আধুনিক যুগে পুকুরের মাছ থেকে শুরু করে জমিতে ও বাগানে সবজি বা ফলের সুরক্ষার জন্য মাছ ধরার জালের ব্যবহার যথেচ্ছাচারে বেড়েছে। হনুমান, পাখিদের থেকে সবজি, ফল বা পুকুরের মাছ বাঁচাতে অবাধ জাল (Net) ব্যবহার হচ্ছে। অজান্তেই যে জালে জড়িয়ে পড়ছে পাখি-পতঙ্গরা। জালে জড়িয়ে বন্দী হলে কেউ কেউ তাদের মুক্ত করে দেয়, কেউ খাঁচায় বন্দী করে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বন্দী হয়ে মারা যায়।
স্থান ও প্রাকৃতিক পরিবেশ অনুযায়ী পাখির গুরুত্ব অপরিসীম। সমস্ত কিছু একসঙ্গে আলোচনা করলে, কথা শেষ হবে না। বেছে নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করলাম। গবেষণায় দেখা গেছে, মাছরাঙা, বক যে সমস্ত মাছ খায় তার বেশিরভাগই অসুস্থ, দুর্বল কিংবা রোগাক্রান্ত, ফলে ওই ধরনের মাছগুলি খাওয়া থেকে আমাদের বিরত রাখে, যা আমাদের ক্ষতি করতে পারতো।
পাখি সাধারণত Omnivore প্রাণী অর্থাৎ সবকিছুই প্রায় খেতে পারে। পরিবেশ থেকে রোগসংক্রমণকারী মরা পচা খাদ্যবস্তু খেয়ে ক্ষতিকর রোগের সংক্রমণ থেকে পাখি আমাদের বাঁচায়। পাখির অন্যতম খাদ্য পোকামাকড়। সবজিতে, ফলে, ফুলে, মাটিতে থাকা পোকামাকড় খেয়ে আমাদের খাদ্যদ্রব্য রক্ষা করে। মৌমাছি প্রজাপতির মতন পাখিরাও পরাগযোগে সাহায্য করে। পাখির পরাগযোগের ওপর নির্ভর করে যে গাছগুলি, সেগুলি পাখি কমে গেলে আস্তে আস্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
পুকুর জাল ঘিরে রাখায় মাছরাঙার মাছ খাওয়া বন্ধ হয়েছে, এমনকী জমিতে সবজি বাঁচানোর জন্য জাল দেওয়ার ফলে তাদের প্রাণ সংশয় দেখা দিচ্ছে। ঘেরা জালে আটকা পড়ে পাখিরা মারা যাচ্ছে। এই ধরনের জালগুলি সাধারনত নাইলন দিয়ে তৈরি, ‘ইলিশ জাল’ নামে পরিচিত। এই ধরনের জালের মধ্যে সহজেই জড়িয়ে যায় পাখি-পতঙ্গ। আবার মশারি জালে এই সম্ভবনা কম, কিন্তু তা পুকুর ঘেরার জন্য ব্যবহার হয় না।
সাদা-বুক মাছরাঙা আমাদের রাজ্য-পাখি (পশ্চিমবঙ্গের) সে খেয়াল আছে? হাওড়ার একটি জায়গায় বাঘরুল (Fishing Cat) সংরক্ষণের জন্য বসানো ট্র্যাপ-ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল, পুকুর থেকে মানুষের মাছ চুরি করার দৃশ্য। মাছ চুরি করে সবাই, কিন্তু দোষ হয় শুধু মাছরাঙার!
আর সবজিতে জাল দেওয়া, পাখি প্রবেশের পথ বন্ধ করা মানে সবজিতে পোকার উদয়। আর সেই পোকা তাড়াতে গাদা গাদা রাসায়নিক ব্যবহার করতে হচ্ছে এবং হজম করতে হচ্ছে আমাদেরই।
তাহলে কি বিকল্প উপায় নেই?
আছে। পুকুরের মাঝ বরাবর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত একটাই মোটা দড়ির সঙ্গে কিছু বোতলের মধ্যে কচ (বালিতে যে বড়ো বড়ো পাথর গুলো থাকে সেগুলোকে কচ বলে) ঢুকিয়ে পরপর সারিতে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সূর্যালোকের অনুপস্থিতিতে জলে অক্সিজেনের উৎপাদন কমে গেলে মাছ ওপরে এসে খাবি টেনে অক্সিজেন নেয়। সূর্যের আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জলের প্ল্যাঙ্কটন অক্সিজেন উৎপাদন শুরু করলে, আবার তারা জলের তলায় চলে যায়। তাই খুব সকালের দিকে মাছ জলের ওপর তলের দিকে থাকে। এটা পাখিদের শিকার করার সঠিক সময় তাই এই সময় অর্থাৎ ভোর থেকে কিছু সময় পর্যন্ত কেউ পুকুর পাহারা দিয়ে ওই দড়িটিকে ধরে নাড়ালে শিকার ধরার সময় বোতলের আওয়াজে এবং দড়ির ঝাপটায় পাখি বিভ্রান্ত হবে, ফলে সহজে শিকার ধরতে পারবে না। কিন্তু মাছ যদি রোগাক্রান্ত ও দুর্বল হয় বা জল খারাপ হলে, মাছগুলি আরও একটু বেলা পর্যন্ত পুকুরে ভেসে থাকবে।
গোটা পুকুরের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত বরাবর সুতো দিয়ে টেনে ঘিরে দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে, গোটা পুকুরে মাত্র ২টি প্রান্ত ব্যবহার করা হবে। এখানে যদি ৪টি প্রান্ত ব্যবহার করা হয়, তবে দড়ির দূরত্ব বাড়িয়ে রাখতে হবে। এতে পাখি-শিকারের গতি বাধা পাবে আবার পাখি সহজে জড়িয়েও পড়বে না।
গোটা পুকুরে পাকাটি বা পাট কাঠি গেঁথে রাখলেও শিকার ঠেকানো সম্ভব। এরম একটি দৃষ্টান্ত কিছুদিন আগে হাওড়া জেলার আমতায় একটি পুকুরে দেখা গেছে।
কি অদ্ভুত তাই না! প্রকৃতিকে কি একটু চেনার, রক্ষা করার ইচ্ছা হয় না? নিজেদের জন্য অন্তত! উপায় তো আছেই, শুধু প্রয়োজন একটু মনোযোগের। পুকুরে, সবজিতে নাইলনের ইলিশ জাল বন্ধ হওয়া দরকার, যারা জানেন বোঝেন, বাকিদের বোঝান, মানুষের সুবিধার কথা ভেবে বোঝান। আমাদের প্রকৃতিকে দরকার, আমরা প্রকৃতির অংশমাত্র। সাহস করে এগিয়ে আসুন। আমরা যারা বিষয়টা জানি-বুঝি, তাদেরই উচিত বাকিদের জানানো-বোঝানো। বহু সংখ্যক পাখি রোজ এই জালে জড়িয়ে মারা যাচ্ছে। এটি বন্ধ হওয়া খুব জরুরি, সবকিছুতে ইলিশজাল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।