জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি জ্ঞান বিতরণের অভ্যাস এবং তার জন্য গ্রন্থাগার নির্মাণের সংস্কৃতি বাঙালি রপ্ত করেছিল স্বাধীনতার আগেই। এখানকারই বিশিষ্ট জমিদার এবং সমাজ সংস্কারক জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় চালু করেছিলেন ভারতের প্রথম এবং সম্ভবত এশিয়াতেও প্রথম বিনামূল্যে জনসাধারণের জন্য গ্রন্থাগার- উত্তরপাড়া জয়কৃষ্ণ পাবলিক লাইব্রেরি । অস্ট্রেলিয়ান লেখক ‘Empire of Enchantment: The Story of Indian Magic’ বইয়ের রচয়িতা জন জুবরজিস্কি উত্তরপাড়ার এই গ্রন্থাগারের কথা উল্লেখ করেছেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং জ্ঞানের রাজনীতি নিয়ে পিএইচডি করেছেন জোশুয়া এরলিচ। তিনি ‘The Calcutta Pococurante Society, Public and Private in India’s Age of Reform’ প্রবন্ধে লিখেছেন, লাইব্রেরিতে এসে ন, উত্তরপাড়া তিনি এক অস্পষ্টভাবে লেখা বইয়ের সন্ধান পান, যেখানে উনিশ শতকের কলকাতার ‘জনসাধারণ’ -এর বিষয়ে আলোকপাত করা ছিল।
সেই প্রবন্ধে লাইব্রেরিটির সম্বন্ধে আরও বেশ কিছু তথ্য রয়েছে৷ বলা আছে, “শুরুর দিকে এই স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের পড়ার ঘরে বাংলা, ইংরেজি এবং সংস্কৃত ভাষায় কয়েক হাজার বই ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং জ্ঞানের স্থান পেত। ওপরের ঘরগুলো ব্যবহৃত
হত বক্তৃতা, বৈঠক এবং টাউন হলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জন্য। বাগানে ফুটে থাকত মনোমুগ্ধকর সব ফুল”। চারপাশের বিশাল অঞ্চলে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল এই গ্রন্থাগার। পড়াশোনায় কৃতিত্ব দেখালে এখান থেকে সোনার পদক প্রদান করা হত। শতবর্ষ আগে এই গ্রন্থাগারে পা রেখেছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার আর্থার ওয়েলেসলি, ব্রিটিশ প্রশাসক অ্যাসলি ইডেন, বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার রিভার্স থম্পসনের মতো ব্যক্তিত্বরা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কেশবচন্দ্র সেন, মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো বাংলার মণীষীরাও এখানে এসেছিলেন।
এই লাইব্রেরির লোহার ফটক। হুগলি নদীর তীরে গ্র্যান্ড ট্যাংক রোডের পাশে এই বিশাল লাইব্রেরির দিকে মুগ্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে । লম্বা লম্বা থামওয়ালা প্রাসাদোপম বাড়ি, কাঠের বিশাল ঝুলন্ত বারান্দা, ছক কাটা মেঝে, উজ্জ্বল সবুজ খড়খড়িওয়ালা জানলা, কাঠের রাজকীয় আসবাবপত্র এমন এক যুগের স্মৃতি বয়ে আনে, যা হারিয়ে গিয়েছে অনেক অনেক আগে।
১৮৫০ সালের লন্ডন পাবলিক লাইব্রেরি আইন অনুসারে এই গ্রন্থাগারটি জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় । তখনকার বাঙালি সমাজে আধুনিক শিক্ষার বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল এই লাইব্রেরি। দোতলার একটি ঘর, যার বারান্দা থেকে গঙ্গা দেখা যায়, সেটি অনুমতিক্রমে সাধারণ মানুষরাও ব্যবহার করতে পারেন । এই ঘরে বসেই মাইকেল মধুসূদন দত্ত লেখালিখি করতেন । লাইব্রেরিতে চোখে পড়ল তাঁর বই ‘হেক্টর বধ’। এখানকার আসবাব এবং অন্যান্য পুরোনো সরঞ্জাম এক সময়ে বাংলার শিক্ষিত অভিজাতরা এবং ইউরোপিয়ানরা ব্যবহার করতেন।
প্রায় ৩ হাজার বই নিয়ে উত্তরপাড়া লাইব্রেরির যাত্রা শুরু হয়েছিল। এখন প্রায় ৪৫ হাজার পুরোনো বই রয়েছে এখানে। ১৭-১৮, শতকের কিছু বিরল সংগ্রহও রয়েছে । সব মিলিয়ে আছে ৫০ থেকে ৬০ হাজার বই, ২৫০০টির কাছাকাছি পুরোনো পত্রিকা এবং ২৫০টির বেশি পুঁথি। লাইব্রেরির এক কর্মচারী আমাকে ৩০০ বছরের পুরোনো এক পুঁথি দেখালেন। হাতে তৈরি কাগজের এই পুঁথিতে তন্ত্র এবং যোগ নিয়ে বৌদ্ধ চিন্তাধারা লিপিবদ্ধ করা আছে। লাইব্রেরিতে স্থান পেয়েছে তিব্বত, বারাণসী এবং কাশ্মীরের বিভিন্ন মঠ থেকে সংগ্রহ করা প্রায় ২০০টি তালপাতা অথবা হাতে বানানো
কাগজের সংস্কৃত পুঁথি । যার মধ্যে এটিও একটি। একটি সুন্দর কমলে কামিনী-র ছবি আছে পুঁথিটিতে, যা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। হস্তাক্ষর, সংস্কৃত ব্যাকরণ ও বাংলা শব্দভাণ্ডারের প্রয়োগও নজর কাড়ে । বাংলা যে এক সময়ে বৌদ্ধধর্মের এক প্রধান কেন্দ্র ছিল, তা এই পুঁথিটির থেকেই বোঝা যায়।
এশিয়াটিক সোসাইটি, ভারতীয় জাদুঘর, কিংবা জাতীয় গ্রন্থাগারের মতোই এই লাইব্রেরিও বাঙালি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ ধারক ও বাহক। কয়েকশো বছর আগে বাংলার পরিসংখ্যানগত কিছু গবেষণা ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ারের কাজে তিন বছর এখানে কাটিয়েছিলেন স্যার উইলিয়াম হান্টার। এই লাইব্রেরিকে তিনি বলেছিলেন, “A unique storehouse of local literature alike in English and vernacular tongues”। আমিও তাঁর কথায় সহমত পোষণ করি।