। গত কয়েক দশকে এই বিতর্ক থেকে সবচেয়ে বড়ো যে শিক্ষা পাওয়া গেছে তা হলো – লড়াইটা এক মৌলিক ধর্মীয় – দার্শনিক – বৌদ্ধিক দায়িত্ব পালনের।
ধর্মনিরপেক্ষতা – বহুত্ববাদ বনাম মন্দির
হিন্দু – মুসলিম দুই পক্ষের দাবিদাওয়ার বাইরে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী নিয়মিত অসৎ প্রচার চালিয়ে থাকেন, যার আশু প্রতিরোধ প্রয়োজন।
কাশী, অযোধ্যা ও মথুরা – এই তিনটে শহরই সুবিখ্যাত তীর্থস্থান। এও মনে করা হয় যে এসব জায়গায় প্রতিটা বাড়িতেই একটা করে মন্দির রয়েছে। যে রাম জন্মভূমি স্বয়ং শ্রী রামের নামেই বহুকাল ধরেই পরিচিত, সেখানে রাম মন্দির নির্মাণ কতটা ন্যায্য – এই প্রশ্নটাই বেশ হাস্যকর। স্বভাবতই, এই বুদ্ধিজীবীদের কাছে হিন্দুদের কোনো যুক্তিই যথেষ্ট বলে গ্রাহ্য হয় না।
‘অযোধ্যায় একটি মন্দির এবং অন্যান্য কবিতা’ (রূপা, দিল্লি, ১৯৯৩) বইটিতে অমিত জয়রাম অদ্বৈতবাদী এক দার্শনিকের ঢঙে লিখছেন যে হিন্দু ধর্মের পরম্পরা অনুসারে মন্দির থাকা অথবা একজন ধার্মিক হিন্দু হওয়ার জন্য মন্দিরে যাওয়া জরুরি নয়। আপাতভাবে, যুক্তিটি নির্ভুল। স্বামী বিবেকানন্দ নিজেও ঢাকায় এক প্রকাশ্য সভায় (১৯০১) বলেছিলেন যে মন্দিরে উপাসনা হিন্দু ধর্মপথে উত্তরণের সোপানে প্রথম ধাপ মাত্র। কিন্তু স্রেফ এই যুক্তিতে কোটি কোটি হিন্দুর দৈনন্দিন বিশ্বাসকে অবজ্ঞা করে মন্দির প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করা কতখানি সঙ্গত?
বামপন্থীরা আবার ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মন্দিরের দাবির বিরোধিতা করেন। কিন্তু ভারত এতটা ধর্মনিরপেক্ষ আর সংস্কৃতিগত ভাবে এত দুর বিচিত্র হল কীভাবে? এ কিন্তু সম্ভব হয়েছে হিন্দু মূল্যবোধের কাঁধে ভর করেই।
ইসলামি দস্যু ও শাসকরা সহস্রাধিক মন্দির গুঁড়িয়ে দিলেও একমাত্র এই রাম জন্মভূমির ওপর হিন্দুরা তাদের দাবি কোনোদিন ছাড়ে নি। মনে রাখা দরকার, এই স্থানটির জন্য হিন্দুরা লড়েছে এবং মরেছে। হিন্দু মননে অযোধ্যার বিশেষ স্থান উপলব্ধি করতে সমস্যা হয় না। (‘হিন্দু মন্দির : তাদের সাথে কী হল’, অরুণ শৌরি, হর্ষ নারায়ণ, জয় দুবাষী, রাম স্বরূপ, সীতা রাম গোয়েল, ১৯৯০)
এদিকে উদারবাদীরা আবার বহুত্ববাদের ধুয়ো তুলে বলেন ভারত কেবল হিন্দুদের নয়। অথচ যে পক্ষ শতাব্দীর পর শতাব্দী লাঞ্ছিত, তাদেরকেই বারবার আপোস করতে বলা হয়। তাঁদের এ বহুত্ব ভুয়ো।
অন্য কোন দেশের কোন প্রধান জনগোষ্ঠীটি মথুরার ইদগাহ – কৃষ্ণ জন্মভূমি বা কাশীর জ্ঞানবাপী মসজিদ – বিশ্বনাথ মন্দিরের মতো এরকম পরিষ্কার এবং অপমানজনক দখলদারি মুখ বুঝে মেনে নেয়, নিয়েছে বা নেবে?
‘রাজনৈতিক স্বার্থে ইতিহাসের অপব্যবহার : বাবরি মসজিদ – রাম জন্মভূমি বিবাদ’ (১৯৮৯) পুস্তিকায় রোমিলা থাপার প্রমুখ মার্ক্সবাদী ইতিহাসবিদরাই দেখিয়েছেন কীভাবে শিক্ষক – শিক্ষাবিদ ও গবেষক মহল কয়েকশো বছরের বর্বর ধ্বংসলীলা ভুলিয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরগুলি (যেমন, জ্ঞানবাপী মসজিদের পশ্চাৎ ভাগে কিংবা কুতুব মিনারের গাত্রেও হিন্দু মূর্তি প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায়) ধ্বংসের নানা স্তরে দাঁড়িয়ে ইসলামি দস্যুদের অভাবনীয় বর্বরতার সাক্ষ্যই বহন করছে। অথচ, কালে কালে ঐতিহাসিক, গবেষক, বিদ্বান, জ্ঞানী ব্যক্তিরা বললেন, অযোধ্যায় কোনো মন্দির ভাঙার নির্দেশ বাবর দেয় নি, তুলসীদাসের রামচরিতমানসে কোনো রাম মন্দির ভাঙার উল্লেখ নেই ইত্যাদি ইত্যাদি।
সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং বাবরি বিতর্ক নিয়ে তিন খণ্ডে বই লিখে ফেলা এ জি নুরানী আবার বলছেন, “হিন্দুদের মনোবেদনার তত্ত্ব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এক বানোয়াট।”
আর এস শর্মা, ইরফান হাবিবের মতো বিশিষ্ট ইতিহাসকারগণ এবং প্রত্নতত্ত্ববিদ সুরজ ভান বারংবার মিডিয়াকে বলেছেন যে বাবরি মসজিদের নীচে চাপা পড়ে নেই কোনো রাম মন্দির (শর্মা ও হাবিব টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে, ১৯৮৯; ভান এশিয়ান এজকে, ১৯৯০)।
ক্ষত আজও টাটকা
মূলস্রোতের ইতিহাসবিদদের লেখা পাঠ্যপুস্তক থেকে মুঘল যুগ বা তার পূর্ববর্তী আগ্রাসনের হিন্দু – মুসলিম দ্বন্দ্বের দিকটি সচেতনভাবেই বাদ দেওয়া হয়েছে। তাঁরা সর্বতোভাবে চান গঙ্গা – যমুনা সম্প্রীতির পরম সুন্দর ছবিটিই আমরা বিশ্বাস করি, কিন্তু মধ্যযুগের ভারত বাস্তবে তো তেমনটি ছিল না।
“এত পরিমাণ বিপরীত সাক্ষ্যপ্রমাণের সামনে এরকম একটা ভাষ্যের পক্ষে দাঁড়ানো শক্ত। বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ কিংবা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাহিত পরাজয়ের, আত্মগ্লানির আখ্যান – সমস্তই এই অপরূপ চিত্রটির বিপক্ষেই যায়”, লিখেছেন কপিল এস কমিরেড্ডি তাঁর ‘হিংস্র গণতন্ত্র : নতুন ভারতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ পুস্তকে।
“অথচ রাষ্ট্রের যে কোনো বিদ্যালয়ের একটা পাঠ্য ইতিহাস বই খুলে দেখুন, কী ঘটেছিল তার কোনো ব্যাখ্যাই নেই। “আমাদের জনপ্রিয় ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসকার ও বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্যই ছিল ধর্মান্ধ দস্যুদের নির্বিচার বর্বরতার কিছু নির্বিষ কৈফিয়ৎ আবিষ্কার করা।
এরকমই এক উদাহরণ পাই রোমিলা থাপারের ‘সোমনাথ : ইতিহাসের বহু স্বর’ (২০০৪) বইটিতে। সেখানে তিনি লিখছেন, আগ্রাসী ইসলামি সৈন্যদল সময় ও সম্পদের অভাবেই বিজিত জমিতে মসজিদ ও ইসলামি সৌধ তৈরি করতে ভেঙে ফেলা মন্দিরগুলির ইট পাথর ব্যবহার করত।
যারা অযোধ্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধান সত্যিই চান, তাঁদেরকে আমাদের সভ্যতার এই দগদগে ক্ষতটা আগে অনুভব করতে হবে। প্রথমেই একে স্বীকার করতে হবে, এর শুশ্রুষা করতে হবে। তবে গিয়ে আমরা বৌদ্ধিকভাবে সৎ একটি সমাধানে উপনীত হতে পারব।