দেশের মানুষ তাদের পুরানো চৌকিদারকে পুনর্বহাল করেছে। তারা জানে এই চৌকিদার সর্বকালের সকল প্রলোভনের কেন্দ্রে থাকা জন (কামিনী), জর (কাঞ্চন) ও জমিন সম্বন্ধে নিস্পৃহ এক মুক্ত পুরুষ। অন্য নেতা-নেত্রীদের শত মিথ্যাভাষণ, ব্যঙ্গ, অপবাদ, কুব্যাখ্যা, তুই-তোকারি, গালাগালি ইত্যাদির শত শত প্ররোচনাতেও দেশবাসী ভুল করেনি এই সৎ, কর্মঠ, স্বাস্থ্যবান চৌকিদারটিকে চিনে নিতে। তবে দেশ পরিচালনা তো একার কাজ নয়, এ এক সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াস। এটাও সত্য শাসকবর্গের ওপরতলার লোকেরা ভ্রষ্ট না হলে নীচের তলার লোকেরাও সাবধানে থাকে, লোভের ফাদে সহজে পা দেয় না। ফলে আশা করা যায় এই চৌকিদারের নেতৃত্বে দেশ এক ভ্রষ্টাচারমুক্ত শাসনতন্ত্র লাভ করল। কথাতেই আছে ভ্রষ্টাচার ধুয়া নহী আবশার (জলপ্রপাত) হ্যায়। ভ্রষ্টাচার ধোঁয়ার মতো নীচে থেকে ওপরে ওঠে না, জলপ্রপাতের মতো ওপর থেকে নীচের দিকে নামে। তাই ওপরতলায় ভ্রষ্টাচারমুক্ত মানুষজন থাকলে নীচের স্তরেও ভ্রষ্টাচারমুক্ত হবে।
দেশে সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের শান্তি ও নিরাপত্তায় কেন্দ্র জড়িত না থাকলেও মানুষ বোঝে কেন্দ্রের সূক্ষ্ম নিয়ন্ত্রণেই দেশবাসীর আর্থিক ও সামাজিক স্থিতাবস্থা অনেকাংশে নির্ভর করে। কেন্দ্রে এক মজবুত সরকার থাকলে স্থানীয় রংবাজ ও তোলাবাজেরাও কিয়দংশে স্থানীয় প্রতিনিধিদের সতর্কতার কারণে নিয়ন্ত্রিত থাকে। হয়তো তার ফলে তোলাবাজেরা আর নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোসকে তোলা দিতে তলব করবে না, হয়তো শেষ বয়সে সারাজীবনের সঞ্চয় একত্র করে মধ্যবিত্ত মানুষ একটি মাথা গোঁজার ঠাই তৈরি করতে গিয়ে সিণ্ডিকেটকে তার সঞ্চয়ের একটা বিরাট অংশ দিতে বাধ্য হবে না। হয়তো এর ফলে বৃদ্ধ পিতা-মাতা বাড়ি বন্ধক রেখে দূরে থাকা সন্তানের কাছে গেলে ফিরে এসে সদর দরজার তালা পাল্টে যাওয়ায় তা খুলে নিজের বাড়িতে ঢোকার জন্য বছরের পর বছর আদালতে ছোটাছুটি করে নিজেদের আয়ু ও ধনক্ষয় করবে না, গ্রামের পারিবারিক চাষের জমি, পুকুর, বাড়ি ক্লাবকে লিখে দিতেই হবে-এই আশঙ্কায় সব শরিকেরা একত্রে সেখানে যেতে ভয় পাবে না। পুলিশও হয়তো এবার সক্রিয় হয়ে নিজের কর্তব্য পালন করবে। মুষ্টিমেয় অথচ প্রভাবশালী মানুষের লোভ যে জনজীবনকে কতখানি অসহ করে তার পরিচয় রাজ্যবাসী পেয়েছে। এখানে মানুষের প্রাণ সুরক্ষিত নয়। তার সম্পদ, তার মাটি সুরক্ষিত নয়, সন্তানের কষ্টে মায়ের চোখ আর শুষ্ক থাকছে না। দূরে থাকা কাঠুয়া, কামদুনি বা দেগঙ্গার ঘটনা কাগজে পড়ে মানুষ যত কষ্ট পায় তার চেয়ে বহুগুণে মর্মস্পর্শী হয় তার বেদনা যখন সে ধরনের ঘটনা তার অথবা তার নিকট পরিজনের জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়। সদ্য অতীত হওয়া এই জনাদেশে মানুষের সে সব কষ্টই অভিব্যক্তি লাভ করেছে।
জনতা জনার্দনের নির্ণয়কে মর্যাদা দেওয়ার পালা এবার শাসককুলের। প্রভুত্ব লাভ করে যদি সপারিষদ চৌকিদার মশায় পঞ্চম রিপুদ্বারা আক্রান্ত হন তবে পাশা ওল্টাতেও আর দেরি হবে না। সচেতন জনতা পুনর্বার মতদানের সময়েই নিজেদের ত্রুটি সংশোধন করে প্রকৃত জনহিতৈষী সরকার গড়ার জন্য সচেষ্ট হবে। প্রভুত্বের মাদকতা সর্বকালে স্বীকৃত হয়ে আছে। গুরুবাণীতে আমরা পাই—
“এ্যায়সা কোউ জনমেউ জগ মাহী
প্রভুতা পায়ো পর মদ নাহী।”
প্রভুতা পেয়ে অহঙ্কার হয়নি এমন কেউ কি জগতে জন্ম নিয়েছেন? প্রভুতা পেয়েও সেবকের নম্রতা রক্ষা করা অতি কঠিন বস্তু। তবে মনে আশা জাগে আসন-প্রাণায়ামে শুদ্ধ মনে হয়তো প্রভুতা অহঙ্কার উৎপন্ন করতে ব্যর্থ হবে।
গত একবছরেরও বেশি সময় ধরে আমরা দেখেছি সংবাদ মাধ্যমগুলিতে গোরক্ষা ও গরুচুরি নিয়ে নানা উস্কানিমূলক সংবাদের ছড়াছড়ি। কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে কৃষকের সকল প্রচেষ্টা যেমন ফসল উৎপাদন ও তার রক্ষায় ব্যয় হয় তেমনই গোবলয়ের অর্থনীতিতে গোপালকদের সকল শক্তি ও প্রচেষ্টা ব্যয় হয় গোধন রক্ষায়। গোপালকদের সংসার প্রতিপালন, জীবনধারণ সবই নির্ভর করে তাদের গোধনের ওপর। সেখানে ভালো জাতের দুগ্ধবতী গাভীর মূল্য দুই লক্ষ টাকাও হয়। ফলে সেই মহামূল্য গোমাতা যদি চোর কর্তৃক নীত হন তবে তো গোপালকদের তা প্রীতি উৎপাদন করবে না। সংবাদ তৈরির সময়ে সংবাদনির্মাতারা বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন গোপালক এবং গোরুচোরের সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ওপর যা শতকরা নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়। সে সব সংবাদে গোবলয়ের অর্থনীতি, গোপালকের বিপন্নতা গুরুত্ব পায় না। সব গুরুত্ব অর্পণ করা হয়। গোপালক ও গোরুচোরের সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের ওপর। কয়েক মাস আগেই পাটনার কাছে এক গোরুচুরির ঘটনা ছিল চার লাইনের সংবাদে। কারণ সেখানে গোপালক ও গোরুচোর ছিল একই সম্প্রদায়ের। আবার গত মে মাসেই কাশ্মীরের ডোড়া জেলার ভাদেরওয়াতে গণপিটুনিতে এক ব্যক্তির মৃত্যুর সংবাদ গোপালকের হাতে গোরুচোরের মৃত্যুর কারণ তার অন্য সাম্প্রদায়িক পরিচয় বলে ছাপা হয়। কিছুদিন পরেই তা মিথ্যা ও সাজানো সংবাদ বলে প্রকাশ পায় ও সংবাদমাধ্যমগুলি এজন্য ভৎসিত হয়। আইন অমান্য করা হচ্ছে জেনেও ধরা পড়লে চোরের কপালে প্রচণ্ড মার জোটে। এটাই সাধারণ নিয়ম। এর ব্যতিক্রমও দেখা আছে। মাঝরাতে ধরা পড়া চোরকে থানায় নিয়ে গিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে চোখের সামনে। তবে গোরুচুরি নিয়ে পলিটিক্স হয়তো এবার শেষ হলো কারণ গোবলয়ে বিজয়ীদের তালিকা দেখলেই বোঝা যায় জনতাকে সাজানো তত্ত্ব গেলানো যায়নি।
চৌত্রিশ বছরের বামসরকারের সমাপ্তি ঘটিয়ে রাজ্যে পরিবর্তনের দূত হিসাবে যারা এল তাদের শাসনকালে তোলাবাজি ও সিণ্ডিকেটবাজি শহর-গ্রাম সর্বত্র যে শুধু বেড়ে গেছে তাই নয় এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে কাজ করা জনতাকে নির্ভয়ে স্বেচ্ছাচারিতা করতে দেওয়ার পলিটিক্স। তার ফলে সংগঠিত অত্যাচারের সম্মুখীন হচ্ছে সাধারণ মানুষ তো বটেই, ডাক্তারদের মতো বিশিষ্ট নাগরিকেরাও। পলিটিক্স কীভাবে রাজ্যে শিক্ষকদের মান ও শিক্ষার মান টেনে নামিয়েছে। তাও দেখা আছে। তার থেকে মুক্তির পথ জানা না থাকায় অসহায় রাজ্যবাসী সে সব শুধু দেখেই গেছে। চৌকিদারকে বহুমত সহ পুনর্বহাল করার অন্তরালে সেসব অবক্ষয় থেকে মুক্তির ইচ্ছা ও চেষ্টাও লুকিয়ে আছে। সবাই চৌকিদারের মাতৃমুক্তি পণের দিকে চেয়ে যে থাকবে।
দেশে, কি কেন্দ্রে বা কি রাজ্যে এতকাল সব সরকারই সংখ্যাগুরুদের শুধু ত্যাগস্বীকারে বাধ্য করেছে। আশা করা যায় এই সরকার দেশের সকল অধিবাসীকে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে ভ সমান সুযোগ ও সুবিধা দেবে। সংখ্যাগুরুরাও তীর্থ পর্যটনে আর্থিক সহায়তা পাবে, সংখ্যাগুরু । পুরোহিতেরা পুরোহিত ভাতা পাবেন, তাদের কে সন্তানদের আর অর্থাভাবে লেখাপড়া বন্ধ করে দিতে হবে না। পশ্চিমবঙ্গে ও অসমের মতো 3ে নাগরিক পঞ্জীকরণ হবে। দেশবিভাগের ফলে এ অসহনীয় অত্যাচার, লুণ্ঠন, হত্যার শিকার যে হওয়া, মাতৃভূমি ত্যাগ করে আসা মানুষেরা বি এখনও বহু সংখ্যায় জীবিত আছেন। তারা ও তা অন্যান্যরাও দেখতে পাচ্ছেন ভারতের এই প্রান্তে আবার দেশবিভাগের পূর্বের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দিকে দিকে খারিজি মাদ্রাসায় ে তৈরি হওয়া ছেলেমেয়েরা খাগড়াগড় ধরনের ৪ ভারতবিরোধী ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত হচ্ছে। যে পশ্চিমবঙ্গের পূর্বদিকের বর্ডার সংলগ্ন অঞ্চল স্ব থেকে সংখ্যাগুরুরা পলায়ন করছে। এইসব বা ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে যে মতদান তা করেছেন তার মর্যাদা দিতে হবে। এই নির্বাচনে অ বিজয়ী দলের প্রতিশ্রুতি ছিল সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি ঘটানো হবে। সেই প্রতিশ্রুতি যেন রক্ষা করা হয়।
বাঙ্গালির দেশাত্মবোধ শুধু ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্বেই দৃষ্টান্ত হবার যোগ্য। কাজে, ভাবনায়, সাহিত্যে, গানে, অঙ্কনে—জীবনের নানা ক্ষেত্রে সেই দেশাত্মবোধের যে প্রকাশ আজও দেখতে পাওয়া যায় তার তুলনা হয় না। হাসপাতালে শেষ শয্যায় শায়িত কবি রজনীকান্ত সেনের প্রায় লুপ্ত একটি লেখা সম্প্রতি পড়ার সৌভাগ্য হল। সেখানে তিনি সুহৃদবর শ্রীযুক্ত কুমার শরৎকুমার রায়বাহাদুরকে সম্বোধন করে লিখছেন—
“রোগশয্যেপরি,
গেঁথেছি এ ক্ষুদ্ৰমালা বহুকষ্ট করি;
ধর দীন-উপহার; সেই মোর শেষ;
কুমার! করুণানিধে। দেখো, র’ল দেশ।”
হাসপাতলের শেষ শয্যা থেকে কবি দেশের জন্য যে চিন্তা নিয়ে বিদায় নিয়েছিলেন তা এক কথায় অতুলনীয়। এইভাবে আজ প্রায় একশত দশ বছর পরেও বাঙ্গালিরা সেই ভাবনা হৃদয়ে বহন করেন। কোনও বাঙ্গালি কবি-লেখক কখনও বাঙ্গলার সত্তাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখেননি। আর আজ রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর গায়েই এক বিশ্ববিদ্যালয় রূপ পরিগ্রহ করছে যেখানে ভারতকে উহ্য রেখে বঙ্গ এখন বিশ্বের অংশ হতে চলেছে। কলকাতায় গড়ে উঠছে সিলিকন ভ্যালি অব এশিয়া। ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাকে তুলে ধরার ধারণা বাঙ্গালির প্রাণের ধারণা নয়। ভারতের প্রাচীন জ্ঞানভাণ্ডার, সেই দেশের নদী-পাহাড়-তীর্থস্থান সহ তার সমগ্র ব্যাপ্তি, তার বিচিত্র জন সমাবেশ, তাদের পোশাক-আহার-বাসগৃহ-সব কিছুর সঙ্গে একাত্ম হয়েই বাঙ্গালি এ যাবৎ নিজেকে দেখেছে। আজ হঠাৎ নানাদিকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার আশঙ্কাও এই মতদানের অন্তরালে কাজ করেছে।
দেশবাসীর বিপুল সমর্থন পেয়ে যিনি দেশের হাল ধরেছেন তার সরকারের থেকে দেশবাসী এক সুস্থ, সম্মানজনক ও নিরুদ্বিগ্ন জীবন আশা করে। আশা করে সবাই অন্তত পেটভরে আহার পাবে, শুদ্ধ পানীয় জল পাবে, স্বচ্ছনীল আকাশের নীচে দূষণমুক্ত শ্বাসযোগ্য বায়ু পাবে। এ কঠিন পথ রাত্রি নিশীথের অন্ধকারেই পাড়ি দিতে হবে। তবে জোয়ানরা আগুয়ান হয়েছে, সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে। তরী পারে যাবেই।
গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায়
2019-06-29