মৃত্তিকা-জননীর অকৃপণ স্তন্যরসে প্রতিপালিত মৃত্তিকাশ্রয়ী কৃষির সামূহিক সম্ভার হল জৈব ফসল বা অর্গানিক ক্রপ। এটিই হল প্রকৃত অর্থে ‘ধরণীর নজরানা’; এক শাশ্বত অচিন্ত্য বিস্ময়,যার দানে ভরে ওঠে দেবী অন্নপূর্ণার ভাণ্ডার, দেবী শাকম্ভরীর রকমারি সবজি। এই খাদ্যভাণ্ডার গড়তে ‘খোদার উপর খোদগারি’-র দরকার নেই। মাটির প্রাকৃতিক খাদ্যভাণ্ডারকে ব্যবহার করে যে ফসল উৎপাদিত হয় তাই প্রাকৃতিক শস্য। প্রকৃতিই তার সারের যোগানদার, মাটির স্বাভাবিক আর্দ্রতা তাকে রসসিক্ত করে, বৃষ্টির জল তার সেচের চাহিদা মেটায়, অণুখাদ্যের যোগান দিতে সহায়ক হয়ে ওঠে ভৌম জীবাণু-সমষ্টি, আর সর্বোপরি অফুরন্ত সূর্যালোকের সামীপ্য-সান্নিধ্য তার সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার সহায়ক হয়ে ওঠে।।
নির্মল বসুন্ধরার যা নিয়ত আশীর্বাদ, তারই খাদ্য-সংস্কৃতি হচ্ছে অর্গানিক ফুড। সহজ কথায় নিরাপদ আহার হল অর্গানিক ফুড। কোনও ধরনের কৃত্রিম সার বারাসায়নিক ব্যবহার না করেই সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসল হল অরগানিক সবজি ও শস্য। বীজ শোধন থেকে শুরু করে ফসলোত্তর প্রক্রিয়াকরণ বা প্রসেসিং এবং ফসল সংরক্ষণ বা প্রিজারভেশনে যদি রাসায়ণিকের ব্যবহার থেকে বিরত থাকা যায়, তবেই তৈরি হয় জৈব-ফসল।
অর্গানিক সবজি ও শস্য সম্ভার
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অর্গানিক ফসল উৎপাদন, বিপণন ও চাহিদায় সবচেয়ে বৃদ্ধি দেখা গেছে বেরি জাতীয় ফলের বাজারে; যেমন স্ট্রবেরি, ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি ইত্যাদি। একটি পরিসংখ্যান বলছে, সেখানে অর্গানিক বেরি উৎপাদন মোট অর্গানিক ফসলের প্রায় ২৩ শতাংশ। এছাড়া সেদেশে এবং পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশে অর্গানিক কলা, আপেল এবং স্যালাডের চাহিদা বেশি। অনেক ফল, সবজির মধ্যে, যেমন টম্যাটো, গাজর, বীট, মটরশুঁটি, পেঁয়াজ, মূলো, লেটুস, স্যালারি, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা প্রভৃতি, কাঁচা খাওয়া হয়, তাই তা জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা হলে মানুষ সরাসরি কৃষিবিষ থেকে রেহাই পাবেন।
ভারতবর্ষ সমেত নানান দেশের প্রধান খাদ্য ভাত, রুটি এবং আলু, তাই এই খাদ্যগুলিও যাতে বিষমুক্ত করা যায়, তার চেষ্টা শুরু হয়েছে সারাবিশ্বেই। সেইসঙ্গে নানান সবজি, দুধ, মাছ, মাংস যাতে কীটনাশকের অবশেষ-মুক্ত রাখা যায় তার প্রচেষ্টাও যথেষ্ট হয়েছে। তাই নানান দেশের শপিংমলগুলিতে অর্গানিক প্রোডাক্ট বিপণন করা হচ্ছে।
অর্গানিক সবজি ও শস্য কেন?
অর্গানিক কৃষিপণ্য খাব পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের স্বার্থে এবং সপরিবারে-সবান্ধবে বাঁচতে এবং বাঁচাতে। আমরা দৈনিক খাদ্য গ্রহণ করি কেবল পেট ভরাতে নয়, কেবল পুষ্টি লাভ করতেও নয়, নীরোগ থাকতে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থেকে সাত্ত্বিক জীবনলাভ করতে। রাসায়নিক-কৃষি অনুসরণ করে সেই পরিবেশবান্ধব জীবনচর্যা সম্ভব নয়। দেহের কোষ-কলায়, নাড়িতে, স্নায়ুতে বিষের অবশেষ নিয়ে; বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলে সাত্ত্বিক জীবনলাভ সম্ভব নয়। প্রকৃতির মাঝে থাকা মানে প্রকৃতি-দত্ত কৃষি সামগ্রী ভোজন করা, কংক্রিটের জঙ্গলকেও যতটা সম্ভব সবুজে-শ্যামলে ভরিয়ে দেওয়া। আর সেজন্যই গাঁয়ের কৃষিক্ষেত্রটিকেই শুধু জৈবকৃষির আওতায় আনা নয়, শহর-নগর-রাজধানীর সূর্যকরোজ্জ্বল বিস্তীর্ণ ছাদ, বারান্দা, জানালার প্রান্তে সুযোগ মত সবজি ও ফলের গাছ লাগিয়ে তা জৈব-সম্মতভাবে চাষ করলে আমরা সরাসরি জৈব-কৃষিপণ্য পাব। এমনকি ঘরের ভেতরে সুযোগমতো মাশরুমের চাষও করে নিতে পারি।
রাসায়নিক চাষের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে মহিলাদের ব্রেস্ট-ক্যান্সারের মত মারণ রোগ, শিশুদের লিউকেমিয়া, বয়স্ক মানুষের রক্ত ও স্নায়বিক ব্যাধি। বাড়ছে চর্মরোগের প্রকোপ, টিউমার, জিনগত বৈষম্য, অন্তঃক্ষরা নানান গ্রন্থির সমস্যা।
রাচেল কার্সনের বিখ্যাত বই ‘সাইলেন্ট স্প্রিং’-এর মতো নীরব বসন্ত যেন পৃথিবীতে বিরাজ না করে রাসায়নিক কৃষির দৌলতে। এমন কৃষি চাই না যেখানে ফলের গাছে পাখির কূজন শোনা যায় না। এমন কৃষির প্রয়োজন নেই যেখানে ধরিত্রী বন্ধ্যা হয়ে ওঠে, রঙবেরঙের প্রজাপতি হারিয়ে যায়, কাঠবেড়ালির দেখা দুর্লভ হয় পড়ে, নানান মেরুদণ্ডী প্রাণীর জীবন বিপন্ন হয়। এমন কৃষি যদি আমরা সত্যিই না চাই তো জৈবকৃষির অভিমুখে পা বাড়াতে হবে, অর্গানিক সবজি ও ফসল ফলিয়ে খেতে হবে এবং খাওয়াতে হবে। আরও যেটা জানানোর তা হল, একমাত্র অর্গানিক পদ্ধতিতে চাষেই গাছের প্রয়োজনীয় সমস্ত খাদ্যোপাদান মাটিতেই বজায় থাকে, তাই উৎপাদিত ফসলের পুষ্টিগুণে থাকে সুষমতা।
শরীরের জন্য ভিটামিন, মিনারেল, ফাইটো-কেমিকেল, অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের যাবতীয় ভাণ্ডার, তারসঙ্গে কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাটের যাবতীয় যোগান পাবার একমাত্র ভরসা অর্গানিক ফুড।
অর্গানিক ফার্মিং একটি আন্দোলনের নাম
রাসায়নিক কৃষির মূল সমস্যা হল কীটনাশক কেবল নির্দিষ্ট কীটটিকেই মেরে ফেলে না, মারে অসংখ্য নির্দোষ জীবকেও। তাদের আবাসস্থলকেও বিষাক্ত করে তোলে।
টেকনিক্যালি একে বলা হয় নন-টার্গেট টক্সিসিটি বা লক্ষ্য-বহির্ভূত বিষক্রিয়া বা দূষণ। জেনে বা না জেনে এইভাবে আমরা রোজ সারা বিশ্বে অগুণতি জীবের মৃত্যু ঘটাচ্ছি, অথচ যাদের মারার কথা ছিল না। পরিসংখ্যানটা এইরকম–কীটঘ্ন প্রয়োগের ৯৮ শতাংশ এবং আগাছা-নাশকের ৯৫ শতাংশ তাদের আক্রমণের সীমানা ছাড়িয়ে অন্য প্রজাতিকে ধ্বংস করে।
জমি-জিরেতে যে কীটঘ্ন ব্যবহৃত হয় তা ছাপিয়ে চলে যায় বাস্তুতন্ত্রের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কিছুটা হাওয়ার তোড়ে, কিছুটা জলপ্রবাহে, কিছুটা মাটিতে মিশে। এক ক্ষেত থেকে অন্য ক্ষেত, অন্য চারণভূমি, মনুষ্য-বসতি, জলাশয়ে তা অনতিবিলম্বে ছড়িয়ে যায়। সমস্যা বাড়ে যখন কৃষিজীবী মানুষ এই কীটনাশকের অপব্যবহার করে। নির্ধারিত মাত্রার বেশি হারে তা প্রয়োগ করলে পরিবেশ দূষিত তো হয়ই, তার পরেও দেখা যায় পোকামাকড় ক্রমশ কীটনাশক-সহনশীল হয়ে যাচ্ছে, অনেক নতুন পোকামাকড় যা একসময় তেমন ক্ষতিকর বলে চিহ্নিত ছিল না, তাও নতুন করে ‘পেস্ট’-এর মান্যতা পাচ্ছে, মাইনর পেস্ট হয়ে যাচ্ছে মেজর পেস্ট। এ এক অভূতপূর্ব সংকট। ফলে কীটনাশক না বদলিয়ে, তার ডোজ না বাড়িয়ে সুরাহা হবার নয়। এ এক পরিবেশ দূষণের চ্যালেঞ্জ।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের একটি সমীক্ষায় জানা যায়, সেখানকার প্রায় সমস্ত নদীনালা কীটনাশকে দূষিত। ৯০ শতাংশ কূপের জল দূষিত। সেখানে ভৌম জলে এবং বৃষ্টির জলেও কীটনাশকের অবশেষ পাওয়া গেছে। যুক্তরাজ্যের সরকারি রিপোর্টেও প্রায় একই বার্তা। ভারতবর্ষেও যদি এমন সমীক্ষা করা যায় নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক ফল বেরোবে; প্রকাশিত অনেক ফলই তো আশঙ্কাজনক!
আর একটি সমীক্ষায় জানা গেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ৭২ মিলিয়ন পাখি কীটনাশক দূষণে মারা যায়। কৃষি দূষণে যুক্তরাজ্যের ১০ প্রজাতির ১০ মিলিয়ন পাখি মারা পড়েছে ১৯৭৯ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে। ইউরোপের ১১৬ প্রজাতির পাখি বিলুপ্ত হবার জন্য দিন গুনছে। খাবার ভেবে জমিতে পড়ে থাকা কীটনাশকের কয়েকদানা সরাসরি পেটে চলে যাওয়ায় মৃত্যু হয়েছে অসংখ্য ছোটো পাখির। ভারতবর্ষে চড়াই, দোয়েল, চাক দোয়েল, বুলবুলি, মুনিয়া, টুনটুনি, মৌটুসি প্রভৃতি পাখি হারিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আগামীদিনে নীরব বসন্ত বুঝি এভাবেই আসতে চলেছে।
সাধারণ সবজি ও শস্যের থেকে অর্গানিক শস্যের পার্থক্য
মূল পার্থক্য স্বচ্ছতায়, নির্মলতায় অথবা কলুষতায়। সাধারণ শস্যে কীটনাশকের বিষাক্ততার অবশেষ থেকেই যায়, কীটনাশকের প্রভাবে ফসলে প্রকাশ পায় কৃত্রিম ঔজ্জ্বল্য, অনেক সময় আবার ফসলের উজ্জ্বলতা বাড়াতেও রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করা হয়, চোবানো হয়নানান রঙে। অর্গানিক ফসল এই ক্লেদাক্ত রসায়ন থেকে মুক্ত, প্রকৃতির দানে ভরা ‘খাঞ্চা’। স্বচ্ছ ভারত যদি গড়তে হয় তবে কৃষিক্ষেত্রকে বিষমুক্ত করতে হবে, আর এই যুদ্ধ কোনও রাজনৈতিক লড়াই নয়, বাঁচবার লড়াই, এই স্বচ্ছতার লড়াই-এ সকল দেশবাসীকে সামিল হতে হবে।
জৈবপদ্ধতিতে চাষ করা মানে নানা উপায়ে কীট ও রোগকে এড়িয়ে চলা এবং অপ্রচলিত জৈবিক উপায়ে তাদের দমন করা। তাই চাষী যখন বাজারে নিজের হাতে চাষ করা খানিক-কীটদষ্ট বা তুলনামূলক নিষ্প্রভ জৈব ফসল নিয়ে আসেন তখন অনেক সময় ক্রেতার মন কাড়ে না। তবে অর্থকরীভাবে চাষ হওয়া জৈব ফসলে নিয়মিত পরিচর্যায় ও নজরে কীট ও রোগের প্রাদুর্ভাব থাকে না, ফলে উৎপাদিত সবজি ও ফলের নির্মল নিষ্কলঙ্ক ভাব ও ঔজ্জ্বল্য বজায় থাকে। নিজের বাড়িতে, ছাদে, বারান্দায়, আপনার কিচেন গার্ডেনে যে ফল ও সবজি জৈবিক উপায়ে ফলাবেন তাতে খানিক কীট-দংশিত অংশ ফেলে দিলেই বা ক্ষতি কী? কারণ এ ফসল তো আপনি নিজে উৎপাদন করেছেন, দেননি কোনও অজৈব সার, কীটনাশক, তাই তা এক দেবভোগ্য খাদ্য।
সবচেয়ে বড় কথা হল অর্গানিক ফসলের গুণমানের দিকটি। তাতে ফসলের নির্ধারিত পুষ্টিমান বজায় থাকে। রাসায়নিকভাবে চাষ করা জমিতে নানান অণুখাদ্যের অভাব পরিলক্ষিত হয়, তার অভাব ও আধিক্য জনিত লক্ষণও প্রকাশিত হয়। তাই সেই ফসলের পুষ্টিগুণ সুষম হতে পারে না। বোরন ও মলিবডেবামের অভাবী মাটিতে কীকরে উন্নত গুণমান সম্পন্ন ফুলকপি উৎপাদন হতে পারে? ফলে সেই মাটিতে তাদের অভাব-জনিত পুষ্টিগুণ অধরাই থাকবে। অর্গানিক ফসল বাজার থেকে বাড়িতে আনলে তা ধুলেও বেরোবে না কোনও কৃত্রিম রঙ, বেরোবে না কোনও তেলের আস্তরণ। তাই অর্গানিক ফসল মানে সাত্ত্বিক ফসল, তা প্রকৃতির পরম দান।
অর্গানিক সবজি ও শস্য রান্নার পদ্ধতি
অর্গানিক সবজি ও শস্য রান্নার একটা পদ্ধতি আছে এবং থাকাও উচিত। কারণ, জৈবিক পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্য বেছে বেশি দরে কিনলেই শুধু হবে না, তা এমনভাবে রাঁধতে হবে যেন তার পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। রান্নার পর সংরক্ষণ ঠিকমতো না হলেও খাবারের গুণমান বজায় থাকে না।
জৈবপণ্য দিয়ে যে খাবার তৈরি হবে তা যেন সহজপাচ্য হয়। খাদ্যের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সুগন্ধ যেন বজায় থাকে, আর বজায় থাকে দৃশ্য-নান্দনিকতা। ভাজাভুজিতে অনেক পুষ্টিমূল্যই দূর হয়, তাই সেদ্ধ করা রান্নার দিকে জোর দিতে হবে বেশি। সেদ্ধ-রান্না দু’ভাবে হয়–পর্যাপ্তভাবে নিমজ্জিত স্ফুটনাঙ্কের জলে অল্প সময়ে শাকসবজি সেদ্ধ করে রান্না করা এবং অল্প জলে বেশি সময় ধরে রান্না করা। এর মধ্যে প্রথম পদ্ধতিই অধিকতর শ্রেয়। কারণ ফুটে ওঠা জলে সবজি ফেলে রান্না করলে কম সময় তা আঁচে থাকে, আর কম আঁচ পাওয়া মানেই পুষ্টিদ্রব্যের কম অপচয়। দ্বিতীয়ত নিমজ্জিত ফুটন্ত জলে শাকসবজি থাকলে আলো ও বাতাসের সঙ্গে বিক্রিয়ায় তার নানান জৈবযৌগ কম বিনষ্ট হয়। এতে রান্নার পর তার বর্ণও হয় যথাযথ। রান্নার সময় অবশ্যই ঢাকনি ব্যবহার করা উচিত, তাতে খাবারের মধ্যস্থ ভিটামিন ও মিনারেল বা খণিজ লবণ অনেকাংশে অটুট থাকে। রান্নার সময় উৎপাদিত গ্যাঁজলা বা গাদ হাতা বা খুন্তি দিয়ে তুলে ফেললে রান্নার সঠিক রঙ বজায় থাকে। উচ্চ তাপে দ্রুত রান্না সেরে ফেলতে হবে। প্রয়োজনমতো সামান্য মশলাপাতি ব্যবহার করলেও খাবার সোডা ব্যবহার করা যাবে না, কেননা খাদ্যের ভিটামিন ও খনিজ লবণের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে তা গুণগত মান কমিয়ে দেবে।
রান্নার পূর্বেও দু একটি জিনিস খেয়াল রাখলে তাতে পুষ্টিগুণ বাড়ে। যেমন শাকসবজি আগেই ধুয়ে নিয়ে তবে কাটতে হবে। কাটার পর ধুলে তার অনেকটা পুষ্টিগুণ ধুয়ে বেরিয়ে যায়। অনেকে সময়াভাবে একদিন আগে সবজি, ফল, স্যালাড কেটে রাখেন। এটা একদম করা উচিত নয়। খোসা ফল ও সবজিকে বাইরের আলো আর বাতাস থেকে রক্ষা করে।
যদি অনেক আগে খোসা ছাড়িয়ে রাখা হয় তবে সবজি অতক্ষণ ধরে বাইরের আলো-বাতাসের সংস্পর্শে থাকায় অনুপযোগী রাসায়নিক বিক্রিয়ার মুখোমুখি হয় এবং তার ভিতরকার ভিটামিন আর মিনারেল নষ্ট হয় বেশি। তাই রান্নার ঠিক আগেই সবজি কাটতে হবে, খাবার পরিবেশনের ঠিক আগেই স্যালাডের কাটাকুটি করতে হবে, ফল কেটে দিতে হবে টেবিলে পরিবেশনের সময়েই। যত কম খোসা কাটা যায় ততই ভালো। কারণ, খোসার মধ্যে ভিটামিন, মিনারেল, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও ফাইটো-কেমিকালের একটি বড় অংশ রয়ে যায়। বাজার থেকে শাকসবজি আনার পর তা অন্ধকার অথচ ঠাণ্ডা জায়গা দেখে সাময়িক সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, ফ্রিজে না রাখলেই ভালো। এমনকি রান্নার পরও পঞ্চব্যঞ্জন অন্ধকার স্থানে ঢেকে রাখতে হবে। যে জলে শাকসবজি সেদ্ধ হল তা ফেলে না দিয়ে স্যূপ তৈরি বা গ্রেভি তৈরির জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই স্যূপ শিশু ও রোগীর জন্য একটি উপযোগী পানীয়।
অর্গানিক ফার্মিং-এ কী করবেন আর কী করবেন না
জৈবচাষে রসায়ন ব্যবহার নিষিদ্ধ। অজৈব-সার, রাসায়নিক কীটনাশক, রোগনাশক, মাকড়নাশক, কৃমিনাশক ব্যবহার না করে তার পরিবর্তে জৈবসার ব্যবহার করে এবং জৈব পদ্ধতিতে কীটপতঙ্গ, রোগজীবাণু, মাকড় বা মাইট, ফসলের কৃমি বা নিমাটোড দমনের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাই হল জৈব চাষ। তাতে কৃত্রিম হর্মোনের ব্যবহারও নিষিদ্ধ, নিষিদ্ধ জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বীজের ব্যবহার। তবে ফসল ফলাব কী করে?
ফসল ফলবে জমিতে, টবের মাটিতে নানান ধরনের জৈবসার প্রয়োগ করে। রোগ-পোকার আক্রমণকে প্রতিরোধ করতে হবে উদ্ভিজ্জ কীটনাশক বা বোটানিক্যাল পেস্টিসাইড ব্যবহার করে, কিংবা জীব-জাত বা জীবাণু কীটনাশক ব্যবহার করে এবং পরজীবী বা পরভোজী বন্ধুপোকাকে শত্রুপোকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করে।
কোথায় অর্গানিক সবজি ও শস্য পাব, কোথায় বেচব
সিকিমের মতো রাজ্য পুরোটাই অর্গানিক স্টেট বা জৈব-ফসল উৎপাদনকারী রাজ্যে পরিণত হলেও পশ্চিমবঙ্গ এ বিষয়ে তেমন এগিয়ে নেই। যদিও দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলার মানুষ ফসল উৎপাদনে জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশি। তবে রাজ্যের নানা অঞ্চলের মানুষ বিক্ষিপ্তভাবে জৈব ফসল চাষ করছেন। কোথাও একসঙ্গে বেশ কিছু চাষি সমবেত প্রয়াসে চাষ করছেন, কোথাও সমবায় সমিতির মাধ্যমে, কোথাও কোনও জৈবপণ্য বিপণন সংস্থার সহায়তায়, কোথাও সরকারি উদ্যোগে, কোথাও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা জৈব ফসল ফলাচ্ছে।
এ রাজ্যের মল বা বৃহৎ বিপণীকেন্দ্রে জৈব ফসল অধিক দামে বিক্রি হয়। কলকাতা মহানগরী সমেত বেশ কয়েকটি স্থানে জৈবহাট বসে। এছাড়া অন লাইন মার্কেটও ইদানীং ব্যাপকতা লাভ করেছে। কিছু সচেতন চাষী নিজের বাড়ির প্রয়োজনে নিজের দৈনন্দিন ফসল জৈবিকভাবে চাষ করে নিচ্ছেন। তার উদ্বৃত্ত সামগ্রী নিজের গাঁয়ে বা বাজারে নিয়ে যান। তবে জৈব সামগ্রী বেচাকেনার বাজার আজও তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। আমলাতান্ত্রিক সমস্যা ও দুর্নীতির অভিযোগও কোনও কোনো কৃষক ও কৃষি সংগঠন করেছেন।
বাড়িতে বা চাষের জমিতে অর্গানিক সবজি ও শস্য কীভাবে ফলাব
গ্রাম-বাংলার সমৃদ্ধির সঙ্গে আহার ও পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ থাকা উচিত। সমৃদ্ধি তখনই বলব যখন গ্রামবাসী রোজ দুবেলা পুষ্টিকর খাবার পাতে পাবেন। অনেক বাস্তুতেই আলগোছে এক-আধ কাঠা জমি পড়ে থাকে, কখনও তারও বেশি। আবাস-সন্নিহিত জমিটুকুকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবহার করে কিচেন গার্ডেন বা ঘরোয়া সবজি বাগান গড়ে তোলা যায়। কখনও তার লাগোয়া দু’টো একটা ছোটো মাপের ফলগাছ লাগালে, তা এক পরিপূর্ণ পুষ্টি বাগান বা নিউট্রিশনাল গার্ডেন হয়ে দাঁড়াবে।
সবজি বাগানে আটটি ছোটো প্লট বানিয়ে ফসল চক্র অনুসরণ করে সারা বছর ধরে সবজি লাগালে বাড়ির চাহিদা মিটবে। এই বাগানের বেড়াতেও উপযোগী লতানে সবজি তুলে দেওয়া যায়। বাগানে যদি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে জৈব পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়, তবে বাংলার মানুষ কৃষির রাসায়নিক দূষণ থেকে রেহাই পাবে। কারণ সবজি আর ফলেই সবচাইতে বেশি সার, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা হয়। শহরতলিতেও যাদের গৃহ-সন্নিহিত এক চিলতে জমি আছে; অথচ তাতে ভালো আলো-বাতাস খেলে, তারাও রচনা করতে পারবেন পুষ্টি বাগান। বাগানের বর্জ্য, গৃহের তরকারির খোসা, মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় ইত্যাদি ব্যবহার করে বাগানেই বানিয়ে নেওয়া যায় কম্পোস্ট সারের ভাণ্ড। গ্রামের মানুষ গোবর ও গোমূত্র ব্যবহার করে গোবর সার, তরল জৈবসার এবং কেঁচো ব্যবহার করে ভার্মি-কম্পোস্ট বা কেঁচোসার বানিয়ে এই পুষ্টিবাগানে প্রয়োগ করতে পারেন।
শহরের মানুষ কি অর্গানিক ফসল করতে পারবেন?
শহরের বাড়ির মালিক ছাদে, বারান্দায়, জানালার খাঁচায় জৈব বাগান তৈরি করতে পারেন। এমনকি ফ্লোর মালিকও পারেন তার বারান্দা বা জানালার খোপে টবে, বস্তায় বা বোতলে মাটি রেখে তাতে নানান ফসল ফলাতে। যেমন বস্তায় হলুদ, আদা; টবে লঙ্কা, ভিণ্ডি, ক্যাপসিকাম, বেগুন। এমনকি টবে লতানে সবজি যেমন লাউ, কুমড়ো, শসা, উচ্ছে লাগিয়ে তা জানালায় বা ছাদে লতিয়ে দিতে পারেন। ছাদে সামান্য মাটি ফেলে তাতে লালশাক, কাটোয়া ডাটা, ধনেপাতা, পুদিনাপাতা, মেথিশাক, পাটশাক ইত্যাদি চাষ করে নিতে পারেন। ছাদে বড় টবে মাটি রেখে আম্রপালি, মঞ্জিরা হাইব্রিড আম, বেঁটে জাতের পেয়ারা, ডালিম, করমচা, চেরি, মুসাম্বি, পাতি ও বাতাবি লেবু, সবেদা ইত্যাদি চাষ করে নিতে পারেন কোনোরকম কেমিক্যাল ব্যবহার না করে।