ইতিহাসের আলোকে ভারতীয় বিজ্ঞান

পিন্টু সান্যাল

যে কোনো সভ্যতা বিভিন্ন ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যেই কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এগিয়ে যায় কিন্তু সেই সভ্যতার প্রাচীন জ্ঞান তাঁর সংস্কৃতির মধ্যে স্থান পেতে থাকে। সেই রাষ্ট্রের সংস্কৃতিই , সেই রাষ্ট্রকে ভবিষ্যতের পথে আত্মবিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে যাওয়ার পাথেয় দেয়।

ভারতবর্ষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি সুপ্রাচীন। তাঁর একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস ভারতবর্ষের কলা , বিজ্ঞান , দর্শন এর বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির দলিল । কোনো সভ্যতাই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না , যদি না তার একটি সুগঠিত শিক্ষাব্যবস্থা অর্থাৎ পূর্বের অর্জিত জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মকে দেওয়ার ব্যবস্থা ও সাধারণের জীবনকে সমৃদ্ধশালী করার উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নতুন জ্ঞান আহরণ ও অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা না থাকে।
সেই দিক দিয়ে দেখতে গেলে , ভারতবর্ষের কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতাই প্রমাণ করে যে এই রাষ্ট্রের জীবন-দর্শন ও জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রটি যথেষ্টই উর্বর ছিল।
কিন্তু , ভারতবর্ষের ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে যে ; সম্পদ ও হাজার বছরের অর্জিত জ্ঞান রক্ষা করতে রাষ্ট্রশক্তির প্রয়োজন।আর এ কথা শুধু ভারতবর্ষের জন্য নয় , সমগ্ৰ বিশ্বের জন্যই সত্য।
আজ যে ভারতবর্ষ শত শত বৈদেশিক আক্রমণ সত্ত্বেও নিজের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে পেরেছে , তা বিশ্বের কাছে বিস্ময়ের। বিশ্বের অন্যান্য প্রাচীন সংস্কৃতিগুলি বর্বরতার সামনে অনেক আগেই আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।
কিন্তু , প্রশ্ন শুধু টিকে থাকার নয় ভবিষ্যৎ কে সমৃদ্ধশালী করার।আমরা আশা করি ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’। কিন্তু কিভাবে ?
ভারতবর্ষের মানুষ যদি নিজেদের সংস্কৃতি , জ্ঞান-বিজ্ঞান বিস্মৃত হয়ে পরানুকরণকেই শিরোধার্য করে তাহলে সে কি কখনো আত্মবিশ্বাসী , আত্মনির্ভর হতে পারবে ?
স্বাধীনতার পরেও আমরা রাষ্ট্র-পরিচালনার বিভিন্ন নীতি তে দেখেছি বৈদেশিক তত্ত্বের অনুকরণ। ভারতবর্ষের নিজস্ব জ্ঞান-বিজ্ঞান কে সামনে নিয়ে আসার , প্রয়োগ করার কোনো চেষ্টাই দেখা যায় নি। স্বাধীনতার পূর্বে ইংরেজরা ভারতবর্ষের ইতিহাস বিকৃত করে ; ভারতবর্ষের শিক্ষা , জ্ঞান-বিজ্ঞান কে ছোটো করে আমাদের আত্মবিশ্বাস কে ভেঙ্গে দিয়েছিল। তাদের সেই প্রয়োজন ছিল কারণ ভারতবর্ষ কে পরাধীন করে রাখতে হতো।তাই ভারতবর্ষের সংস্কৃতি , বিজ্ঞানের উৎকৃষ্টতা স্বীকার করতে তাদের বাঁধবে বৈ কি। কিন্তু স্বাধীনতার পরেও একই চিত্র দেখা গেলো কেনো?কারণ স্বাধীনতার পরেও দেশের শাসন ক্ষমতা তাদের হাতে এসে পড়লো যারা ‘মেকলীয় শিক্ষায় শিক্ষিত’ বহিরঙ্গে ভারতীয় কিন্তু আচার-আচরণে , চিন্তাধারায় ইংরেজ।

বর্তমানেও দুই ধরনের চিন্তাবিদদের দেখা যাচ্ছে।যারা ভারতবর্ষের প্রাচীন জ্ঞান-পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং অন্য পক্ষ সারাক্ষণই ভারতবর্ষের প্রাচীন বিজ্ঞান, সংস্কৃতি কে পশ্চিম বিশ্বের থেকে নিকৃষ্ট মনে করেন এবং সামাজিক , রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিদেশীয় তত্ত্বকে প্রয়োগের কথা বলেন।
বিদেশীয় তত্ত্বের অনুকরণকারী এইসব ‘ভারত-বিভাজনকারী’ (Breaking India) শক্তি ‘আর্য-অনার্য তত্ত্ব’ এর প্রচার করেন এবং আর্যদের বহিরাগত বলে দেশের মধ্যে বিভাজন করতে চান।এর ফলে একইসাথে তারা দুটো উদ্দ্যেশ্য সাধন করতে চান।
১) তথাকথিত আর্যদের সঙ্গে জড়িত সমস্ত জ্ঞানের উৎস কে ভারতবর্ষ-বহির্ভূত দেখিয়ে , প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব কে মিথ্যা প্রমাণ করা।

২)আর ভারতবর্ষের মধ্যে আর্য ও অনার্য নামে দুই শ্রেণীর অস্তিত্ব প্রমাণ করে , ভারতবর্ষের মানুষের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিভাজন করার চেষ্টা করেন।
এতে করে , তাদের দ্বারা প্রচারিত বৈদেশিক তত্ত্ব ও সংস্কৃতির বীজ বপন করতে তাদের সুবিধা হবে।

এছাড়াও ভারত-বিভাজনকারী(Breaking India) অপশক্তি গোষ্ঠিটি আরো কয়েকটি আঙ্গিকে নিজেদের উদ্দ্যেশ্য সাধন করতে চায়।যেমন
১) ভারতীয় শাস্ত্র এবং শাস্ত্র গুলিতে বর্ণিত ঘটনাবলীর সময়কাল কে কয়েকশতাব্দী এগিয়ে নিয়ে এসে সেগুলির প্রাচীনত্বকে খর্ব করার প্রয়াস চালিয়ে যান যাতে করে এই সত্য কে ভুল প্রমাণিত করা যায় যে , মানব ইতিহাসের জ্ঞানের যাত্রা ও সর্বোত্তম বিকাশ ভারতবর্ষে সম্ভব হয়েছে।
২) ভারতের দুই মহাকাব্যের ঐতিহাসিকতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ‘রামায়ণ’ ও ‘মহাভারত’ কে শুধুমাত্র ধর্মগ্ৰন্থ বলে উল্লেখ করে মহাকাব্যের ঘটনাবলী কে কাল্পনিক প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যাতে করে ভারতবর্ষের সংস্কৃতির সঙ্গে এদেশের মানুষের বিচ্ছেদ হয়।

৩) বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণের বিপক্ষে গিয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার যা ভারতবর্ষে হয়েছিল তার কৃতিত্ব ইউরোপীয়ান দেশগুলোকে দিয়ে , ভারতবর্ষকে নিজের গৌরবময় অতীত থেকে দূরে রাখা যাতে এই দেশ তার আত্মবিশ্বাস হারিয়ে পরাণুকরণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন….
“ইংরেজরা আমাদের দেশের যে ইতিহাস লিখেছে তাতে আমাদের মনে দূর্বলতা না এসে যায়না। কেননা , তারা শুধু আমাদের অবনতির কথাই বলে।যেসব বিদেশীরা আমাদের রীতিনীতির , আমাদের ধর্ম ও দর্শন এর সঙ্গে অতি অল্প পরিচিত , তারা কেমন করে বিশ্বাস্য ও নিরপেক্ষভাবে ভারতের ইতিহাস লিখবে? কাজেই স্বভাবতঃই বহু ভ্রান্ত ধারণা ও অপসিদ্ধান্ত এসে পড়ছে।”
(যুগনায়ক বিবেকানন্দ , প্রথম খন্ড , পৃষ্ঠা : ৩১২)।
স্বাধীনতার আগে ইংরেজরা সুপরিকল্পিতভাবে ভারতবর্ষের বিকৃত ইতিহাস রচনা করেছিলো এবং Max Muller কে এই কাজের জন্য নিয়োগ করেছিলেন।
Max Muller কে ইংরেজরা নিয়োগ করেছিলো বেদ , উপনিষদ তাদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করে ভারতীয়দের খ্রিষ্টীয়করণ করতে।Max muller নিজের স্ত্রী কে লেখা একটি চিঠিতে সে কথা স্বীকার করেছেন।
Max Muller বলেছিলেন “India has been conquered once, but India must be conquered again, and that second conquest should be a conquest by education”।আর সেই শিক্ষা কি হবে ?
ভারতীয়দের মনে তাদের সংস্কৃতি সম্বন্ধে অবজ্ঞা ভরে দেওয়ার শিক্ষা। সংস্কৃতে লিখিত বিভিন্ন শাস্ত্রে বর্ণিত ভারতীয় বিজ্ঞানের নাগাল যাতে ভারতীয়রা না পায় , তার জন্য সংস্কৃত ভাষাটাকেই বিলুপ্তির পথে নিয়ে যাওয়া।
মেকলীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ভারতীয়রাও সেই একই কাজ করে যাচ্ছে।

কিন্তু আশার আলো কি নেই? আছে।
‘ভারত-বিভাজনকারী’ অপশক্তির বিরুদ্ধে একটি ‘ভারত-নির্মাণকারী'(Making India) শুভশক্তির জাগরণ ঘটেছে।
যারা বৈজ্ঞানিকভাবে ইউরোপীয়ানদের দ্বারা প্রচারিত সমস্ত মিথ্যা কে বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন এবং ভারতবর্ষের নিজের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি বিশ্বাস জনমানসে বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছেন।
যেমন Max muller বেদে উল্লিখিত ‘সরস্বতী’ নদীর অস্তিত্ব কে অস্বীকার করলেও এখন সেই নদীর অস্তিত্ব প্রমাণিত।
এইভাবেই একে একে আর্য-অনার্য তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হচ্ছে , জ্যোতির্বিজ্ঞান এর সাহায্যে রামায়ণ-মহাভারত এর ঐতিহাসিকতা প্রমাণিত হচ্ছে।
আর বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইউরোপীয়ানরা নিজেদের যে শ্রেষ্ঠত্বের গল্প এতদিন প্রচার করেছে তাও ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। প্রমাণিত হচ্ছে যে বিজ্ঞানের যাত্রা আমাদের পূণ্যভূমি এই ভারতবর্ষেই প্রথম শুরু হয়েছিল। শুধু তাই নয় , ইউরোপীয়ান দেশগুলোর আজ যে বৈজ্ঞানিক অগ্ৰগতি তা সম্ভব হয়েছে কেবলমাত্র ভারতবর্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রাপ্ত জ্ঞানের জন্যই।সে সত্য তারা নিজমুখে স্বীকার করবেন না কিন্তু সত্যের স্বাক্ষী আকাশের নক্ষত্রেরা।
ভারতবর্ষের সংস্কৃত ভাষায় লিখিত বিভিন্ন শাস্ত্রের সেই বিজ্ঞান কে আমাদের জানতে হবে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে জানাতে হবে।

পাশ্চাত্যের ঐতিহাসিকরা নিজেদের মতো করে ইতিহাস বিকৃত করে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে বিজ্ঞানের সাধনা ইউরোপে(বিশেষতঃ গ্ৰীসে) শুরু হয়েছিল এবং বাকি বিশ্ব গ্ৰীস সহ অন্যান্য দেশের কাছে ঋণী। কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর একটু বুদ্ধিদীপ্ত পর্যবেক্ষণ উল্টো কথা বলে।ইতিহাস কে এবং বিশেষ করে বিজ্ঞান-সাধনার ইতিহাস কে ক্ষমতা দখলের অস্ত্র হিসেবে কিভাবে ব্যবহার করা যায় , তার উদ্ভাবন অবশ্যই ইউরোপে হয়েছিল। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ একটি জাতি যদি , বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি না নিয়ে , বিজয়ী জাতির তৈরি বিকৃত ইতিহাসে বিশ্বাস করে নিজেদের মধ্যে হীনমন্যতাকে বাসা বাঁধতে দেয় , তাহলে রাজনৈতিক ভাবে স্বাধীন হয়েও মানসিকভাবে পরাধীনতার শৃঙ্খলে চীরকাল আবদ্ধ থেকে যায়। মানসিক ঔপনিবেশিকতার দশা তার আর কাটে না।

তাই রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে সাথেই প্রয়োজন বিজ্ঞানের সঠিক ইতিহাস জানা।
ভারতীয়রা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কতটা এগিয়ে ছিল , এবং ভারতবর্ষের বিজ্ঞান ও দর্শন ইউরোপীয়রা কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করেই কিভাবে নকল করে নিজেদেরকে সেইসবের আবিষ্কর্তা বলে মিথ্যা প্রচার করেছিলো, তারই কিছু উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরবো।

ভারতীয় বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের সবক্ষেত্রেই কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল।আমরা , আমাদের আলোচনা মূলতঃ জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে করবো।কারণ , জ্যোতির্বিজ্ঞান এর সাফল্য পরোক্ষভাবে গণিতে ভারতীয়দের সাফল্য প্রমাণ করে।আর ভারতবর্ষের প্রাচীন পুঁথি গুলিতে উল্লিখিত বিভিন্ন জ্যোতির্বিজ্ঞানের পর্যবেক্ষণের তথ্য একদিকে যেমন পুথিগুলিকে একটি বিজ্ঞানের গ্ৰন্থ বলে উল্লেখ করে আবার ঐ সমস্ত জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্য থেকেই গ্ৰন্থগুলির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়।
ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের পুঁথিগুলিকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয় ,১) সিদ্ধান্ত ২) তন্ত্র ৩) কারণ।
সিদ্ধান্ত তে জ্যোতির্বিজ্ঞানের মূলনীতি এবং সম্পূর্ণ তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। এর মধ্যে সাধারণ উদাহরণ , ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্বন্ধে কিছু বলা হয় না এবং এটি সম্পূর্ণরূপে গণিতজ্ঞ এবং জ্যোতির্বিদ এর উদ্দ্যেশ্যে লেখা।
কারণ শ্রেণীর গ্ৰন্থগুলি সাধারণ গ্ৰাম্য জ্যোতির্বিদ এর উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য লেখা।কারণ , খুব সংক্ষিপ্ত আকারে , প্রচুর উদাহরণ সহ সাধারণের জন্য সহজবোধ্য ভাষায় রচিত। তন্ত্র শ্রেণীর পুঁথি গুলির বৈশিষ্ট্য সিদ্ধান্ত ও কারণের মাঝামাঝি ।

জ্যোতির্বিজ্ঞানের কমপক্ষে ১৮ টি ‘সিদ্ধান্ত’ গ্ৰন্থের কথা জানা যায় , যার মধ্যে একমাত্র ‘সূর্যসিদ্ধান্ত’ ছাড়া বাকিগুলি হারিয়ে গিয়েছে।
একটি শ্লোকের মাধ্যমে এই ১৮ টি বই এর নাম বলা হয়েছে।
सूर्यः पितामहो व्यासो वसिष्ठोऽत्रि पराशरः ।
कश्यपो नारदो गर्गो मरीचिर्मनुरङ्गिराः।।
लोमशः पौलिशश्चैव च्यवनो यवनो भृगुः ।
शौनकोऽष्टादशश्चैते ज्योतिःशास्त्र प्रवर्तकः ।।
এগুলি হলো- ১)সূর্য-সিদ্ধান্ত ২)ব্রক্ষ্ম-সিদ্ধান্ত ৩) সোম-সিদ্ধান্ত ৪) মনু-সিদ্ধান্ত ৫) গর্গ-সিদ্ধান্ত ৬)অঙ্গিরাস-সিদ্ধান্ত ৭) চবন-সিদ্ধান্ত ৮)পোলিশ-সিদ্ধান্ত ৯) আত্রি-সিদ্ধান্ত ১০) মারিচী-সিদ্ধান্ত ১১) ব্যাস-সিদ্ধান্ত ১২) যবন-সিদ্ধান্ত ১৩) লোমস-সিদ্ধান্ত ১৪)কাশ্যপ-সিদ্ধান্ত ১৫)নারদ-সিদ্ধান্ত ১৬) পরাশর সিদ্ধান্ত ১৭) বশিষ্ঠ-সিদ্ধান্ত ১৮) ভৃগু-সিদ্ধান্ত।

ভারতীয় সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্ৰন্থ বেদ।চারটি বেদের মধ্যে সবথেকে পুরনো ঋগ্বেদ থেকে বছরের ৩৬০ দিনের কথা জানা যায়। যজুর্বেদ এ চান্দ্র বছর ৩৫৪ দিন এবং সৌর বছর ৩৬৫ দিন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
যজুর্বেদ এ ২৭ টি নক্ষত্র সজ্জার কথা পাওয়া যায়।যে বইগুলো তে এইরকম Astronomical observation সম্পর্কে লেখা আছে , সেগুলো কে কি শুধুমাত্র ধর্মীয় বই বলা যায়?

লগধার বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এ উল্লিখিত জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্য থেকেই অনুমান করা হয় এটি ১২শ থেকে ১৪শ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে রচিত।
কোনো নক্ষত্রের স্বাপেক্ষে পৃথিবীর নিজ অক্ষে সম্পূর্ণ আবর্তন এর সময়কাল ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট ৪.৬ সেকেন্ড আর বর্তমানে গৃহীত সঠিক সময় ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট ৪.০৯১ সেকেন্ড।
বেদাঙ্গ জ্যোতিষ এ সূর্যের অয়নয়ন ও বিষুব অবস্থান আলোচনা করা হয়েছে।

ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে ইউরোপীয়দের আগ্রহ অষ্টাদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীতে বৃদ্ধি পায় যখন ব্রিটিশরা এদেশে উপনিবেশ স্থাপন করে তাদের সংস্কৃতি ও উপাসনা পদ্ধতি ভারতবর্ষে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করছে।
ইউরোপে ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত নিয়মগুলি প্রথম প্রকাশ করেন Jean Dominique Cassini।
হ্যাঁ , সেই ক্যাসিনি যার নামে নাসা ও ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ক্যাসিনি-হাইগেনস মিশনে ক্যাসিনি মহাকাশযান মহাকাশে পাঠিয়েছে।
ক্যাসিনির হাতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্য পৌঁছালো কি করে ?
১৬৮৭ সালে বর্তমান থাইল্যান্ডের সিয়ামে একজন ফরাসি দূত পৌঁছায়।তার হাত ধরেই অন্যান্য অনেক মূল্যবান সামগ্রীর সাথে ঐদেশের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর কিছু পান্ডুলিপি পৌঁছায়।এই রহস্যময় পাণ্ডুলিপি বেশ কিছুকাল ফ্রান্সের Royal archieve এ ধুলো বালির মধ্যে পড়ে থাকে।সেখান থেকেই কোনোভাবে তা ক্যাসিনির হাতে পৌঁছায়।এই পান্ডুলিপি সিয়ামের প্রধান পান্ডুলিপির কিছু অংশমাত্র ছিল। কিন্তু ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর গভীরতা সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট। ক্যাসিনি ঐ পান্ডুলিপির ফরাসী অনুবাদ দীর্ঘ সময় ধরে ধৈর্যের সঙ্গে পড়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের খুঁটিনাটি আয়ত্ত করেন ।
ক্যাসিনি কে এখন ‘ইউরোপের প্রথম জ্যোতির্বিজ্ঞানী’র সম্মান দেওয়া হয়।

ক্যাসিনি ঐ পান্ডুলিপি সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন “These rules are extraordinary. They make no use of tables ,but only of the addition ,subtraction , multiplication and division of certain numbers of which we do not presently comprehend the basis of not to what these numbers refer”.
অর্থাৎ , ক্যাসিনি নিজে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের নিয়মগুলির প্রশংসা করে স্বীকার করছেন যে তিনি তা বুঝতে পারছেন না।
ক্যাসিনি আরো বলেন “These rules are ingenious and once understood clearly and purged of needless superficiallities , they should prove useful to us in Europe , since they are easy to apply without the need of books(tables)”.
ইউরোপের মহাকাশ গবেষণায় আজ যা সাফল্য তার পেছনে ক্যাসিনির অবদান ইউরোপ স্বীকার করে ।আর ক্যাসিনি নিজে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের তত্ত্ব ইউরোপের কাজে লাগানোর কথা বলছেন। তাহলে ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর প্রভাব থেকে ইউরোপ কে কিভাবে মুক্ত বলা যায় ?

অন্যদিকে , আমাদের নিজেদের দেশে বিজ্ঞানে গ্রীস ও অন্যান্য দেশের কৃতিত্ব প্রচার করা হয় আর ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নাম পর্যন্ত আমাদের বর্তমান প্রজন্ম জানে না।

একজন জার্মান শিক্ষাবিদ Theophilus Siegfried Bayer ।যার পড়াশোনা ও গবেষণার বিষয় ছিল চীন এবং ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের গ্ৰিক সাম্রাজ্য নিয়ে। ভারতবর্ষের দক্ষিণ প্রান্তের তামিল রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারতবর্ষের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর বিষয়ে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এবং তার লেখা বিভিন্ন চিঠি থেকে গ্ৰিকদের জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে যে গল্প এতদিন প্রচারিত হয়েছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয়।
Kogler ও Pereira নামের দুই খ্রিষ্টান মিশনারী কে একটি চিঠিতে Bayer লিখছেন ” the Greeks received much of their astronomical knowledge from India , and it would be wonderful if there was evidence of China also being a source”.
অর্থাৎ , তিনি সন্দেহাতীতভাবে ভাবে গ্ৰিকদের জ্যোতির্বিজ্ঞান এর জন্য ভারতবর্ষের কাছে ঋণী বলছেন।

ডেনমার্কের এক খ্রীষ্টান মিশনারী , নাম C.T Walther এর থেকে পাওয়া ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান এর কিছু তথ্য নিয়ে Bayer পৌঁছলেন Leonhard Euler এর কাছে।
কে Euler?
যাদের স্নাতক স্তরে বিষয় হিসেবে অঙ্ক ছিল , তারা নিঃসন্দেহে নামটির সঙ্গে পরিচিত। Euler , সর্বকালের সেরা গণিতজ্ঞ কিনা এই নিয়ে বিতর্ক হতে পারে।Euler এর প্রতিদ্বন্দ্বী কারা ? Newton , Gauss এনারা।এই হচ্ছে Euler এর খ্যাতি।Bayer এর বই ‘On the solar year of Indians’ এর Remark এ Euler ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

Euler এর কয়েকদশক পর ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দে French academy of Sciences এর Joseph Lisle এর হাতে ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের দুই সেট পান্ডুলিপি পৌঁছালো। কিভাবে পৌঁছালো?
আবার সেই খ্রিস্টান মিশনারিদের হাত ধরে।
প্রথম টা ‘পঞ্চাঙ্গ শিরোমণি’ ভারতবর্ষ থেকে পাঠালেন Father Patlouillet ।
দ্বিতীয় সেট Father Xavier Du Champ এর থেকে Father Antoine Gaubil (French) যিনি চীনে খ্রীষ্টের উপাসনা পদ্ধতির প্রচারে লেগেছিলেন।

Gaubil এর থেকে পৌঁছায় প্যারিসের Royal academy of sciences এর Lisle এর কাছে।
পৌঁছালো ঠিকই । কিন্তু এই পান্ডুলিপি কে বুঝতে প্যারিসের বিজ্ঞান মন্দিরের লেগে গেলো কয়েক দশক।ফরাসী জ্যোতির্বিজ্ঞানী Jean Sylvain Bailly এগুলোর পাঠোদ্ধার করেন।

তাহলে আমরা কি দেখলাম ? একদিকে খ্রীষ্টান মিশনারীরা এদেশের বেদ-উপনিষদ এর ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্ম থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে আর অন্যদিকে বেদ-বেদাঙ্গের মাধ্যমে যে জ্যোতির্বিজ্ঞান এর জ্ঞান বিকাশ লাভ করেছে , তা ইউরোপে পাচার করছে।
ভারতবর্ষে এসে নিজেদের ভাষা , সংস্কৃতি এদেশের মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা ।আর যে ভাষা কে কেন্দ্র করে , যে সংস্কৃতির হাত ধরে আমাদের বিজ্ঞানের জগতে এই অগ্ৰগতি তা থেকে দূরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা।

Sir Isac Newton । বিজ্ঞানের সঙ্গে যুক্ত নয় এরকম মানুষও নিউটনের নাম শুনেছেন।Newton অত্যন্ত বিনীতভাবে একবার বলেছিলেন তিনি বিজ্ঞানের আকাশে যে এত কিছু দেখতে পেয়েছেন , তার কারণ তিনি বিজ্ঞান-গবেষণার ক্ষেত্রে দুই দৌত্যের কাঁধে চেপে দেখেছিলেন। সেই দুই বিজ্ঞানী গ্যালিলিও ও কেপলার।
গ্ৰহদের গতি সংক্রান্ত কেপলারের তিনটি সূত্র সম্পর্কে আমরা সবাই জানি।
কেপলার , ছিলেন Tycho Brahe নামে এক ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানীর ছাত্র। কেপলারের অসাধারণ গাণিতিক দক্ষতার জন্য Tycho Brahe গ্ৰহদের গতি সংক্রান্ত তার মডেল কে ব্যাখার দায়িত্ব কেপলার কে দিয়েছিলেন।

Tycho Brahe র কয়েক শতাব্দী আগে একই ধরনের মডেল আবিষ্কার করেন কেরালার জ্যোতির্বিজ্ঞানী Nilkantha Somayaji ।

Copernicus (১৪৭৩-১৫৪৩) এর নাম আমরা জানি।
ভূগোলের এর ছাত্ররা কোপারনিকাস এর সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু ভূগোলের পাঠ্যপুস্তকে কি নীলকণ্ঠের নাম তারা পায় ?
কেনো এই তুলনা বলি এবার।
নীলকন্ঠ(১৪৪৪-১৫৪৪) তাঁর সূর্যকেন্দ্রিক(Heliocentric) মডেল প্রকাশ করেন ১৫০১ সালে তাঁর ‘তন্ত্রসংগ্ৰহ’ বই তে।আর কোপার্নিকাস ১৫১৪ সালে তার বন্ধুকে লেখা একটি চিঠিতে প্রথম সূর্যকেন্দ্রিক মডেলের কথা বলেন এবং তার ৩০ বছর পর তার বইতে প্রকাশ করেন।

আমরা K.V Sharma(1919-2005) র নাম হয়তো শুনিনি। তাঁর নামে ২০০ বই আর প্রচুর গবেষণা পত্র বেরিয়েছে। কেরালার ঐতিহ্যশালী গাণিতিক জ্ঞান যা এখন Kerala School of mathematics নামে পরিচিত তার ওপর প্রোফেসর শর্মার কাজের জন্যই এখন Leibnitz series কে , কেরালার গণিতজ্ঞ মাধবাচার্যের(১২৩৮-১৩১৭) নামে Madhava-Leibnitz Series বলা হয়।Power Series expansion কে Madhava-Gregory Series বলা হয়।
আমাদের দেশে এইরকম হাজার হাজার প্রোফেসর শর্মা দরকার যারা আমাদেরই জ্ঞান , আমাদের কাছে পৌঁছে দিবে।
প্রোফেসর শর্মা হতে লাগবে এই দেশের বিজ্ঞানের ইতিহাসের জ্ঞান।এই দেশের সংস্কৃতির প্রতি অটুট বিশ্বাস।আর সেই সমস্ত প্রাচীন পান্ডুলিপি গুলো কে বোঝার ভাষা সংস্কৃত। আমরা আজ সংস্কৃত থেকে দূরে চলে এসেছি।তাই নিজেদের সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান থেকেও দূরে। আত্মবিস্মৃত হয়েছি।
অন্যদিকে আমাদেরই বেদ-উপনিষদের ভাষান্তর করে ইউরোপিয়ানরা সমৃদ্ধ হয়েছে।

আমরা জানি , প্রথম যান্ত্রিক কম্পিউটার বানান চার্লস ব্যাবেজ। কম্পিউটার এর কাজকর্ম যে ম্যাথামেটিক্যাল লজিক এর উপর নির্ভরশীল তাকে Boolean Algebra বলে। কম্পিউটার এর বিষয়ে যারা পড়াশোনা করেন তারা De Morgan’s theorem সম্পর্কে জানেন।
এই তিনজন Charles Babage , George Bole আর Morgan এর বিজ্ঞান এর বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দাতা ছিলেন George Everest। হ্যাঁ , যিনি ভারতবর্ষে Surveyor General of India হিসেবে কাজ করেছেন এবং Mount Everest এর নাম যার নামে রাখা হয়েছে। Bole এর স্ত্রী Marie Bole এর বিজ্ঞানের এক প্রবন্ধ ‘Indian Thought and Western Science in the Nineteenth Century (1901)’ থেকে জানা যায় যে Everest ভারতীয় ন্যায় দর্শন সম্পর্কে তার তিন ছাত্র কে জানিয়েছিলেন।এই ন্যায় দর্শন , কে ভারতীয় Mathematical Logic বলা যায়।

ইংরেজ শাসনকালে , এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা পরিবর্তন করে ম্যাকোলে যখন ইউরোপের জ্ঞানে ভারত কে সমৃদ্ধ করার কথা বলছেন , তখন ইউরোপীয়রা এদেশের শাস্ত্রীয় জ্ঞান বোঝার চেষ্টা করছেন।

১৮ শ শতাব্দীতে ইংরেজদের শাসনকালে , ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সার্জেন মহারাষ্ট্রের পুনা তে ভারতীয় পদ্ধতিতে নাকে অস্ত্রপোচারের কথা জানতে পারেন এবং তারা ১৭৯৪ সালে লন্ডনের Gentleman’s magazine এ ঐ পদ্ধতির ছবিসহ প্রকাশ করেন।
আমাদের পড়ানো হয় এডওয়ার্ড জেনার টীকাকরণ আবিষ্কার করেন।
কিন্তু ১৮শ শতাব্দীতে ব্রিটিশ আধিকারিকরা ভারতে গুটি বসন্তের টীকাকরণ পদ্ধতি দেখে অবাক হন যা ভারতবর্ষের কয়েক শতাব্দী ধরে প্রচলিত ছিল।লন্ডন কলেজ অফ ফিজিসিয়ান কে লেখা একটি চিঠিতে Holwell নামে এক ডাক্তার এই পদ্ধতির বর্ণনা দেন এবং নিজে এই পদ্ধতির প্রয়োগ করেন।

১৮শ শতকের ভারতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার এইরকম বিভিন্ন তথ্য দিয়ে ধর্মপাল ‘Indian Science & technology in 18th Century’ নামে একটি বই প্রকাশ করেন।এই সমস্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও , আমরা এখনো বিভিন্ন আবিষ্কারের কৃতিত্ব বিদেশীদের দিচ্ছি।

মহাঋষি সুশ্রুত এর ‘সুশ্রুত-সংহিতা’য় ১৮৪ টি অধ্যায় আছে যেখানে ১১২০ টি রোগের বর্ণনা ,৭০০ ভেষজ উদ্ভিদের কথা , ১২০ টি সার্জারি যন্ত্রের উল্লেখ ও তার মধ্যে ৫৬ টির বিশদ বিবরণ রয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের ‘Royal Australia College of Melbourne’ সুশ্রুত কে ‘Father of Surgery’ বলে উল্লেখ করে , তাঁর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষে আমাদের প্রাচীন ঋষিদের যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া হয় নি। আসলে , আমাদের সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে যে , আমরা সংস্কৃতে লিখিত যে কোনো শাস্ত্রকেই ধর্মের সঙ্গে যুক্ত করে দেখি।কিন্তু পশ্চিম বিশ্ব তা ভাবে নি।

গণিত , জ্যোতির্বিজ্ঞান , কৃষি , চিকিৎসা , ধাতুবিদ্যা সহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমন কোনো ক্ষেত্রই নেই যেখানে ভারতবর্ষ নিজেকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে নি।ভারত এর সম্পদশালী হওয়া এবং ভারতের সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে বৈদেশিক শত্রুর আক্রমণ এর অন্যতম কারণ ছিল ভারতীয় বিজ্ঞান।
তাঁরা একইসাথে এই দেশের বিজ্ঞান কে নকল করেছে আর ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চা কে ধ্বংস করেছে। যে সংস্কৃতি , যে শিক্ষাব্যবস্থা এই ধরনের বিজ্ঞানের অগ্ৰগতির ভিত্তি তার ক্ষতি করেছে।

আর আমরা এখন ইউরোপের বৈজ্ঞানিক অগ্ৰগতি দেখে কোনোরকম বিশ্লেষণ ছাড়াই তাদের জীবন পদ্ধতির অনুকরণ করছি। তাদের সমাজব্যবস্থার অনুকরণ করছি।কারণ , আমরা ভারতবর্ষের যা কিছু ভালো তা ভুলে গিয়েছি।
একটি দেশ কখনোই আত্মনির্ভর হতে পারে না , যতদিন না সে নিজের দেশীয় পদ্ধতিতে বিশ্বাসী হচ্ছে।
তাই , এখন প্রয়োজন বর্তমান প্রজন্মকে ভারতবর্ষের বিজ্ঞান সম্পর্কে , বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষের অবদান সম্পর্কে জানানো।
আর এই কাজটা ক্লাসরুম পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেন শিক্ষকরা‌।আর তার সাথে সাথে অভিভাবকরা। আজ সারা বিশ্ব যোগ কে আপন করে নিয়েছে। টুথপেস্টের একটি বহুজাতিক কোম্পানি কোলগেট ; ‘বেদশক্তি’ নামে নিজেদের একটি ব্রান্ড বের করে ‘বেদের জ্ঞান’ এর সমর্থন করছে।একটি ফিল্টার কোম্পানি , নিজেদের ফিল্টারে তামার সাহায্যে জলশোধন এর কথা বলছে যা ভারতীয়দেরর তাম্রপাত্রে জলপানের বহু পুরনো অভ্যাসকে বিজ্ঞানসম্মত বলে মেনে নেওয়ার আর একটি উদাহরণ। কয়েক হাজার বছরের এই সংস্কৃতির হাত ধরে , ভারতবর্ষ সমৃদ্ধ হবে তখনই যখন একজন ভারতীয় হিসেবে আমরা গর্ব করতে শিখবো।যখন , আমাদের জীবনচর্যা , সমাজব্যবস্থা নিয়ে আমাদের বিদেশের শংসাপত্রের প্রয়োজন হবে না। ভারতবর্ষের ষড়দর্শনের জ্ঞানসম্পদ শুধু এদেশের জন্য নয় , সারা পৃথিবীর সুখ ও শান্তির জন্য প্রয়োজনীয়।তাই শিক্ষক হিসেবে , অভিভাবক হিসেবে , একজন ভারতীয় হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মকে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যশালী জ্ঞানের সঙ্গে পরিচয় করানোর দায়িত্ব কি আমাদের নয় ?

বিজ্ঞান-ভারতী’র প্রতিষ্ঠা দিবস উপলক্ষে লিখিত

পিন্টু সান্যাল(Pintu Sanyal) , সহশিক্ষক(পদার্থবিদ্যা)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.