কেমনে শুধিব বলো তোমার এ ঋণ।
এ দয়া তোমার, মনে রবে চিরদিন।
যবে এ হৃদয়মাঝে ছিল না জীবন,
মনে হ’ত ধরা যেন মরুর মতন,
সে হৃদে ঢালিয়ে তব প্রেমবারিধার
নূতন জীবন যেন করিলে সঞ্চার।
গিরিতীর্থ থেকে নেমে সোজা কচ্ছের রণের মরুময় প্রান্তর। তোমার মন্ত্রবলে পাষাণ গলে, ফসল ফলে– মরু বহে আনে তোমার পায়ে ফুলের ডালা ॥ লোকে ডাকে আশাপুরা মাতা। আগের দিন আদিপুর ঘুরে , নির্বাসিতেশ্বরের পূজা দিয়ে মনকে মায়ের জন্য প্রস্তুত করে নিতে পারেন। মাতা আশাপুরা কচ্ছের রণ অঞ্চলের বড় জাগ্রত দেবী। সেখানের লোকে বলে তাঁর দর্শন পেলে মরুতীর্থের মরুমায়ায় মন মেতে ওঠে। পথ গেছে ভুজের দিকে। ভুজ কচ্ছ জেলার উন্নত মানের দ্বিতীয় শহর। ভুজ শহরকে বেষ্টন আছে বেশ কয়েকটি অনুচ্চ টিলা- পাহাড়। ভুজ সংলগ্ন ভুজিয়া পাহাড়, সেখানে অবস্থান করছেন ভূজঙ্গনাথ। এই পাহাড় , মন্দির ও ভূজঙ্গনাথের নামানুসারে শহরটির নাম ভুজ। ভুজকে একটি পর্যটন শহর বললে ভুল কিছু হয় না। ভুজের স্বামীনারায়ণ মন্দিরটি খুবই আকর্ষণীয়।
ভুজের পথ রুক্ষ মরুময়। মরুপ্রান্তর সেখানে নীল আকাশে মিশে এক হয়ে গেছে। নক্ষত্রাণা হয়ে আশাপুরা মাতার মন্দির। তারপর প্রান্তর বড়ো রুক্ষ।
চলিল মানব দেখো বিমোহিত হয়ে,
পর্বতের অত্যুন্নত শিখর লঙ্ঘিয়া,
তুচ্ছ করি সাগরের তরঙ্গ ভীষণ,
মরুর পথের ক্লেশ সহি অনায়াসে।
দুইপাশে গণ্ডাবাবুলের কণ্টক সারি, কাঁটাঝোপ, একের পর এক নগ্ন টিলা ও জল হীন নদী। সকলে যেন বজ্রমাণিক গাঁথা আষাঢ়ের অপেক্ষায় দন্ডায়মান হয়ে আছে। ভুজ থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে ধূসর বুকে মাতানোরমঢ়। প্রকৃত শব্দটি হল মাতা- নো – মঢ়। মঢ় অর্থাৎ মঠ।
প্রায় সম্পূর্ণ রাস্তার ধার বরাবর বাবলা গাছে ভরা এবং খুব অল্প জায়গাতেই চাষ বা অন্যান্য গাছ-পালা । এই বাবলা গাছ সবুজায়নের জন্যে বা মরু-আগ্রাসন রোধ করার জন্যে আমদানি করে লাগানো হয়েছে ।
আশাপুরা মাতার অধিষ্ঠান তথা আশ্রম এখানেই। দেবীস্থান একটি ছোট্ট সুন্দর মরু জনপদ। ভারী শান্তি বিরাজ করছে। প্রত্যহ দূরদূরান্ত থেকে বহু বহু ভক্ত এখানে এসে দেবীর দর্শন করেন। পুজোর দেন, নিজ মনের সুপ্ত আশার কথাটি দেবীর কাছে করজোড়ে বলেন। আসলে সারা ভারতের মানুষেরই মহামায়ার কাছে একটি মূল প্রার্থনাই তো থাকে , ” আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।” দেবী সকলের মনোবাসনা পূর্ণ করেন। মন্দিরের কাছে দোকানীরা পুজোর ডালি বিক্রি করছেন। যেমনটি আপনার মন চায় তেমন ডালি সংগ্রহ করে মায়ের পুজো দিন। মনে ভক্তি রাখবেন , ডালির আড়ম্বর তো লৌকিকতা মাত্র। ডালি নিয়ে কয়েক পা এগিয়ে রম্য এক মন্দির। আশাপুরা মাতার মন্দির। অজস্র ভক্ত ডালি হাতে পুজো দিতে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন ,” ইয়ে হি মরুমাতা হিংলাজ হ্যায়, পরণাম কিজিয়ে” …. ।
এক গিরিতীর্থ হিংলাজ , এক মরুমাতা হিংলাজ। দূর হতে মন্দিরের উদ্দেশ্যে কতজন প্রণাম জানাচ্ছেন। তাঁর দরবার, তিনিই আশা পূরণ করবেন। এ সংসার তাঁর। জাগতিক মায়ার বাঁধনের আশা তিনিই পূরণ করার জন্য ভক্তদের টেনে আনেন। লাসবেলা নয় বরং ভুজের বুকে মা হিংলাজের দর্শন, এ সুযোগ পাওয়া চাট্টিখানি কথা ? এমন মাতৃদর্শনের কথা ভারতের বহুমানুষ হয়তো আজও জানেন না বা মা ইচ্ছা করে জানতে দেন নি।
মন্দির প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেই প্রথমে ভোগ মণ্ডপ। এক পাশে সুবিশাল ধর্মশালা। মধ্যস্থলে আশাপুরা মাতার মন্দির। মরুভূমির ক্ষুদ্র জনপদে এই মন্দিরের উচ্চতা ৫২ ফুট , দৈর্ঘ্য ৫৮ ফুট এবং প্রস্থে ৩২ ফুট।
১৭৬২ সাল , সিন্ধের শাসনকর্তা মির গুলাম শাহ এই মরুমাতার মন্দিরের আক্রমণ ও লুন্ঠন করে। লোকশ্রুতি আছে যে , সসৈন্য তিনি দেবীর প্রকোপে অন্ধ হয়ে যায়। পরে গুলাম শাহ নাকি দিনরাত এক করে দেবীর দরজায় বসে থাকত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবে বলে। মায়ের দয়ায় কিছুটা দৃষ্টি ফিরলেও , পুরোটা ফেরে নি। গুলাম শাহ মাকে উদ্দেশ্য করে পরবর্তী সময়ে মন্দিরের ৪০০ কিলোগ্রামের বিশাল পিতলের ঘন্টাটি অর্ঘ্য হিসাবে দান করে।মন্দিরে রয়েছে রূপো নির্মিত ৪১ প্রদীপের একটি দীপদান। কোনো এক জমাদার মন্দিরে মায়ের উদ্দেশ্যে এটি দান করছিলেন।
আশাপুরা মাতার দর্শনে ধন্য হয়ে দর্শন করতে হয় চাচারামাতার স্থান। সেখানে শিশুদের মস্তক মুণ্ডনের প্রথা আছে। বলা হয় চাচারা মাতার মন্দিরের জলকুণ্ড গঙ্গার ন্যায় পবিত্র। সেই গঙ্গাসম পবিত্র চাচারা কুণ্ডের জলে নেমে কত মানুষ নিজেদের পবিত্র করে। মন্দিরের ধর্মশালা সংলগ্ন ভোগমণ্ডপ উচ্চ নীচ নির্বিশেষে প্রসাদ গ্রহণ করেন। মাত্র ১০ টাকায় তৃপ্তি করে খাওয়া।
আশাপুরা মাতার কথা শুনে আপনারা ভারী বিড়ম্বনায় পড়ে গেলেন তাই না ? ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন নিশ্চয়? এত আশা হিংলাজ মাতার কথা শুনবেন, কিন্তু কোথায় তিনি? দৃপ্ত হৃদয়ে হিংলাজ মন্দিরের প্রবেশদ্বারের সামনে এসে দাঁড়াবেন। অপূর্ব সুন্দর মন্দির। সে মন্দির দর্শন করলে ভাবের আবেগে চোখে জল এসে যাবে। প্রেম, ভক্তি, শ্রদ্ধা নিয়ে প্রণাম করলেই দেবী সন্তুষ্ট হন। আচ্ছা হিংলাজ তো মহাস্থান , দেবীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েছিল। গিরিতীর্থে তাঁর অন্য মহিমা। কিন্তু ভুজের রুক্ষ প্রান্তরে তিনি কি মহিমায় বিরাজ করছেন?
মন্দিরের পূজারীকে প্রশ্ন করলেই তিনি সহাস্য বদনে উত্তর দেবেন, ” মনে করুন আপনি লাসবেলা হিংলাজেই আছেন। মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।” কিন্তু কেন?
দেবী, অনেক ভক্ত এসেছে তোমার চরণতলে
অনেক অর্ঘ্য আনি,
আমি অভাগ্য এনেছি বহিয়া নয়নজলে
ব্যর্থ সাধনখানি।
তুমি জান মোর মনের বাসনা,
যত সাধ ছিল সাধ্য ছিল না,
তবু বহিয়াছি কঠিন কামনা
দিবসনিশি।
কেননা ভুজের মরুপথ পেরিয়ে যেতে হয় লাসাবেলা। এটা হিংলাজেরই পথ।ওপারে লাসাবেলা হয়ে, সোনমিয়ানি পার হয়ে চন্দ্রকূপ পাহাড়। চন্দ্রকূপ থেকে অঘোরা নদী। ভগবান শ্ৰীরামচন্দ্র হিংলাজ মাতাকে দর্শন করেছিলেন এই অঘোরা নদী পার হয়ে। এই অঘোরা নদী #হিংগোলা বা #হিংগুলা নামে খ্যাত। এই নদী পার হয়ে হিংলাজ মাতাকে দর্শন করতে হয়। যেমন, অমরনাথ দর্শনে অমরগঙ্গাকে ছুঁতেই হয়। আচ্ছা , আমি কিন্তু হাঁটা পথের কথা বলছি। পদব্রজে এসব পথ ভেঙে তবেই ব্রহ্মময়ীর দর্শন পেতে হয়। অঘোরা নদী পেরিয়ে একটি পাহাড়ি গুহায় দেবী অবস্থান করছেন। সিংহবাহিনী দেবী ষষ্ঠভূজা এবং অস্ত্রধারিণী। দেবী দণ্ডায়মান নন বরং কিছুটা শায়িত অবস্থায় অধিষ্ঠিতা। সে মূর্তি জ্যোতির্ময়ী , তিনি অদ্বিতীয় এবং তুলনাহীনা। কিভগবান শ্ৰীরামচন্দ্র হিংলাজ দর্শনের পর ভূজের অনীক কুণ্ডের পাহাড় গাত্রে স্বহস্তে একটি চন্দ্র সূর্য এঁকে দিয়ে যান এবং সেটি আজও বিদ্যমান।
কাথিয়াওয়াড়ের জঙ্গলে সিদ্ধাচল পর্বতে গিরিতীর্থ হিংলাজ অবস্থান করছে। আবার মাতানোমঢ়েও হিংলাজ মাতা অবস্থান করছেন। কিন্তু সিন্ধ এবং বালুচের সীমান্তে ক্ষীরধার পর্বতমালার মধ্যে সোনমিয়ানি অঞ্চলে হিংগুলা নদীর তীরের হিংলাজ মাতা যাত্রা পথের মাঝে অধিষ্ঠিতা হলেন কি করে?
সে কথাই বলি – কচ্ছের রাজা মহারাও দ্বিতীয় দেশওয়াজী একবার হিংলাজ মহাপীঠ যাত্রার উদ্দেশ্যে লোকমন্ত্রীসন্ত্রী সহ মাতানোরমঢ়ে এলেন। দেশজুড়ে তখন নানা অস্থিরতা। সেই সময় আশাপুরা মাতা আশ্রমের পিঠাধীশ ছিলেন রাজাবাবা। তিনি মহারাওকে বললেন, ” মহারাজ, বর্তমান যা পরিস্থিতি , তা আপনি ভালোই জানেন। এই সময় আপনার সুদূর লাসাবেলা যাওয়া একদম উচিৎ হবে না।” মহারাও পীঠাধীশের বক্তব্য অমান্য করতে পারলেন না। তবে যে এত আয়োজন, এত আশা, এত পুণ্যসঞ্চয়ের বাসনা , এত লোক তাঁর সঙ্গে কেবল মাকে দর্শন করবেন বলে এসেছেন, তার কি হবে? এসব কি বৃথা যাবে? সকলের মন ভেঙে তছনছ হয়ে গেল।
হিংলাজ যাত্রা স্থগিত হল। সকলের মন ভীষণ খারাপ। রাজা হিংলাজ মায়ের নাম নিতে নিতে ঘুমিয়ে গেলেন। সে রাতে মহারাও স্বপ্নে মায়ের দর্শন পেলেন। হিংলাজ মাতা বললেন, “মহারাও, আমার যে রূপ অদর্শনে তোমার মন এত কাতর , আমি সেই ব্রহ্মময়ী হিংলাজ বলছি। তোমাকে দর্শন দেব বলে আমি হিংলাজ গিরিশিখরে অবস্থান করছি। তুমি ও তোমার তীর্থযাত্রীগণ কাল প্রত্যুষে এলেই আমার দর্শন পাবে। তোমার ও তোমার প্রজাগণের অপার ভক্তির কারণেই আমি চিরকাল হিংলাজ শিখরে অবস্থান করব। হিংলাজ শিখরে গিয়ে দুটি শিলা পাশাপাশি অবস্থান করছে দেখবে। এরাই আমার শিলাময় রূপ। ওই দুটি দিয়ে তুমি দুটি মূর্তি নির্মাণ করবে। একটি গিরিতীর্থে থাকবে ,অন্যটি প্রতিষ্ঠিত হবে আমার ব্রহ্ম রূপ দর্শন করতে যাবার পথে, মরুভূমির বুকে, আশাপুরা মাতার মন্দিরের প্রবেশদ্বারের নিকটে। যাঁরা দুর্গম মরু পার হতে অক্ষম বা ভবিষতে যখন সকলেই অক্ষম হবে তাঁরা আমাকে গিরিশিখর ও ভুজ মরুতীর্থে দর্শন করবে। আমি স্বমহিমায় এদুই স্থানে বিরাজ করব। সুদূর মরুতে আমায় দর্শন করে যে ফল লাভ হয়ে থাকে , এখানে দর্শন করেও একই ফল লাভ হবে।”
স্বপ্ন পেয়ে মহারাও ভোরের আলো ফুটে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গিরিতীর্থে গিয়ে দুই শিলাকে পাশাপাশি অবস্থান করতে দেখলেন। তাঁর আদেশে সেই পাথর কুঁদে নির্মাণ হল হিংলাজ মাতার মূর্তি। মহারাও দুটি রম্য মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন গিরিতীর্থে এবং মরুতীর্থে। এখন তো প্রায় কেউই লাসাবেলা যেতে পারেন না। তাই ভুজের মরুতীর্থেই সকলে হিংলাজ দর্শন করেন।
হিংলাজ মাতা দর্শন করলে নারায়ণ সরোবর এবং কোটেশ্বরও যেতে হয়। পাশেই হিংলাজ পাহাড়। নির্জন পর্বত। অনেকেই ওঠার কষ্ট নিতে চান না। দূর থেকে দর্শন করে ফিরে যেতে চান। কিন্তু এত মরুপথ পেরিয়ে যখন এসেছেন একবার ধৈর্য্য ধরে দর্শন করে যান। মরু হলেও এ আনন্দধাম। উপরে উঠতে উঠতে সাগরের এপার ওপার দৃশ্য ….কি অপরূপ। এপারে কচ্ছের রন , ওপারে লাসাবেলা মরুভূমি। দূর দূরান্ত সাগরের নীল জল, তারপর মরু। সে যে কি অপূর্ব মায়ার সৃষ্টি করেছে একবার না দেখলে অনুভব করা মুশকিল!
অনেকটা উচ্চ সোপান বেয়ে উপরে উঠে হিংলাজ মাতার মন্দির। সেখান থেকে নারায়ণ সরোবর ও কোটেশ্বর মন্দির।
ভুজ থেকে কোটেশ্বরের দূরত্ব ১৫২ কিলোমিটার। কচ্ছের পাঁচটি প্রাচীন বন্দরের একটি এটি। বন্দর গুলি হল – মান্ডভি, মুন্দ্রা, জখাউ, লাখপত ও কোটেশ্বর। কোটেশ্বর মহাদেব লিঙ্গ আকারে স্থাপিত হবার সম্পর্কে একটি পৌরাণিক গাঁথা আছে।
লঙ্কাপতি রাবণ নিজ তপস্যা বলে শিবকে তুষ্ট করেন। ফল স্বরূপ তাঁর প্রার্থনা শিব লিঙ্গ নিজের রাজত্বতে প্রতিষ্ঠা করার সম্মতি লাভ করেন। শিব লিঙ্গ সঙ্গে নিয়ে কৈলাস থেকে নিজ দেশে যেতে থাকেন। দেবতারা তা হতে দিতে চান না। তাই তাঁরা ছলের আশ্রয় নেন।
নারায়ণ ও শনি দেব গাভীর রূপ নিয়ে কাদায় আটকে পড়ার নাটক করতে থাকেন। রাবণ লঙ্কায় ফেরার পথে তাই দেখে এক হাতে শিব লিঙ্গ ধরে রেখে অন্য হাতে গাভীকে কাদা থেকে টেনে বের করার চেষ্টা করে বিফল হন।
তখন শিব লিঙ্গ মাটিতে রেখে দুই হাতে টেনে গাভী উদ্ধার করেন। এবার শিবলিঙ্গ তুলতে গিয়ে দেখেন অসংখ্য শিবলিঙ্গ সেখানে রয়েছে। বাধ্য হয়ে রাবণ মায়া শিবলিঙ্গ নিয়ে চলে যান আর আসল মহাদেব কোটি শিব লিঙ্গের মধ্যে ওখানেই থেকে যান।
সেই কোটি শিব লিঙ্গের কারণে ‘কোটেশ্বর’ নামে বিখ্যাত হয়েছেন। সাধারণ মানুষ এই শিবলিঙ্গ ছাড়া অন্যান্যগুলো দেখতে পান না।
এই শিব লিঙ্গ তথা মন্দির বেশ প্রাচীন।
(বিখ্যাত চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং তাঁর ভারত ভ্রমণ কালে এখানে এসে এই মন্দির দেখেছিলেন বলে বর্ণনা করেছেন।)
প্রশস্ত এক চত্বরে, যার দুই দিকেই অনেকগুলি মন্দির। মন্দির পরিসর আর সরোবরের মাঝে বেশ উঁচু, একেবারে দুর্গের দেয়ালের মতো বুরুজ সহ দেয়াল। সেই দেয়ালের নিচে দেখা গেল দেয়ালের তুলনায় অনেক ছোট এক দরজা। তবে দরজার মাথায় লেখা আছে ‘সরোবর’।
দরজা দিয়ে অন্য দিকে বাহির হতে সামনে পাথরে বাঁধানো কয়কটি সিঁড়ি আর প্রস্থে কম কিন্তু দৈর্ঘ্যে বেশ বড় চাতাল সহ মাঝারি আকারের এক সরোবর। অপর পারে কিছু বাড়ি ঘর রয়েছে আর পূর্ব দিকে ঘাটের ধারে এক বিরাট অশ্বত্থ গাছ। ঘাটে স্নান করে অনেকে পূজা দেন। কোটেশ্বর মন্দিরের টিলায় ওঠবার মুখে প্রায় সব মন্দিরের সামনে যেমন থাকে, পূজা দেবার জন্য ফুল-বেল পাতা, ধূপ ইত্যাদির দোকান এখানেও রয়েছে।
এক দিকে একটাই মন্দির, ত্রিবিক্রমরাই-এর । আর অন্য দিকে অনেকগুলো মন্দির সার দিয়ে একই চত্বরে, একই ছাদের নিচে। পরস্পর ঘর, সামনে লম্বা ও ঢাকা বারান্দা সহ।
বারান্দার মাঝে একটা মাত্র দরজা খোলা। আলাদা আলাদা ঘরে পরস্পর লক্ষ্মী-নারায়ণ, আদিনারায়ণ, গোবর্ধননাথ, রণছোড়জী আর লক্ষ্মীর মূর্তি। প্রত্যেকটি মূর্তি কালো পাথরের আর মোটামুটি এক থেকে দেড় মিটার উচ্চতার। মূর্তিগুলির গঠনশৈলী গুজরাট, বিশেষ করে কচ্ছের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, প্রত্যেকটির শৈল্পিক গুণ অসাধারণ।
নারায়ণ সরোবর থেকে কোটেশ্বর পর্যন্ত রাস্তা বেশিটাই সমুদ্রের ওপর দিয়ে, তবে রামেশ্বরমের মতো কোনও সেতু নেই। সমুদ্রের ওপরই মাটি ফেলে উঁচুতে রাস্তা করা হয়েছে। সমুদ্র এখানে অত্যন্ত অগভীর, অর্থাৎ এই অঞ্চলও কচ্ছের রনের অংশ।
দু পাশের ভূমি অবশ্য লবণের চাদর গায়ে দিয়ে নেই, ঢেউ হীন সমুদ্রের জলই রয়েছে। উঁচু ছোট টিলার ওপরে মন্দির। পরিষ্কার বোঝা যায় যে আগে নিশ্চয় মন্দির এলাকা দ্বীপ ছিল। সেখানে মাটি ফেলে রাস্তা করে এই দ্বীপকে কচ্ছের প্রধান ভূমির সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আমরা কয়েকটা সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরের পিছনে, অর্থাৎ পূর্ব দিকে পৌঁছলাম । পশ্চিমমুখী মন্দির। সামনে ছোট নাটমন্দির, তার পর গর্ভগৃহ। গর্ভগৃহের মাঝে কালো পাথরের শিবলিঙ্গ। তবে নিচের অংশ বেশ বড় এবং অনেকটা লম্বা ও সাদা।
গর্ভগৃহ মোটেই গোধূলি বেলায় অন্ধকার হয় না। বিশেষ করে পশ্চিমমুখী হবার কারণে। বিকাল হলে বলে আলোর তীব্রতা ভালই, কেন না সূর্যের কিরণ শিব লিঙ্গকে আলোকিত করছে।
চতুষ্কোণ ছোট নাট মন্দির। সামনে বসা নন্দী, অত্যন্ত সুন্দর ও জীবন্ত। ঠিক তার সামনে মেঝেতে গোল প্রতিকৃতি কালো পাথরের। সব শিব মন্দিরে না হলেও বেশির ভাগেই গোল প্রতিকৃতি থাকে।
মন্দিরের সামনেই উঁচু পাঁচিল ঘেরা পাথরের চত্বর একেবারে সমুদ্রের জল থেকেই উঠেছে। ভাটার কারণে জল দূরে সরে গেলেও , জোয়ারের জল মন্দির চরণ স্পর্শ করে। এই মন্দিরের চত্বরের মধ্যেই, যেমন হয়ে থাকে সাধারণত, আরও কয়েকটি মন্দির আছে। ঠিক পাশেই আর এক শিব মন্দির, নাম কল্যাণেশ্বর। আর আছেন শরণেশ্বর।চত্বর থেকেই দেখা যায় যে ,উত্তর দিকে লম্বা ভূমি সমুদ্রের মধ্যে প্রায় অর্ধচন্দ্রাকারে ঢুকে গেছে। দিকচক্রবালের উত্তর দিকে অস্পষ্ট ভূমি রেখা দেখা যায়। মরুতীর্থ হিংলাজ যাবার পথ এই কোটেশ্বরের ওপর দিয়েই।
যে পথে কোটেশ্বর , শরণেশ্বর , কল্যাণেশ্বর প্রভৃতি শিবমন্দির দর্শন করা হয় , সেই পথেই দুই কিলোমিটার ফিরে গেলে নারায়ণ সরোবর।
কচ্ছের একটি ক্ষুদ্র জনপদ। মন্দির এলাকাটি দুর্গপ্রাকারে ঘেরা । বিশাল সরোবর । আগে এর ব্যাপ্তি ছিল দিগন্তজোড়া। এখন প্রায় মজে এসেছে। নারায়ণ সরোবর পুণ্য ও পবিত্র সরোবর। শাস্ত্রে যে পঞ্চ সরোবরের নাম আছে তার মধ্যে নারায়ণ সরোবর একটি। এই পঞ্চ সরোবর হল – উত্তরে মানস সরোবর, দক্ষিণে পম্পা সরোবর, পূর্বে ভুবনেশ্বরে বিন্দু সরোবর, মধ্যভারতে পুষ্কর সরোবর ও পশ্চিম সীমান্তে নারায়ণ সরোবর।
সনাতন ধর্মে এবং এই সরোবর-স্থিত স্থানগুলো তীর্থস্থান হিসাবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। এই সরোবর গুলোর সৃষ্টি পৃথিবীর আদি কালেই হয়েছে বলে বিশ্বাস। মানস সরোবর, কৈলাস পর্বতের কাছে আর পুষ্কর, রাজস্থানের আজমিরের কাছে। এগুলো বেশ পরিচিত। বিন্দু সরোবর গুজরাটের উত্তরে সিদ্ধপুরে। বলা হয় কপিল মুনি সাধনা করে এখানেই সিদ্ধি লাভ করেন। আর পম্পা সরোবর দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকের কোপ্পল জেলায় বিখ্যাত বিজয়নগর সাম্রাজ্যের হাম্পির কাছে।
শ্রীমদ্ভাগবতে লেখা আছে যে নারায়ণ সরোবরের জলে বসেই পৃথু-পৌত্র ও বর্হিসের পুত্র প্রচেতা (বর্হিসের স্ত্রী, সমুদ্র-কন্যা স্বর্ণার দশ পুত্র হয়, তাঁরা প্রত্যেকেই প্রচেতা নামে খ্যাত) পিতৃ-আজ্ঞা পালন করার জন্যে দশ সহস্র বছর রুদ্রগীতের জপ করে শ্রীহরিকে প্রসন্ন করেন এবং শ্রীহরির আশীর্বাদের ফলে এক পুত্র সন্তান লাভ করেন। সেই পুত্রই কালক্রমে দক্ষ-প্রজাপতি নামে পরিচিত হন।
জৈন ধর্মের প্রবর্তক, আদিনাথ বা ঋষভদেবও নাকি এখানেই তপস্যা করেছিলেন। (মাসেডোনিয়ার আলেকজেন্ডার, দি গ্রেট নাকি তাঁর বর্ণনায় এই সরোবরের কথা লিখেছেন)
স্থানীয় মানুষ এখানে অনেক মুনি-ঋষির নাম করেন, যাঁরা নাকি এরই তীরে তপস্যা করেছেন বা এখানে তীর্থ ভ্রমণে এসেছিলেন। গুরু নানক তাঁর সফরকালে এই নারায়ণ সরোবরের তীরে কিছু দিন কাটিয়ে যান। তীর্থ ভ্রমণার্থীদের সেই তালিকার মধ্যে তাঁরা স্বামী বিবেকানন্দের নামও উল্লেখ করেন আর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে থাকেন।
নারায়ণ সরোবর দর্শন করে পুনরায় মাতানোমোঢ় দিয়েই ফেরার পথ। লোকশ্রুতি আছে পাহাড়ওয়ালি মাতা মধ্যরাতে অলৌকিক কৃপাদৃষ্টি দিয়ে ধন্য করেন সকলকে। তিনি নানা রূপে মাতানোমঢ়ে অবস্থান করেন। হিংলাজ পর্বতে আলোকময়ী হয়ে অবস্থান করেন। বাতাসে সুগন্ধী সৌরভ হয়ে অবস্থান করেন। তিনি শত্রু বিনাশক। তিনি সুবিশাল মরুঅঞ্চলের কুলদেবী। তিনি পাপের হিসাব রাখেন। মহাকালের কালচক্রে সেই পাপের হিসাব তিনি ধীরে ধীরে ফিরিয়ে দেন।
হিঙ্গুলায়াং মহাস্থানম, মাতানোমঢ়ঃস্তথৈবচঃ।
সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম্ বাংলায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হল)