৩রা_ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪, আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে দিনটা ছিলো মৌনি অমাবস্যা। আর স্বাধীনতার পর সেবারই প্রথম প্রয়াগে বসেছে পূর্ণ কুম্ভের মেলা। সব ঠিকঠাক চলছিল কিন্তু এদিন সকাল ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে ঘটে গেল সেই ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। পদপিষ্ট হয়ে মারা গেলেন বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা অসংখ্য পূণ্যার্থী। ঠিক ক’জন তার হিসেব নেই। তৎকালীন উত্তরপ্রদেশ সরকারের হিসেব, সব মিলিয়ে ৩১৬ জন। যার মধ্যে ২৫৩ জন মহিলা, ৪৯ জন পুরুষ ও ১৪ জন শিশু। কিন্তু বেসরকারি মতে সংখ্যাটা অন্তত আটশো থেকে হাজার। কয়েকশো লাশ নাকি গোপনে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঘটনাস্থল থেকে মাত্র তিন চার কিলোমিটার দূরে আমি হয়তো তখন ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় রোদ্দুরে খেলা করছিলাম। পরদিনেই আমার পৃথিবীতে আসার পূর্ণ হয়েছিলো ঠিক দুটি বছর।‌????????

সেদিনের অঘটন নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলেন স্বাধীন ভারতে ভিআইপি নামে যে এক নতুন শ্রেনীর মানুষ কুম্ভে আসেন, পুলিশ তাঁদের নিয়েই ব্যস্ত ছিলো। কারও বক্তব্য সঙ্গমে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশ সেদিন লাঠি চালিয়েছিল, সে থেকেই বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি। কেউ বলছেন ওসব নয়, আখড়ার নাগা সাধুরা ত্রিশূল নিয়ে লোকজনকে তাড়া করেছিলো। কারও আবার বক্তব্য আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল, ভিড়ের চাপে সঙ্গমের রাস্তায় বহু লোক একে অন্যের ওপরে পিছলে পড়েছিলেন, টাল সামলাতে না পেরে। সব কারণ গুলোকে একত্র করলে দাঁড়ায়, বৃষ্টি এবং অপ্রশস্ত রাস্তা। আখড়ার সাধু এবং জনতা একই রাস্তায় সঙ্গম থেকে ফিরছিলো। তখনই আর একটি আখড়া সেই রাস্তা দিয়েই সঙ্গমের দিকে এগোচ্ছিল। চলমান জনতা ভয়ে ভক্তিতে থমকে যায়। ফলে ভিড়ের চাপে দম বন্ধ হয়ে মারা যায় মানুষ।‌????

এই ঘটনা অবলম্বনে সমরেশ বসু কালকূট ছদ্মনামে লিখলেন এক অনবদ্য উপন্যাস “অমৃত কুম্ভের সন্ধানে….!” ‌ভীড়ের চাপে পিষ্ট হয়ে মারা গেল তাঁর উপন্যাসের চরিত্র শ্যামার বর ও লক্ষ্মীদাসীর স্বামী বলরাম। পরদিন গঙ্গার পাড়ে সত্যিই জ্বলে উঠেছিলো সার সার চিতার আগুন। সেই সাথে বাংলার সাহিত্যকাশে উদয় হলো এক নতুন নক্ষত্রের। ‌????️

দুর্ঘটনার পর সরকার ভবিষ্যতে এ রকম ঘটনা ঠেকাতে ‘বর্মা কমিটি’ গঠন করেছিলেন। তাদের সুপারিশে বলা হয়েছিল, পুরো মেলাকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করতে হবে। প্রতিটি সেক্টরে থাকবে পর্যাপ্ত পুলিশ, প্রশাসনের লোকজন ও চিকিৎসক। শাহি স্নানের দিন ভিড় সঙ্গমের দিকে এক রাস্তায় যাবে এবং অন্য রাস্তা দিয়ে ফিরবে। কোথাও যেন জমায়েত না হয়।

সেই সুপারিশ কিন্তু আজো কঠোর ভাবে মানা হয়। ২০১৩ সালে দেখেছি মোট পনেরটি সেক্টর। আমার জাঁদরেল গিন্নির হাজার চেঁচামেচিতেও উত্তর প্রদেশ পুলিশ ব্যারিকেডের নীচে দিয়ে গলতে দেয়নি। ফলে ফেরার সময় বেশ কিছুটা রাস্তা বেশি হাঁটতে হয়েছিল। শাহী স্নানের দিন আখড়ার জুলুসের রাস্তা এখন পুরোপুরি আলাদা, সাধারণ পুণ্যার্থীদের ওই রাস্তায় নো এন্ট্রি। আর একটি আখড়া চলে যাওয়ার পর বেশ কিছু সময়ের ব্যবধান রেখে অন্যটি আসে। আখড়া কমিটি থেকে আগেই ঠিক করা থাকে নাগা সন্ন্যাসীদের কোন গ্রুপ আগে স্নানে যাবে…. জুনা না মহানির্বাণ ? ‌কোটি কোটি মানুষের চলমান ভিড়কে কখনই থামতে দিচ্ছে না পুলিশ, লাঠি উঁচিয়ে সমানে বলছে, আগে বাড়ো….. আগে বাড়ো …!‌????

কদিনের জন্য গোটা ভারতবর্ষ যেন উঠে আসে এই সঙ্গম তীরে, লোকজন কি তবে হারিয়ে যায়না ? যায়….. তবে খুঁজেও পায়। কৃতিত্ব রাজ্য প্রশাসনের। গোটা মেলা জুড়ে রয়েছে বেশ কয়েকটি ‘ভুলেভটকে’ শিবির। হারিয়ে যাওয়া দেহাতি মানুষগুলোকে এখানেই জমা করে পুলিশ। আর তারপর মাইকে ঘোষণা করা হয়, ‘বেগুসরাই জেলার ধনিয়া, তোমার মা এই শিবিরে অপেক্ষা করছেন’। এখানেই ইতি নয়, ধনিয়ার মায়ের হাতেও মাইক্রোফোন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি দেহাতি টানে ‘আরে ও ধনিয়া, ম্যায় খো গ্যয়ি’ বলেই হু হু করে কান্না…. কথা শেষ হয় না! বাংলাও শুনতে পাবেন, ‘ও লক্ষ্মীদি, আমি কেষ্টপুর গ্রাম থেকে তোমার সঙ্গে এসেছিলাম গো’, বাকি কথা চাপা পড়ে যায় কান্নায়….!

মেলায় আসা অর্ধেকের বেশি মানুষ ঠিকঠাক থাকার জায়গা পায়না। মাঘ মাসের এই কড়া ঠান্ডায় বিনা ছাউনিতে বালির ওপরেই শুয়ে থাকে তারা। শীতবস্ত্রের কথা নাইবা বললাম। যুগ যুগ ধরে কেন এতো কৃচ্ছসাধন করে কোটি কোটি মানুষ ছুটে আসে এখানে, কোন আকর্ষণে…. কিসের সন্ধানে ? শুধুই কি বিশ্বাস, নাকি অন্য কিছু…..? উত্তরটা লুকিয়ে আছে মহাকালের গর্ভে!

দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্র থেকে বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মীয় সমাবেশ… টিকিয়ে রাখে কিন্তু এই অশিক্ষিত গরীবগুর্বো আর ভীরু মানুষ গুলোই। এরাই আমার দেশের মানুষ, আমার আপনজন। জন্মদিনে লেখক কালকূট কে আমার শ্রদ্ধাঞ্জলি….! ‌????????
কলমে ✍???? স্বপন সেন ????

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.