একটি প্রচল কথা এইরকম, “একলা চরকায় স্বরাজ নেই।” অর্থাৎ কেবল চরকা কেটে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আসে নি। অহিংস আন্দোলনের পথেই কেবল স্বাধীনতা এসেছে, এটা সত্যি নয়। স্বরাজ সাধনার বহুতর ধারা – সহিংস, অহিংস, গুপ্ত বিপ্লব, আধ্যাত্মিক প্রেরণা ও প্রকাশ, সন্ন্যাসী সমাবেশ ও বিদ্রোহ, সেনা বিদ্রোহ, জনজাগরণ, শ্রমিক আন্দোলন, সংবাদপত্রের পাঠ ও স্বরাজ-সাংবাদিকতা, রাষ্ট্রবাদী সাহিত্য ও জনমানসের বুনিয়াদ, আত্মনির্ভরতার পাঠ প্রভৃতি। এই সকল ধারাকে বাস্তবতার পথে প্রবাহিত করার প্রয়োজন ছিল। এই একত্রীকরণের কাজ করলেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। বঙ্কিম, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্র ও অরবিন্দের চেতনায় স্বরাজের ভিন্নতর ধারা প্রবাহিত ছিল। এই প্রবাহগুলিকে সমন্বয় করে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে স্বরাজ্য ভাবনার উপস্থাপক ছিলেন মহারথী সুভাষ। বঙ্কিম-মানসে ছিল অখন্ড-জাতির ভাবনা আর অসুর বিনাশের যজ্ঞ; সাহিত্য-স্বরাজ। স্বামী বিবেকানন্দে প্রতিভাত হল ধর্মীয়, অধ্যাত্মিক ও সামাজিক স্বরাজ। রবীন্দ্রনাথের কাব্য সাধনার ধারার মধ্যে মুক্তি পেল ভারতবর্ষের অখণ্ড চেতনার রূপ-রস-গন্ধ। শ্রী অরবিন্দ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সুরে ভারতবীণায় বেঁধে দিলেন রাজনৈতিক স্বরাজবোধ। এই সকল পথের অমোচ্য সঙ্গীতে শুরু হল স্বাধীন ভারতবর্ষ গঠনের জন্য যুদ্ধ; সুভাষ তার মহাধিনায়ক। বিশ্বের সকল ঘটনাকে বাস্তবতার লাশকাটা ঘরে কাটাছেঁড়া করে, তিনি শত্রু-মিত্র জটিলতাকে সহজ সরল রূপ দিলেন, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধ যার অন্যতম চালিকাশক্তি। দেশবিরোধী শক্তি তাঁকে নানান গালমন্দে ভূষিত করল; খসে পড়ল নানান ব্যক্তিত্বের রাজনৈতিক মুখোশ। কিন্তু নেতাজী অনন্য; আত্মত্যাগ ছাড়া যে রাজনীতির লড়াইয়ে শাশ্বত জয় সম্ভব নয়, তা তিনি ভারতবাসীকে এবং ভারতের রাজনীতিবেত্তাদের বুঝিয়ে দিলেন। ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে যতদিন না তাঁর সংগ্রাম, চরিত্রশক্তি, নিঃস্বার্থপরতা, মানবিকতা, প্রাণময়তা ও অভিজ্ঞতাকে আমরা মূলধন না করবো ততদিন তাঁর আত্মার শান্তি নেই; পরগাছা থেকে মুক্তি নেই ভারতবর্ষের। আজ নেতাজীর কর্মজীবন, মতাদর্শ ও দার্শনিকতার প্রজ্ঞা প্রবাহ আমাদের মধ্যে গভীর খাতে প্রবাহিত হোক, ভারতমাতার কাছে এই প্রার্থনা করি।
ছবি: শীর্ষ আচার্য।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।