এই সমাজেই দিগন্ত’রা বিষ খেয়েও বেঁচে থেকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা হারাবে । এও তো এক মহাশান্তি শাসকের । নয় কি ?

মুম্বাইএ চালু হল লোকাল ট্রেন । ১০৯ টি মেন লাইন স্টেশন ও ৫৩ টি সুবর্বান রেল স্টেশনে অফ লাইন ডেস্ক চালু করে শুধুমাত্র যাঁদের দু ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া আছে তাঁদের জন্য । রেল চালু করল রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা মাফিক ।

সেই একই দিনে আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে বসে বললেন ৩১ আগস্ট পর্যন্ত লোকাল ট্রেন চলবে না বাংলায় । কেন ? না থার্ড ওয়েভের ভ্রুকুটি ।

ঠিক । মানুষের জীবনের থেকেও কি আর কিছু মূল্যবান আছে ? বা হতে পারে ? সমর্থন করেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায় যার উত্তর দেওয়ার দায় সরকারের এবং মুখ্যমন্ত্রীর ।

ট্রেন যখন বন্ধ রাখলেন বাস চালু রাখলেন কেন ? স্টাফ স্পেশ্যাল ট্রেনের মত স্টাফ স্পেশ্যাল বাসের ব্যবস্থা রাখতে পারতেন । বাসে ছাড়, ট্রেনেই যত বিপত্তি ! ট্রেনে গাদাগাদি হয়, বাসে হয়না, তাইতো ? বাসে চরম গাদাগাদি হচ্ছে কি না বাংলা সংবাদ মাধ্যম প্রথম দিকে দেখিয়ে এখন চেপে গেছে নবান্নের ধমকানি খেয়ে । বাস্তবতা বলছে তিন গুণ ভিড় হচ্ছে বাসে বিকল্প যান বাহন না থাকায় । তাতে সংক্রমণ হচ্ছে না বুঝি ? থার্ড ওয়েভ কি বাসকে ভয় পাচ্ছে ? না কি বাসগুলো সব থার্ড ওয়েভের রাস্তা পাশ কাটিয়ে গন্তব্যে যাচ্ছে ?

কে উত্তর দেবে ? কেই বা প্রশ্ন করবে ? নবান্নের লাইভ টেলিকাস্ট শো তে কখনো দেখেছেন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিদের এ নিয়ে প্রশ্ন করতে ? মুখ্যমন্ত্রী খুশী হন এ জাতীয় প্রশ্ন রেখে প্রতিদিন বিকেলের শো শেষ হয় । মানুষের দৈনন্দিন সমস্যা থেকেই যায় । নিত্য যাত্রীরা তিনটে বাস ছেড়ে চতুর্থটিতে প্রাণ হাতে নিয়ে ঝুলে পড়ে ।

তাহলে বিকল্প কি ? গ্লোবাল এডভাইসারি বোর্ডের কেউ বুদ্ধি দিয়েছেন ? জানা যাচ্ছে না । ১৫ দিন গেলেই বিধি নিষেধ প্রলম্বিত হচ্ছে শুধু এটুকুই কানে শোনা যাচ্ছে, চোখে দেখা যাচ্ছে ।

ওদিকে স্বাস্থ্য দফতর ৩১ জুলাই থেকে ৩ রা আগস্ট একটা সমীক্ষা করিয়েছিল । ৭১ হাজার ৪০৯ জনের মধ্যে সমীক্ষা করে দেখা গেছে ৩৪ হাজার ১৬১ জনের মুখে কোন মাস্ক আছে । আবার তার মধ্যে প্রায় ২২ হাজার মানুষ সঠিক ভাবে মাস্ক ব্যবহারই করেনি । আর প্রায় ৩৭ হাজার মানুষের মুখে কোন মাস্কই নেই । অর্থাৎ ৫২ শতাংশ মানুষ মাস্ক ছাড়াই রাস্তায় ঘুরছে ।

জুন মাসেই রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর এমন একটি সার্ভে করিয়েছিল । ৫১ হাজার ৯১৬ জনের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে জেনেছিল সেসময় ৫২ শতাংশ মানুষের মুখে মাস্ক ছিল । আর জুলাইয়ের শেষে সেটা নেমে এসে দাঁড়ায় ৪৭ শতাংশে । অর্থাৎ এই মুহূর্তে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে বাংলায় ৪৭ জন মাস্ক পরে, ৫৩ জন মাস্ক না পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে দিব্যি হাটে বাজারে, বাসে কিম্বা অন্যত্র ।

সংক্রমণের এই উৎস স্থল পারতো না সরকার বন্ধ করতে ? কঠোর থেকে কঠোরতম নির্দেশ দিতে এবং ব্যবস্থা নিতে ? পারতো, কিন্তু সস্তার জনপ্রিয়তার রাজনীতি তা করতে দেয়নি ।

তারওপর আছে তথ্য লুকিয়ে ভালো সাজার রাজনীতি । রাজ্যে করোনা টেস্টিং এভারেজ ইচ্ছে করে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল প্রতিদিন ৫৫ থেকে ৬০ হাজার যেখানে অসম পরপর টানা চার দিন করোনা টেস্টিং করিয়েছে দেড় লাখের ওপর । উত্তর প্রদেশ টানা করোনা টেস্টিং এভারেজ রেখেছে ১ লাখ ৭৫ হাজারের ওপর সেখানে আমরা রাজ্যে টেস্টিং আটকে রাখলাম ৬০ হাজারের মধ্যে । কেন ? কিসের জন্য ? কি বার্তা দিতে ? আমরা ভালো আছি এটা বোঝাতে ?

এই বোঝাতে গিয়ে আমরা প্রতি ১৫ দিন অন্তর ট্রেন বন্ধ প্রলম্বিত করছি । কাদের মারছি একবারও ভেবে দেখেছি ? সমাজের সব থেকে আর্থিক ভাবে দুর্বল মফস্বলের মানুষগুলো কি ভাবে বেঁচে আছে কেউ ভেবেছেন ? যারা ট্রেনে ঘুরে ঘুরে হকারি করতেন, যারা রেল স্টেশনে বসে হকারি করতেন, যে রিক্সা ওয়ালা, অটো চালক, টোটো চালক ট্রেন যাত্রীকে পৌঁছে দিতেন, যে মানুষটা ভোর ৬ টায় বেরিয়ে শহরের ছোট্ট একটা দোকানে কাজ করে শেষ লোকালে বাড়ি ফিরে ৬ জনের সংসার চালাতেন তারা কি ভাবে বেঁচে আছেন কেউ জানি ? কেউ খবর রাখি ?

সংবাদ মাধ্যমকে দেখেন এঁদের নিয়ে কিছু লিখতে ? পাতা জোড়া মুনাফা মেলা হাঁসি মুখের বিজ্ঞাপনে তাঁরাও ভুলে যান এই অন্ধকারের কথা বলতে । শাসককে সতর্ক করতে ।

তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন একটা এন জি ওর পাঠানো আমন্ত্রণপত্রের গুরুত্ব বোঝাতে । উচ্চকিত কণ্ঠে তার মাহাত্ম্য প্রচার করতে । আর ঠিক সেই সময়ে লুকিয়ে ভেতরের পাতায় সংবাদ ছাপতে হয় এদেরই যেখানে হেড লাইনে লেখা থাকে – সপরিবারে বিষপান, মৃত্যু গৃহ কর্তার । ভেতরে ছাপতে হয় স্ত্রী পূর্ণিমা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা কষছেন । হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে পার্ক সার্কাসের একটি বেসরকারি কলেজের প্রথম বর্ষের পড়ুয়া পুত্র দিগন্ত বলে ” বাবা সকালে আমাকে ও মাকে বিষ খেতে বলেছিল এবং নিজেও খেয়েছিল ।”

এই সমাজেই এখনও আমরা বেঁচে আছি । এই সমাজেই সরকার আমাদের দুয়ারে আসবে আমাদের ভিক্ষে দিতে । এই সমাজেই ভিক্ষে নিতে বেশ কিছু মানুষ লাইনেও দাঁড়াবে । এই সমাজেই দিগন্ত’রা বিষ খেয়েও বেঁচে থেকে প্রশ্ন করার স্পর্ধা হারাবে । এও তো এক মহাশান্তি শাসকের । নয় কি ?

আর এই মহাশান্তির কথাই উচ্চারণ করতে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রোমের উদ্দেশ্যে একটা ফ্লাইট ঢোল বাজানো বাংলা সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ে উড়ে যাবে মহাশূন্যে । বাংলায় বসে আমরা তার রানিং কমেন্ট্রি দেখব, শুনব !

কি দারুণ না ?

সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ( ৯৮৩০৪২৬০৭৮ )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.